ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

বন্যায় নারীর দুর্ভোগ

বন্যায় নারীর দুর্ভোগ

ছবি:: সাজ্জাদ নয়ন

 লাবণী মণ্ডল

প্রকাশ: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২৩:৪৫

সম্প্রতি দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে হওয়া বন্যায় গোটা প্রকৃতি, পরিবেশ আক্রান্ত হয়েছে। ফেনী ও নোয়াখালী জেলার ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ বন্যায় গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৪৮ শতাংশ বাড়িঘর প্রায় ধসে পড়েছে। এ ছাড়া এ দুই জেলার পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা ও সুপেয় পানির সুবিধা শতভাগ অচল হয়ে পড়েছে। এবারের বন্যা নিয়ে অক্সফাম বাংলাদেশ প্রকাশিত প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
যে কোনো দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় নারী ও শিশু। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। এ নিয়ে নানান শ্রেণিপেশার মানুষের মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে। বিভিন্ন সংস্থা উদ্যোগ নিয়েছে–শিশুদের ডায়াপার, পোশাক এবং নারীর জন্য স্যানিটারি ন্যাপকিনের ব্যবস্থা করতে। বিশেষ করে অন্তঃসত্ত্বা নারীর ঝুঁকি বেশি থাকে। তারা সবসময় অনিরাপত্তায় ভোগেন। অনাগত সন্তানকে সুস্থভাবে পৃথিবীতে আনার চিন্তা ও শঙ্কা রয়েছে তাদের মধ্যে। এ রকম দুর্যোগময় সময়ে তাদের নিরাপত্তার তেমন কোনো ব্যবস্থা থাকে না।
আমরা দেখেছি, বন্যা চলার সময়ে পৃথিবীতে এসেছে সুন্দর ফুটফুটে শিশু। যাদের বাঁচানোর জন্য এগিয়ে গিয়েছেন সেনা সদস্যসহ বিভিন্ন সংস্থার লোকজন। তবুও যেন ভয় কাটেনি, আশঙ্কায় রাত পার করেছে ওই পরিবারগুলো। এমনই এক পরিবারের সদস্য ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার ছালেহা বেগম (২৮)। তিনি জানান, আকস্মিক এক বন্যায় শিশুর জন্মের জন্য যে যুদ্ধ তিনি করেছেন, তা কোনোদিন ভুলবেন না। ২৯ আগস্ট তাঁর কোলজুড়ে আসে পুত্র সন্তান, এটি তাঁর দ্বিতীয় সন্তান। হঠাৎ পানি বেড়ে যাওয়ায়, এক প্রতিবেশীর বাড়িতে তিনিসহ পরিবারের অন্যরা ছাদে আশ্রয় নেন। সেখানে বিশুদ্ধ খাবার পানির অভাব ছিল। তার ভেতরে ভয় বসে যায়, নিজেকে সুস্থ রাখার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও তিনি পারেননি, শেষ পর্যন্ত তাঁকে উদ্ধারকর্মীরা উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান। এ দৃশ্য বর্ণনা করতে গিয়ে বারবার থেমে যাচ্ছিলেন। এরকম দুবির্ষহ কোনো দিন যাতে মানুষের জীবনে না আসে এটাই তাঁর চাওয়া।
নারী ও শিশুর কথা ভেবে মেহমানখানার আসমা আক্তার লিজা পুরোনো কাপড় সংগ্রহের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দেন। সেখানে ব্যাপক সাড়া পান এবং সেই কাপড়গুলো পৌঁছে দেন ফেনীতে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ফেনীর দৃশ্যপট অবর্ণনীয়। মানুষগুলো দিশেহারা। তাদের জন্য আমরা কাজ করছি। বিশেষ করে নারী ও শিশুরা সবচেয়ে বিপদগ্রস্ত অবস্থায় রয়েছে। নবাগত শিশুর জন্য কাঁথা এবং পুরোনো কাপড়ের ব্যবস্থা করেছি, যা পেয়ে তারা সত্যিই খুশি।’
ব্যক্তি উদ্যোগে অনেকেই বনাক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। বন্যার্ত নারীর জন্য বিশেষভাবে কাজ করার চেষ্টা করছেন অনেকেই। অনেকেই প্রয়োজনীয় পোশাক-আশাক, শিশুর জন্য ডায়াপার, শিশুখাদ্য, স্যানিটারি ন্যাপকিন সংগ্রহ করছেন। এরপর যেসব প্রতিষ্ঠান উপদ্রুত এলাকায় যাচ্ছে, তাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন।
ফেনীর চৌদ্দ বছরের কিশোরী সালমা জানান, ‘আমরা সবাই মিলে মসজিদে আশ্রয় নিয়েছিলাম। সেদিনই আমার বড় বোনের দেড় মাসের বাচ্চার খিচুনি এবং জ্বর হয়, আমরা দিশেহারা হয়ে যাই। কিন্তু কোথাও যাওয়ার মতো অবস্থা নেই, পাগলপ্রায় অবস্থা। আমার বোন বারবার মূর্ছা যাচ্ছিল, ওখানের আশ্রয় নেওয়া সবাই সাহস দিচ্ছিল কিন্তু দেড় মাসের বাচ্চা যখন এভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে, তখন আমাদের আশা করার কিছু ছিল না।’ তিনি আরও বলেন, ‘এদিকে আমার পিরিয়ড হয়ে যায়; কিন্তু কারও কাছে কোনো অতিরিক্তি কাপড় বা প্যাড ছিল না। এছাড়া মা-বোন বলতে থাকেন, মসজিদ ঘর অপবিত্র হয়ে যাবে, আমি খুব ভেঙে পড়ি। এর মধ্যে পেটে আমার অনেক ব্যথা হয়, যে ব্যথার জন্য কোনো ওষুধও ছিল না।’ তিন দিন পর সেখান থেকে উদ্ধার করা হয় পরিবারটিকে।
ত্রাণ কাজে জড়িতরা বলছেন, নারী, শিশুসহ প্রত্যেক মানুষের নিরাপদ খাদ্যব্যবস্থা এবং কর্মসংস্থানের জন্য চেষ্টা চালাতে হবে; যাতে খাবারের অভাবে কোনো শিশু মারা না যায়। যথাযথ পুষ্টির দিকেও নজর দিতে হবে। কোনো মানুষ যাতে ডায়রিয়া, কলেরা বা এ ধরনের কোনো রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা না যায়। বিশেষ করে শিশুখাদ্য এবং অন্তঃসত্ত্বা নারীর প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে।
বন্যার শুরু থেকেই যারা বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে জরুরি সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনা করেছে; তারা এখন দুর্গত এলাকায় বিশুদ্ধ খাবার পানি, শুকনো খাবার, খাবার স্যালাইন, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ ও মোবাইল চার্জিং স্টেশনের সহায়তা দিচ্ছেন। এখন ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে ভেঙে পড়া ঘরবাড়ি পুনর্নির্মাণ, নিরাপদ পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী প্রদান ও খাদ্য সরবরাহ করার কাজে নিয়োজিত রয়েছে বিভিন্ন সংগঠন। তবে বন্যার্তদের তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি প্রয়োজন মেটাতে আরও বেশি সহায়তা দরকার বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। v
 

আরও পড়ুন

×