মনের মণিকোঠায় জমা অমূল্য রতন

সুলতানা কামাল
সুলতানা কামাল, সভাপতি, মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)
প্রকাশ: ১৬ জুন ২০২৪ | ১০:২৮ | আপডেট: ২৪ জুন ২০২৪ | ১৮:১৯
বাবার কথা বলতে অথবা লিখতে গেলে চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। পরম ধৈর্যশীল অথচ নীতিতে অটল এই মানুষটি শেষ দিন পর্যন্ত গভীর দায়িত্বশীলতার সঙ্গে জীবনের দায় মিটিয়ে গেছেন। আমার ঘনিষ্ঠজনদের একজনের ভাষায়, ‘তিনি ছিলেন প্রথম শ্রেণির বাঁচোয়া’; যিনি জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত যাপন করেছেন নীতিনিষ্ঠতার সঙ্গে। পেছন ফিরে তাকালে দেখতে পাই আমরা সন্তানেরা তাঁর জন্য প্রায় কিছুই করার সুযোগ পাইনি।
আমার বাবা কামালউদ্দীন আহমদ খানের জন্ম ১৯০৭ সালে চট্টগ্রামে। প্রয়াত হয়েছেন মাত্র ৭০ বছর বয়সে ১৯৭৭ সালে। আমার মা সুফিয়া কামাল তাঁকে অভিহিত করেছেন নিজের জীবনের ‘হিমালয়’ বলে। প্রকৃতপক্ষে তিনি তো হিমালয় ছিলেন আমাদের পরিবারের সবার জন্য এবং অবশ্যই পরোক্ষভাবে দেশের সব মানুষের জন্য। তিনি যদি অসীম মমতায়, সম্মান ও দৃঢ়তার সঙ্গে এবং আকাশছোঁয়া ঔদার্যে পাশে না দাঁড়াতেন, আমাদের মায়ের পক্ষে সব মানুষের সুখ-দুঃখে এমন নিবিড় আর বিশালভাবে সহায় হওয়া হয়ে উঠত কিনা সন্দেহ। সাহিত্যিক আবুল ফজল তাঁর ‘চতুরঙ্গ’ গ্রন্থে সুফিয়া কামালের প্রতিভাকে বিন্দুমাত্র খাটো না করেই লিখেছেন, ‘সুফিয়া কামাল যে সুফিয়া কামাল হয়ে উঠেছেন তার পিছনে কামালউদ্দীন আহমদ খানের অবদান অনস্বীকার্য।’ যে কথা মা নিজেও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করে গেছেন। সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক কামালউদ্দীন খান ত্রিশের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। স্বদেশি আন্দোলনের প্রতি আনুগত্যের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সমাপনান্তে নোয়াখালীতে আনন্দ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের কাজ বেছে নেন। কিছুকাল সেখানে কাজ করে তিনি কলকাতায় চলে যান চাকরি নিয়ে। যদিও পেশা হিসেবে বেছে নেন হিসাবরক্ষণ। কলকাতায় তিনি যুক্ত হন ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’-এর সঙ্গে। ছাত্রাবস্থা থেকেই তিনি ‘শিখা গোষ্ঠী’র নবীন সদস্য হিসেবে সাহিত্যচর্চায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। তাঁর বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধগুলো তখনই বিদ্বজ্জনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এক পর্যায়ে ‘বুলবুল’ পত্রিকার সম্পাদনাতেও সহায়তা করেন তিনি। কলকাতায়ই তাঁর পরিচয় ঘটে সুফিয়া এন হোসেনের লেখালেখির