ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

হাসিখুশি, সহজ-সরল মানুষ

হাসিখুশি, সহজ-সরল মানুষ

মা, বাবা ও বোনের সঙ্গে নাজলী লায়লা মনসুর

নাজলী লায়লা মনসুর, চিত্রশিল্পী

প্রকাশ: ১৬ জুন ২০২৪ | ১০:৩৬ | আপডেট: ২৪ জুন ২০২৪ | ১৮:২৮

আমি আমার বাবাকে ‘আব্বা’ ডাকতাম আর ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করতাম। সে যুগে প্রায় সব পরিবারে এটিই চালু ছিল। আমি ছিলাম আমার বড় দুই ভাইবোনের দশ-বারো বছরের ছোট। তাই সবার খুব আদরের। আব্বার তো বটেই। আমার আব্বার নাম হাবিবুর রহমান।

আব্বা খুব কষ্ট করে চাষবাস করে, গরু চরিয়ে লেখাপড়া চালিয়ে গেছেন। আমাদের গ্রামের নাম কোয়ালিপাড়া। এটি রাজশাহীর বাগমারা উপজেলায়। ওই গ্রামে কোনো স্কুল ছিল না। আব্বা নদী সাঁতরে তাহেরপুর গঞ্জের স্কুলে পড়তে যেতেন। পরীক্ষায় ভালো ফল করতে পারায় সেখানকার জমিদারের সহায়তায় রাজশাহী কলেজে পড়তে যান। সেখানে জায়গির থেকে লেখাপড়া করতে থাকেন। তখন থেকেই তিনি ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখতে থাকেন। সে সময় ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ছিল কলকাতার কাছে শিবপুরে। অর্থসম্পদহীন এক বালকের এমন ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন যে কীভাবে পূরণ হলো, তা এক বিস্ময়ের গল্প। কুকুর কামড়ে দেওয়াতে তিনি কলকাতায় যাওয়ার সুযোগ পান। জলাতঙ্ক রোগের ইনজেকশন নেওয়ার জন্য সে যুগে কলকাতায় যেতে হতো, যার জন্য ব্রিটিশ সরকার ১৪ দিনের ইনজেকশন ও কলকাতা যাওয়া-আসা, থাকা-খাওয়ার খরচ দিত। এভাবেই আব্বার কলকাতায় যাওয়ার স্বপ্ন পূরণ হলো এবং শিবপুরের খবর নেওয়াও হলো।  

আব্বা হাসিখুশি এবং সহজ-সরল মানুষ ছিলেন। তিনি সবার কাছেই খুব পছন্দের ছিলেন। আমাদের বাসার দরজা সবার জন্যই খোলা ছিল। বলাই বাহুল্য, আমার আম্মার আকর্ষণীয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং কর্মঠ হওয়ার গুণেই সেটি সম্ভব হয়েছিল। কোনো ব্যাপারেই আমরা আব্বা-আম্মার কোনো আপত্তির সম্মুখীন হইনি।

আব্বা কোনোদিন আমাদের কাছে জীবনসংগ্রামের কথা বলেননি। আমার বিয়ের পর আব্বার ডায়েরি পড়তে দিলেন আম্মা। তা পড়ে আমরা যেমন মুগ্ধ হলাম, তেমনি গর্বিত বোধ করলাম। আমার স্বামী আবুল মনসুর চমৎকার প্রচ্ছদ এঁকে ‘আমার জীবন’ শিরোনামে গ্রন্থ আকারে সেই ডায়েরি প্রকাশ করলেন। বাংলার অধ্যাপক ও বিশিষ্ট ভাষাতাত্ত্বিক ভূঁইয়া ইকবাল সেখানে চমৎকার এক ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন। দুঃখের বিষয় হলো, আমার আম্মা তা দেখে যেতে পারেননি। সড়ক দুর্ঘটনায় অনেক আগেই তিনি মারা যান। আব্বার মৃত্যুর আগে আম্মাবিহীন সাতটি বছর আমরা আব্বার হাসিখুশি মুখ আর দেখিনি। তিনিও এক রাতে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে শ্বাসকষ্ট নিয়ে ক্লিনিকে গেলেন, সকাল হতেই ওপারে চলে গেলেন। আব্বা-আম্মা কেউই আমাদের কোনো সেবা দেওয়ার সুযোগ দেননি, কেবল আমাদের দিয়েই গেছেন।
 

আরও পড়ুন

×