ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

সমসাময়িক

‘কনডেম সেলের ধারণা ঔপনিবেশিক, মধ্যযুগীয়’

‘কনডেম সেলের ধারণা ঔপনিবেশিক,  মধ্যযুগীয়’

জেড আই খান পান্না চেয়ারপারসন আসক

জেড আই খান পান্না

প্রকাশ: ০২ জুন ২০২৪ | ০৬:১৬

মৃত্যুদণ্ডাদেশ চূড়ান্ত হওয়ার আগে কোনো ফাঁসির আসামিকে কনডেম সেলে রাখা অবৈধ ও বেআইনি বলে রায় দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে জেল কোডের ৯৮০ বিধি অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হয়েছে। ১৩ মে বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি মো. বজলুর রহমানের বেঞ্চ এ রায় দেন। পরে ১৫ মে হাইকোর্টের দেওয়া রায় ২৫ আগস্ট পর্যন্ত স্থগিত করেন চেম্বার আদালত। রাষ্ট্রপক্ষের করা আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ আদেশ দেন আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম। এ সময়ের মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষকে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল দাখিল করতে বলা হয়। 
২০২১ সালে বিভিন্ন কারাগারের কনডেম সেলে বন্দি থাকা তিন কয়েদির করা রিট আবেদন নিষ্পত্তি করে বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি মো. বজলুর রহমান সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ সোমবার এই রায় ঘোষণা করেন। তিন রিটকারী হলেন সাতকানিয়ার জিল্লুর রহমান, সুনামগঞ্জের আব্দুল বশির ও খাগড়াছড়ির শাহ আলম। বিচারিক আদালতের মৃত্যুদণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে তাদের আপিল ও ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদনের আবেদন) হাইকোর্টে বিচারাধীন।


জেলখানা এবং কনডেম সেলের ধারণা ঔপনিবেশিক আমলের। আমরা অন্ধকূপের কথা পড়েছি বইপত্রে। ব্রিটেনেও কিন্তু অন্ধকূপ রয়েছে। ওরা বলে ডেথ সেল। ফরাসি বিপ্লবের সঙ্গে বাস্তিল দুর্গের অনুষঙ্গ জড়িয়ে আছে। বাস্তিল দুর্গও ছিল ডেথ সেল। প্রকারান্তরে কনডেম সেল। কাউন্ট অব মন্টিক্রিস্টো বইয়ে আলেকজান্ডার দ্যুমা যে শ্যাত দইফের বর্ণনা দিয়েছেন, সেটিও কনডেম সেল। সেখানে তরুণ দান্তে ও বৃদ্ধ ফারিয়া পাশাপাশি কনডেম সেলে ছিলেন। বোঝাই যাচ্ছে, এ ধরনের কক্ষের ধারণা মধ্যযুগীয়। বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছিল কি এই ঔপনিবেশিক ধারণাগুলো আঁকড়ে রাখার জন্য? 
এই হলো এক। আর দুই হলো– যে মানুষটা নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ড পেলেন, তাঁকে নিয়ে কনডেম সেলে রাখা হলো। তাঁর মৃত্যুদণ্ড তো তখনই নিশ্চিত করা হচ্ছে না। তাঁকে দশ বছরও অপেক্ষা করতে হতে পারে। হাইকোর্ট ডিভিশন, হাইকোর্ট ডিভিশনের ডেথ রেফারেন্স, আপিল বিভাগের অনুমোদন; আপিল বিভাগ একটা রিভিউ দিতে পারে। রিভিউর পরে আছে রাষ্ট্রপতির বিবেচনা। সব মিলিয়ে দশ বছর লেগে যায়। দশ বছর পরে যদি দেখা যায় তিনি নির্দোষ, এর দায়দায়িত্ব কে নেবে?
জেলখানার ধারণা কি কেবল শাস্তি দেওয়া? আমাদের সাবেক প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন তাঁর ফেয়ারওয়েলের সময় বলেছিলেন, ‘ডেথ পেনাল্টি দিয়ে যদি অপরাধ কমানো যেত, তাহলে স্বামীর দ্বারা স্ত্রী হত্যার পরিমাণ আরও কমে যেত।’ দুনিয়ায় দেখা যায় না, মৃত্যুদণ্ড দিয়ে কখনও অপরাধ দমন হয়েছে। ঔপনিবেশিক আমলে সেলুলার জেল হয়েছে আন্দামান দ্বীপে, সবই কনডেম সেল। এটি শুধু ঔপনিবেশিক ধারণাই নয়, বরং শাস্তি দেওয়ার মধ্যযুগীয় ঔপনিবেশিক ধারণা। 
আমি আরও মনে করি, মৃত্যুদণ্ডের ধারণা একটা মধ্যযুগীয় ধারণা। আপনি একজন ফাঁসির আসামির রায় কার্যকর হওয়া সামনে বসে দেখতে পারবেন? পারবেন না। তাহলে? এগুলো তো বদলানো উচিত। গত ৩০ মে ছিল ফরাসি বীরাঙ্গনা জোয়ান অব আর্কের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর দিবস। ১৬৩১ সালে মাত্র উনিশ বছরের এই মেয়েটিকে ডাকিনি আখ্যা দিয়ে চার্চের রায়ে জনসমক্ষে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। আজ এই দৃশ্য কল্পনা করা যায়?  
মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে প্রবেশন
এই মৃত্যুদণ্ডের ধারণা তুলে দেওয়া উচিত। এর পরিবর্তে প্রবেশন চালু হতে পারে। প্রবেশন পৃথিবীর সব জায়গায় আছে। আমাদের এখানে প্রবেশন ছোটোখাটো সাজার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হচ্ছে এখন পর্যন্ত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনেক সময় প্রতিবেদন হয়, তিনশ বছর সাজা, সত্তর বছর সাজা। এর অর্থ হলো, তাঁকে প্রবেশনে দেওয়া হয়। জেলখানার ভেতর তিনি যদি ভালো আচরণ করেন, তাঁকে বাইরে, হয়তো কোনো গ্রামে অথবা যেখানে শাস্তি ভোগকারী খাপ খাইয়ে নিতে পারবেন এমন কোনো জায়গায় স্থানান্তরিত করে বিশেষ কিছু উৎপাদন, সংস্কার, সেবা বা রক্ষণাবেক্ষণমূলক কাজ দিয়ে দেওয়া হয়– এই হলো প্রবেশন। 
মাগুরার একজন জেলা জজ কাকে যেন ছয় মাসের সাজা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। সাজা ছিল, বৃদ্ধ বাবা-মায়ের সেবা করা, বাগান করা এবং কতটা গল্পের বই পড়েছে সেটা এসে প্রতি সপ্তাহে রিপোর্ট করা। তাঁর মেধাকে বিবেচনায় আনা, তাঁকে কিছু মানসিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে নিতে চেষ্টা করা– এই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। v

আরও পড়ুন

×