সঙ্গে। ১৯৩৯ সালে সুফিয়া আর কামালউদ্দীনের পরিণয়। স্বেচ্ছায় অভিজাত পারিবারিক সুযোগ-সুবিধা ছেড়ে দেওয়া এ দম্পতির জন্য জীবন ছিল সংগ্রামমুখর। সুফিয়ার সাহিত্য প্রতিভা ও সামাজিক অঙ্গীকারের প্রতি কামালউদ্দীন খান এতটাই শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, যে কোনো অবস্থাতেই যেন সুফিয়ার কাজে বিন্দুমাত্র ব্যাঘাত না ঘটে, তা নিশ্চিত করতে নিজে আর সাহিত্যচর্চা অব্যাহত রাখতে পারেননি।
সাতচল্লিশের আগ পর্যন্ত কলকাতা আর বর্ধমানে চাকরিজীবন কাটিয়ে ভারতভাগের পর অক্টোবরে ঢাকায় চলে আসেন সুফিয়া কামাল এবং কামালউদ্দীন। ততদিনে তারা চার সন্তানের জনক-জননী। তাঁদের প্রথম আবাস ১৩ নম্বর অভয় দাস লেনের তারাবাগে। সেই বাড়িতে জন্ম আমাদের দুই বোনের। আমরা হলাম তিন বোন, তিন ভাই– মোট ছয়জন। আমাদের একটু ভালো থাকা, মানসম্পন্ন পড়ালেখা আর সাহিত্য, সংস্কৃতি, সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে পরিচিত থাকার জন্য কী অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন বাবা। বই পড়া, গান শোনা, সংগীত-নৃত্য-নাটক সম্পর্কে আগ্রহী হওয়া, এমনকি রাজনীতি সচেতন হতেও বাবার উৎসাহ এবং সহযোগিতা আমাদের সামনে খুলে দিয়েছিল এক অন্য জগতের দ্বার। আমাদের ভাইবোনদের নিজস্ব একটা পাঠাগার ছিল। বাবা তার নাম দিয়েছিলেন ‘মনিমঞ্জুষা’। গাছপালা, পুকুর আর বিশাল মাঠঘেরা ওই বাড়িতেই জন্ম কচি-কাঁচার মেলা, ছায়ানট আর বিভিন্ন মহিলা সমিতির। ১৯৬১ সালে ধানমন্ডিতে নিজ বাড়িতে এসে উঠি আমরা। প্রতিদিন বিভিন্ন মানুষের আনাগোনা, আলোচনা সভায় মিলিত হওয়া আমাদের বাড়িতে। অবশ্য মা-ই ছিলেন সেই প্রতিষ্ঠানগুলোর পুরোভাগে; কিন্তু তাঁর পেছনে অটল সমর্থন দিয়ে গেছেন বাবা। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ষাটের দশকের সাংস্কৃতিক স্বাধিকার ও অসাম্প্রদায়িক সর্বজনীন শিক্ষা আন্দোলন, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী ও আইয়ুববিরোধী আন্দোলন– সবকিছুর সঙ্গেই সুফিয়া কামাল ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তার ধাক্কা এসে লাগে কামালউদ্দীন খানের গায়েও। চাকরিতে তাঁর পদোন্নতি আটকে রাখা হয় পঁচিশ বছর। সামরিক শাসকেরা প্রস্তাব দেন স্ত্রীকে এসব থেকে সরিয়ে আনলে তৎক্ষণাৎ পদোন্নতি ঘটবে। তাঁর উত্তর ছিল– ‘আমি একজন স্বাধীন মানুষকে বিয়ে করেছি। তাঁর সিদ্ধান্তের ওপর আমার তো কোনো এখতিয়ার নেই।’ অতএব একই পদে থেকে যেতে হলো অবসর গ্রহণ পর্যন্ত।
একাত্তরে আমাদের পুরো পরিবার মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। দেশের ভেতরে তাঁর সুচিন্তিত পরামর্শ আমাদের পদক্ষেপগুলো কতটা কার্যকর হতে সহায়ক হয়েছে এবং তাঁর পাশে থাকাতে আমরা কতটা নিরাপদ বোধ করেছি আমার মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুরা তা অকুণ্ঠচিত্তে স্মরণ করে থাকেন।
