ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

বিশ্ব প্রবীণ দিবস

জীবন সায়াহ্ন কাটুক আনন্দে

জীবন সায়াহ্ন কাটুক আনন্দে

ছবি:: আনোয়ার শামীম

 দ্রোহী তারা

প্রকাশ: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ১০:৫৪ | আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ১৬:৫৮

‘আমাদের দেশের সংস্কৃতির একটা অংশ বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। নানা-নানি, দাদা-দাদির সঙ্গে নাতি-নাতনিদের খুনসুটি, তাদের কাছ থেকে শেখা; বাবা-মা শাসনের সঙ্গে যে আদর-আবদার পূরণের ভরসার স্থল হয়ে ওঠে, সেটি থেকে এখনকার প্রজন্ম দূরে সরে যাচ্ছে।’ এভাবেই অনেকটা আক্ষেপের সুরে বাংলার পারিবারিক সংস্কৃতির সুদিনের কথা বলছিলেন বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জড়াবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানের পরিচালক (অ্যাডমিন) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. লোকমান আলী।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর এক মাস হলো তিনি এই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পেয়েছেন। মো. লোকমান আলী বলেন, ‘১ অক্টোবর প্রবীণ দিবস। দিবসটি ঘিরে বিশেষ আয়োজনের পরিকল্পনা রয়েছে। এই জায়গায় আমি আসার পর এখানকার অধিবাসীদের সঙ্গে আমি কথা বলেছি। আসলে আলাদা করে তেমন কিছু বলার নেই। কেউ স্বেচ্ছায় নিজ পরিবার ছেড়ে তো এসে থাকেন না এখানে। প্রত্যেকেরই আলাদা আলাদা গল্প আছে এখানে এসে থাকার। তারা এখনও যেভাবে মনের শক্তির জোরে আনন্দে দিনাতিপাত করছেন, সেটি দেখে মনের জোর বাড়ে।’

পশ্চিমা দেশগুলোতে বৃদ্ধাশ্রমের প্রচলন অনেক আগে থেকেই ছিল, কারণ সেখানে একক পরিবারের সংস্কৃতি দীর্ঘদিন ধরেই প্রচলিত। পরবর্তী সময়ে এই ধারণা এশিয়া ও অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৯০-এর দশক থেকে বাংলাদেশে বৃদ্ধাশ্রমের প্রচলন শুরু হয়, যেখানে বয়স্ক ব্যক্তিরা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সরকারি ও বেসরকারি সহায়তায় নিরাপদ আশ্রয় ও সেবা পেয়ে থাকেন। আগারগাঁও প্রবীণনিবাস ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জায়গায় ব্যক্তি উদ্যোগেও গড়ে উঠেছে অনেক বৃদ্ধাশ্রম। এখানে প্রতিটি ঘরে লুকিয়ে আছে কিছু না বলা আনন্দ-বেদনার গল্প।

সেই মানুষগুলো যারা কখনোই তাদের জীবনের অংশ ছিল না; কিন্তু এখন একাকী জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকা শহরের ব্যস্ত জীবন থেকে খানিক দূরে আগারগাঁও এলাকায় অবস্থিত এটি যেন এক ছোট্ট পৃথিবী; যেখানে জীবনের শেষপ্রান্তে এসে বয়স্ক মানুষেরা খুঁজে পান শান্তি, নিরাপত্তা ও যত্ন– ‘প্রবীণনিবাস, আগারগাঁও’, যা ঢাকার অন্যতম সরকারি বৃদ্ধাশ্রম হিসেবে পরিচিত।

প্রবীণনিবাসে সবার জন্যই বাজার ও রান্নার সুব্যবস্থা রয়েছে। তবুও নিজেই বাজার করে, রান্না করে, নিজের কাজ যতটুকু সম্ভব নিজেই করেন শামসুন্নাহার শেলী। বর্ণাঢ্য কর্মজীবন ও পুরো দেশ ঘুরে বেড়ানো শেলী বিগত ১১ বছর ধরে এখানে আছেন নিজের ইচ্ছায়। তিনি পরিবার থেকে সরে এসে এখানে স্বাধীনভাবে দিনাতিপাত করছেন। তিনি বলেন, ‘এই প্রজন্মের একটা ভালো দিকনির্দেশনা প্রয়োজন। এই প্রজন্ম কাজ করছে, ওদের বুদ্ধি ভালো আছে। কিন্তু একটা সঠিক দিকনির্দেশনা ওদের জন্য খুবই দরকার। এর অভাবে ছেলেমেয়েরা বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। বাবা-মায়ের ভেতর ভয় কাজ করে, যদি শাসনের ফলে আরও বেশি বিগড়ে যায় সন্তান। কিন্তু আমার মনে হয় কিছু ব্যালান্স প্রয়োজন। আদর, শাসন, সঠিক দিকনির্দেশনা পেলে ওরা আরও বেশি ভালো করবে।’ 
এ প্রবীণনিবাসে ১৫ জন নারী ও ১২ জন পুরুষ রয়েছেন। তাদের সবার বয়স ৬০ বছরের বেশি। দূর থেকে দেখলে একটি পরিবার মনে হয়। যত কাছে যাওয়া যায়, ততই স্পষ্ট হয়ে ওঠে প্রত্যেকের এখানে আসার পেছনের গল্পগুলো, তাদের জীবনবোধ ও চিন্তার জায়গা। 

তেমনিভাবে জীবনবোধের কথা বলছিলেন রাশিদা জামান। সাদা চুলের সদা হাস্যোজ্জ্বল এই ৮৮ বছর বয়সী নারীর জীবনে সম্পূর্ণ থলেটাই অর্জনে পরিপূর্ণ। জীবনে অর্থের মোহ নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান থেকে সবকিছু তিনি নিজের চোখে দেখেছেন। সত্য ও ন্যায়কে জীবনের সাথী বানিয়ে চলেছেন। অধ্যাপক ড. মনিরুজ্জামানের জীবনসঙ্গিনী রাশিদা জামান বলেন, ‘প্রবীণদের অতীত জানতে চাও তোমরা। কিন্তু এই আমি এখন আছি, বর্তমানে বেঁচে আছি। তোমরা জানো মানুষ কেন বুড়ো হয়। কারণ সে তখন আশ্রয় চায়। আশ্রয়টা রাষ্ট্রের দেওয়া উচিত। পৃথিবীর সবখানে এটি আছে। কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ, সেটি ইতিহাস বলবে। আমি কী করে বলব? আমি অবস্থাগুলোর ভেতর দিয়ে গেছি। একটা সুঁই-সুতোর মতো। কাঁথা পরে সেলাই হয়েছে। নানান রঙের সুঁতো দিয়ে গাঁথা। ইতিহাস জানা এত সহজ নয়। প্রবীণনিবাসে বসবাসকারীদের স্পৃহা ও শক্তি গ্রামের একজন মানুষের মধ্যেও আছে। আমি এই প্রজন্মকে সবকিছু জানতে বলব, জ্ঞান যত আহরণ করবে, তত বেশি সমৃদ্ধ হবে।’ 

আরও পড়ুন

×