মতপ্রকাশ প্রসঙ্গে

আবুল কাসেম ফজলুল হক
আবুল কাসেম ফজলুল হক
প্রকাশ: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৬:৩৮
কথা বলার স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, সরকারি নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদির কথা দ্বারা যে সমস্যাকে বোঝানো হয়, বর্তমান আলোচনায় সে বিষয়েই কিছু কথা বলব। চিন্তার স্বাধীনতার মর্মার্থ হলো, স্বাধীনভাবে চিন্তা ও মতপ্রকাশ করার স্বাধীনতা। বাংলাদেশের সমস্যাই আমাদের বিবেচ্য।
যারা বিবেকমান, চিন্তাশীল ও সক্রিয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী, তারা দেশের চলমান অবস্থাকে নিরাপদ মনে করেন না। কেবল আজকের কথা নয়, স্বাধীন বাংলাদেশের গোটা সময়টা ধরেই এই অবস্থা চলমান। তবে এরই মধ্যে প্রায় সকলে অনুভব করেছেন, আমাদের বর্তমান খারাপ হলেও ভবিষ্যৎ ভালো হবে। নিজের জাতির প্রতি জনসাধারণের এই আস্থা ও আশাই বাংলাদেশকে অস্তিমান রেখেছে। রাজনীতির দুর্গতি দেখে মানুষ বারবার মর্মাহত হয়। কিন্তু আশা ছাড়ে না। বাংলাদেশে রাজনীতি তো এখন রাজনীতিবিদদের আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে! রাজনীতিতে সক্রিয় ব্যক্তিত্বের মধ্যে তো আত্মজিজ্ঞাসা, আত্মসমালোচনা ও আত্মশুদ্ধির কোনো প্রচেষ্টা খুঁজে পাওয়া যায় না।
আগে নিয়ন্ত্রণ ছিল সরকারের। সরকার নিয়ন্ত্রণ করত আইন জারি করে পুলিশ ও আদালতের মাধ্যমে। সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে অন্য কোনো নিয়ন্ত্রণকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হতো না। এখন সরকারি নিয়ন্ত্রণের বাইরে দেশি-বিদেশি নানা শক্তির দৃশ্যমান ও অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণ অনেক বেশি। স্বাধীনভাবে চিন্তা করার এবং সুচিন্তিত মতপ্রকাশের সমস্যা ক্রমেই জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। সমাধানযোগ্য সমস্যাবলির সমাধানের বিজ্ঞানসম্মত চিন্তা ও চেষ্টা বাংলাদেশে অল্পই আছে।
আমি লক্ষ্য করেছি, সামরিক শাসন ও জরুরি অবস্থার মধ্যেও অধিকাংশ সময়ে সর্বজনীন কল্যাণে মতপ্রকাশের সুযোগ ছিল। কিন্তু মূল্যবান মতই দেশে খুঁজে পাওয়া যেত না। প্রচারমাধ্যম ও রাষ্ট্রীয় শিক্ষাব্যবস্থা এখন সবচেয়ে বড় নিয়ন্ত্রক। আমি সর্বজনীন কল্যাণের পরিপন্থি নিয়ন্ত্রণের কথা বলছি, সব ধরনের নিয়ন্ত্রণ নয়। রাজনৈতিক দল, বৈদেশিক প্রণোদনাপুষ্ট বেসরকারি সংস্থা, অসহিষ্ণু জঙ্গিবাদী ধর্মীয় সংস্থা, চরমপন্থি উগ্রতা ও সন্ত্রাস সর্বোপরি ভোগবাদ-সুবিধাবাদ ইত্যাদির দ্বারা নানাভাবে স্বাধীন চিন্তাশীলতা ও প্রগতিশীল মতপ্রকাশ দারুণভাবে বিঘ্নিত হয়ে আসছে। শিক্ষাব্যবস্থা, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা সংস্থা, তথ্যপ্রযুক্তি ইত্যাদিও চিন্তার শুভকর বিকাশ, মত গঠন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করে আসছে। জনগণ এসব মেনে চলছে। প্রতিবাদ ও বিকল্প সন্ধান অল্পই আছে।
চিন্তার ও মতপ্রকাশের সমস্যা নিয়ে যে আলোচনা আমরা করছি, তাতে মানুষের স্বরূপ, মানুষের প্রকৃতি, The nature of man, the concept of man, humanatic ইত্যাদি সম্পর্কে আমাদের যথাসম্ভব ধারণা অর্জন দরকার। বাংলা ভাষার আধুনিক যুগের লেখকদের লেখার মধ্যে মানবপ্রকৃতি ও মনুষ্যত্ব নিয়ে অনেকে আলোচনা করেছেন। রাজনৈতিক মহলে এ বিষয়ে অনুসন্ধিৎসা, অনুসন্ধান ও বিচার-বিবেচনা দরকার। মানুষের বেলায় মন কী, তা নিয়েও বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা-সমালোচনার মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন করা দরকার। রাজনীতিই রাজনীতি– বিষয়ে, চিন্তার, মনমানসিকতা অর্জনের মূল বিষয়। তবে এ বিষয়ে পরিচ্ছন্ন ধারণা লাভের জন্য আনুষঙ্গিক অনেক বিষয়ের জ্ঞানও দরকার। রাজনীতি নিয়ে এ দেশে গভীর চিন্তাভাবনা কোনো কালেই করা হয়নি।