তিনি আমাদের সাধারণ কিন্তু সৎ জীবন যাপনের কথা বলেছেন সবসময়। তাঁর অনেক স্মরণীয় কথার মধ্যে মনে পড়ে– ‘সাধারণের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পারলে অসাধারণ হওয়া যায় না।’ অর্থাৎ হঠাৎ করে বিনা পরিশ্রমে কিছু অর্জন করা যায় না, তার জন্য প্রয়োজন হয় প্রতিটি পর্যায়ে নিষ্ঠা আর সম্মানের সঙ্গে পার হওয়া। অনুপার্জিত বা অসৎ উপায়ে অর্জিত যে কোনো কিছু, তা হোক অর্থ, যশ, খ্যাতি, অবস্থান বা সম্মান– এটি যে কতটা মূল্যহীন এবং অবাঞ্ছনীয়, আমাদের পথ চলার প্রতিপদে তিনি স্মরণ করিয়ে দিতেন। আমাদের ব্যক্তিগত অভ্যাস বা চিন্তার ক্ষেত্রেও সমাজে তার কী প্রতিঘাত হতে পারে চিন্তা করতে বলতেন। সমাজে যারা অবহেলিত, উপেক্ষিত, তাদের প্রতি তাঁর ছিল অসীম সহমর্মিতা। বাসুদেব ধোপা, নিয়মিত পনির বিক্রি করতেন যিনি আমাদের কাছে, নানা পণ্যের ফেরিওয়ালা– অনেকেই আমাদের বাড়ি এসে বারান্দায় শুয়ে-বসে বিশ্রাম নিয়ে, কিছু না হলে একটু রুটি-চা খেয়ে পথে বেরিয়ে পড়তেন। বাবা সাধারণত সেই বারান্দায় বসে খবরের কাগজ বা বই পড়তেন। বাবার সঙ্গে তারা নানা সুখ-দুঃখের কথা বলে যেতেন। আমরা শাড়ি কিনতে ফেরিওয়ালার সঙ্গে দরদাম করছি শুনলে বলতেন, ‘বাজারে যেতে হলে তো রিকশা ভাড়া দিয়ে সময় লাগিয়ে শাড়ি কিনতে। এ বেচারা মাথায় বোঝা নিয়ে বাড়ি বয়ে হাতের কাছে তোমাদের শাড়ি এনে দিচ্ছে, ওকে তো তোমাদের বেশি দাম দেওয়া উচিত।’ এমনই ছিল বাবার ন্যায়পরায়ণতার বোধ।
আরও কত কথা যে বাবার সম্পর্কে বলা যায়, কিন্তু বলা হলো না; হয়তো হবেও না। আমাদের মনের মণিকোঠায় জমা হয়ে আছে অমূল্য রতনের মতো। সক্রিয় রাজনীতিতে বাবার আগ্রহ ছিল না, তবে সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের প্রতি পক্ষপাতিত্ব ছিল। প্রশ্ন করেছিলাম আমার নামটা সুলতানা রাখা হলো কেন? উত্তর পেয়েছিলাম, বেগম রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ থেকে। বলেছিলেন, তেমন সমাজের স্বপ্ন তিনিও দেখেন এবং তাঁর কন্যাও যেন সেই স্বপ্ন দেখে এবং সে মতে কাজ করে। আমার অটোগ্রাফ গ্রন্থে বাবার লেখা– ‘তোমার নাম দিলাম সাহসিকা, বিমল ভালে জ্বলুক জয়টীকা’; সেটাই বাবার আশীর্বাণী ছিল আমার প্রতি, আমাদের প্রতি, আমাদের সব ভাইবোন এমনকি দেশের সব তরুণের প্রতি– আমরা যেন সাহসী হই, জয়ী হই; কিন্তু শর্ত হলো জয়টীকা পেতে নিজের কপাল রাখতে হবে বিমল, অসৎ কিংবা মলিন হতে পারবে না।
বাবা দিবসে আমার বাবা কামালউদ্দীন আহমদ খানকে জানাই গভীর শ্রদ্ধা আর অতলান্ত ভালোবাসা।
- বিষয় :
- বাবা