আমাদের বুঝতে হবে যে সকলেই চিন্তক নন, কেউ কেউ চিন্তক; নতুন চিন্তা, নতুন ভাব ও নতুন মত প্রকাশ করার তাগিদ চিন্তক-ভাবুকেরাই অনুভব করেন। চিন্তার স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা তাদের জন্যই দরকার। তাদের থেকেই আত্মপ্রকাশ করেন আবিষ্কারক, উদ্ভাবক ও সৃষ্টিশীল ব্যক্তিরা। তারা প্রতিভাবান ও সৃষ্টিশীল, তারা দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক, জ্ঞানসাধক, আদর্শবাদী ও স্বাপ্নিক। উন্নততর নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন তারা দেখেন এবং সকলকে দেখান। চিন্তক ও ভাবুকদের চিন্তা ও কাজের দ্বারা সবাই উপকৃত ও লাভবান হন। কায়েমি স্বার্থবাদী ও হীন স্বার্থান্বেষীরা তাদের কাজকে ভয় পায়। মনে করে, সৃষ্টিশীল ও প্রগতিশীলদের চিন্তাও তাদের সম্পত্তি ও ক্ষমতার জন্য ক্ষতিকর হবে। গণজাগরণকে তারা ভয় পায়। এ জন্য তারা সৃষ্টিশীল ও প্রগতিশীলদের ওপর নিয়ন্ত্রণ চালায়। তাদের চিন্তার স্বাধীনতাকে খর্ব করে এবং নির্যাতন চালায়। ইতিহাসে এর দৃষ্টান্তের অভাব নেই। নির্যাতন ও নীতিকে অতিক্রম করে কিংবা মোকাবিলা করেই সৃষ্টি সম্ভব হয়েছে। এ ক্ষেত্রে জনসমর্থন অত্যন্ত ও গুরুত্বপূর্ণ। জনসমর্থন পেলে সৃষ্টিশীল মনীষা সফল হয়। স্বার্থের ব্যাপার আছে। অকারণে কেউ কারও চিন্তার স্বাধীনতায় বাধা দেয় না। সমস্যার প্রকৃতি সব দিক থেকে ভালো করে বুঝতে পারলে যথাযথ সমাধান সম্ভব হয়। রাজনীতিতে ও রাজনীতিবিদদের মধ্যেও সৃষ্টিশীল চিন্তা ও কর্ম দরকার। যারা সর্বজনীন কল্যাণে বড় কিছু করতে চেয়েছেন, করেছেন, তেমন রাজনৈতিক নেতাও রয়েছেন। আজকের বাংলাদেশে সে দিকটাতে গুরুত্ব দেওয়া দরকার।
প্রতিভাবান ও সৃষ্টিশীলরাও অভ্রান্ত হন না। ভুলত্রুটি সংশোধনের ও প্রগতির জন্য সমালোচনা অপরিহার্য। সমালোচনায় সকল পক্ষের মধ্যেই সত্যসন্ধ ও সত্যনিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি দরকার। রক্ষণশীল ও প্রগতিশীল শক্তি সমাজে থাকবেই। তাদের মধ্যে দরকার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি। রক্ষণশীলরা শেষ পর্যন্ত প্রগতিশীলদের সঙ্গেই কাজ করেন। কিন্তু কায়েমি স্বার্থবাদীরা ও হীন স্বার্থান্বেষীরা প্রগতিবিরোধী, গণবিরোধী ধারায় অবস্থান নেয়।
বাংলাদেশের মানুষের ইতিহাস অত্যন্ত জটিল। এ দেশের রাজনীতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্যের ইতিহাস সন্ধান করলে দেখা যায়, বিভিন্ন ঐতিহাসিককালে জনজীবনের বিরাট বিরাট সম্ভাবনা কীভাবে নষ্ট হয়ে গেছে নেতৃত্বের অভাবে। নেতৃত্ব ও সংঘশক্তি সৃষ্টিতে এ দেশের মানুষ প্রায় কোনো কালেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেনি। বিদ্রোহ বিভিন্ন সময়ে হয়েছে, সংগ্রামও হয়েছে; কিন্তু অভীষ্ট নেতৃত্বের অভাবে সর্বজনীন কল্যাণে সেগুলো কার্যকর হয়নি। সুশৃঙ্খল, উন্নতশীল বা প্রগতিশীল সমাজ ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর গত তিপান্ন বছর কীভাবে কেটেছে?
শেখ মুজিবুর রহমান, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, জিয়াউর রহমান, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনা– এদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ– বাংলাদেশের জনজীবন কেমন কেটেছে? রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ কতটা গড়ে উঠেছে? এখন বাংলাদেশ রাজনীতিবিদদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। যে উপদেষ্টা পরিষদ নিয়ে বাংলাদেশ চলছে, তার মধ্যে তো রাজনীতিবিদ নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে বাংলাদেশ, বাংলাদেশের সরকার ও জনজীবন নিয়ে কথা বলছে, পরামর্শ দিচ্ছে, তা দেখে তো মনে হয়, বাংলাদেশ কোনো স্বাধীন রাষ্ট্র নয়। এটা যে কেবল এই উপদেষ্টা পরিষদের শাসনকালেই চলছে তা নয়; চলছে আরও অনেক আগে থেকে। বাংলাদেশের একটি জাতীয় পতাকা আছে, একটি জাতীয় সংগীত আছে, জাতিসংঘের সদস্যপদ আছে। কিন্তু স্বাধীনতা কি আছে? বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদন, গ্যাস-তেল-কয়লা ইত্যাদি খনিজ সম্পদ আছে, মাটি-পানি-বাতাস ও সূর্যকিরণের প্রাচুর্য আছে, আয়তনে ক্ষুদ্র বটে, তবে জনসংখ্যা বড়। বাংলাদেশ তো পৃথিবীর সবচেয়ে সমৃদ্ধ, সবচেয়ে শক্তিশালী দশটি রাষ্ট্রের একটি হতে পারত! কিন্তু পারছে না কেন? বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মানুষ খুব বেশি ঈর্ষাপরায়ণ, পরশ্রীকাতর, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যপ্রিয়, আত্মকেন্দ্রিক, সংঘশক্তিহীন, অলস, কর্মবিমুখ। বলা হয়েছে, এ দেশের মানুষের প্রখর বুদ্ধি আছে বটে, তবে তারা তাদের বুদ্ধির খুব বেশি অপচয় করে। বলা হয়েছে, এ দেশের মানুষ গোটা ঐতিহাসিক কাল ধরেই অলস, কর্মবিমুখ, ভোগলিপ্সু। ১৯৭২ সাল থেকে পাঁচ-সাত বছর ধরে এসব কথা দেশি-বিদেশি জ্ঞানী-গুণী অনেক লোকে বলেছেন যে, এই মানুষদের নৈতিক চেতনা নিতান্ত দুর্বল, ইতিহাস চেতনা নেই ইত্যাদি। জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দশকেই এসব কথা ক্রমাগত বলা হয়েছে। এই তিপান্ন বছরে বাংলাদেশ কি রাজনৈতিকভাবে উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নতি করেছে? এখন অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত উপদেষ্টা পরিষদ কর্তৃক পরিচালিত হচ্ছে। এটা কোনো স্বাভাবিক অবস্থা নয়। আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের একটি নির্বাচন করার যোগ্যতাও অর্জন করেনি। এই সরকার রাষ্ট্র ব্যবস্থার সংস্কারের জন্য যে চেষ্টা চালাচ্ছে তার প্রতি জনগণের সম্মতি আছে। এই প্রচেষ্টা সফল হোক– এই কামনা করি। কিন্তু বাস্তবে দ্রব্যমূল্যের চাপে দেশের অন্তত অর্ধেক লোক চরম দুর্গতির মধ্যে আছে। একশ্রেণির ভদ্রবেশী দুর্বৃত্ত নানাভাবে লুটপাট চালিয়ে যাচ্ছে। নানা স্তরের দুর্বৃত্তরা দুষ্কর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। এসব থেকে জনসাধারণকে রক্ষা করাও সরকারের কর্তব্য।
সভাপতি, বাংলা একাডেমি
- বিষয় :
- আবুল কাসেম ফজলুল হক
- প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী