ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

গণঅভ্যুত্থান

নারীর স্বীকৃতি নিয়ে প্রশ্ন

নারীর স্বীকৃতি নিয়ে প্রশ্ন

‘ক্ষুব্ধ নারীসমাজ’-এর ব্যানারে গত ২১ সেপ্টেম্বর ‘গণঅভ্যুত্থান ও নারী প্রশ্ন’ শীর্ষক এক সংলাপের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে সমাজের নারী প্রতিনিধিরা অংশ নেন। উপস্থিত ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের দুই উপদেষ্টা ফরিদা আখতার ও শারমীন মুরশিদ

লাবণী মণ্ডল

প্রকাশ: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ১০:৫৬ | আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ১৭:১৯

পৃথিবীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া ঘটনাবলিতে নারীর অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে। অথচ প্রতিটি আন্দোলন, সংগ্রাম বা বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে নারীর কথা ভুলে যেতে দেখা যায়। চলতি বছরের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নতুন ইতিহাস রচনা করেছে। এবারও নারীর অবদান এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সচেতন নারীসমাজ এ নিয়ে প্রশ্ন তুলছে, নিজেদের অভিমত ব্যক্ত করছে। লিখেছেন লাবণী মণ্ডল

‘সংস্কারের অনেক কমিশন হচ্ছে কিন্তু নারী অধিকার কমিশন, শ্রমিক অধিকার কমিশন গঠনের কোনো খবর নেই’– এ রকম স্লোগান ধারণ করে ‘ক্ষুব্ধ নারীসমাজ’-এর ব্যানারে গত ২১ সেপ্টেম্বর ‘গণঅভ্যুত্থান ও নারী প্রশ্ন’ শীর্ষক এক সংলাপের আয়োজন করা হয়।

অনুষ্ঠানে আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী শিক্ষার্থী, শিক্ষক, শিল্পী, থিয়েটার অ্যাক্টিভিস্ট, আলোকচিত্রী, চিকিৎসক, নার্স, আইনজীবী, সাংবাদিক, যৌনকর্মী, গার্মেন্ট শ্রমিক, নারী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, শহীদ ও আহতদের অভিভাবকসহ সমাজের বিভিন্ন অংশের নারী অংশগ্রহণ করেন। আলোচনা সভায় উপস্থিত ছিলেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার এবং সমাজকল্যাণ ও মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমিন মুরশিদ। রাজধানীর তোপখানা রোডের ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির দ্বিতীয় তলায় সাগর-রুনি হলে এ আলোচনা সভা সঞ্চালনা করেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ঋতু সাত্তার। প্রারম্ভিক বক্তব্য পাঠ করেন নারীগ্রন্থ প্রবর্তনার সীমা দাস সীমু।

উপস্থিত বক্তারা বলেন, জুলাই-আগস্ট মাসের ছাত্র-শ্রমিক-জনতার স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অর্জিত গণঅভ্যুত্থান আমাদের নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখার সাহস দিয়েছে। নতুন রাজনৈতিক পরিবেশে পুরুষতন্ত্রের শৃঙ্খল ভেঙে নারী-পুরুষসহ সবার জন্য মর্যাদাপূর্ণ নতুন বাংলাদেশ গড়ার আকাঙ্ক্ষা দানা বেঁধেছে। পুলিশের গুলির সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো একজন আবু সাঈদ হয়ে ওঠেন ২০২৪ সালের মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রামের প্রতীক। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব লিঙ্গ-জাতি-ধর্মের মানুষকে দায়বদ্ধ করেছেন আবু সাঈদ।

সাঈদের মতো শহীদের পেছনে থাকা সেই মায়েরা ছিলেন এই আন্দোলনের সৈনিক। সব বাধা-ভয় পেরিয়ে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে আন্দোলনকে গণঅভ্যুত্থানের রূপ দিয়েছেন। অন্যায়, অবিচার ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতি সমর্থন-সংহতি জানায় সাধারণ জনগণ। 

নারীর অধিকার বাস্তবায়নে রাষ্ট্র ও সংবিধানের সংস্কার আবশ্যক। বক্তারা আরও বলেন, সংস্কারের অনেক কমিশন হচ্ছে কিন্তু নারী অধিকার কমিশন, শ্রমিক অধিকার কমিশন গঠনের কোনো খবর নেই। বিদ্যমান সংবিধান নারীকে অধিকার দিয়েছে জনজীবনে; কিন্তু পারিবারিক অধিকার, সম্পত্তির অধিকার রয়ে গেছে যার যার ধর্মের অধীনে। নারীর মতামত রাষ্ট্র গঠনের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। তাই সংবিধানে নারী অধিকার নিয়ে যে দুর্বলতা ও বৈষম্য রয়েছে, তা দূর করতে সংস্কার আবশ্যক। আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সামিনা লুৎফা, আলোকচিত্রী তসলিমা আখতার, নিউইয়র্কের কোলগেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নাভিন মুরশিদ, ব্যারিস্টার সাদিয়া আরমানসহ আরও অনেকে।

ফরিদা আখতার বলেন, ‘‘গণঅভ্যুত্থানের পর ‘ক্ষুব্ধ নারীসমাজ’-এর নামটি পরিবর্তন করব কিনা প্রশ্ন এসেছিল, আমি বলেছি– না, পরিবর্তন করার সময় হয়নি। সময় তো মাত্র দু’মাস, এর পরের সময়গুলো আমাদের দেখতে হবে। একটা জায়গায় আমি ধাক্কা খেয়েছি, ছেলেরা সমন্বয়ক হলো কিন্তু নারীর খবর নেই। নুসরাত তাবাসসুমকে অনেকেই জানেন, সে ডিবি অফিসে আটক ছিল। এর পরও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় কিন্তু নুসরাত তাবাসসুমকে পাওয়া যায়নি। অনেক কমিশন হচ্ছে, কাওয়ালি হয়েছে, সবখানে পুরুষ; আমাদের দেশে কি কোনো যোগ্য নারী নেই? আমি অবাক হয়ে যাই! এই যে নারীরা বিভিন্ন জায়গায় নেই; এটা কিন্তু একটা বড় সমস্যা। প্রতিটি আন্দোলন বা বিপ্লবের পর প্রথমে আমরা ভুলে যাই নারীকে; ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পরও এটা হতে যাচ্ছে। কিন্তু এখনও আমাদের সময় আছে। নানাভাবে পুরুষতান্ত্রিক শব্দের মধ্যে আমরা পড়ে যাই, এখন আমাদের প্রতিবাদ জারি রাখতে হবে।’’ তিনি আরও বলেন, ‘বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যাদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, সেখানে নারীর ৫০ শতাংশ নিয়োগ দিতে হবে। তারা যে বলেন নারী নেই, এটা ঠিক নয়।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হতাহত ব্যক্তিদের পরিবারের জন্য নির্ধারিত ৫ লাখ ও ১ লাখ টাকা সহায়তা নিয়ে কথা বলেন সরকারের উপদেষ্টা শারমীন মুরশিদ। তিনি বলেন, ‘এটি সূচনা মাত্র। আরও সহায়তা তহবিল হবে। একই সঙ্গে সরকারের পরিকল্পনায় আহতদের কর্মসংস্থানে ফিরিয়ে আনা হবে।’

মানবাধিকারকর্মী ও নারী অধিকারকর্মী জাকিয়া শিশির বলেন, ‘২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে নারীর বিশাল ভূমিকা ছিল। নারী শিক্ষার্থীরা সামনে এগিয়ে গিয়ে আগলে রেখেছেন পুরুষ শিক্ষার্থীদের। অভ্যুত্থানের পর এই নারীদের আর খুঁজে পাওয়া যায়নি; কিন্তু কেন। এ নিয়ে আমাদের উদ্বিগ্নতা আছে, এখনই সময় নারীর এ ব্যাপারগুলো গুরুত্ব দেওয়ার। বিভিন্ন জায়গায় নারীকে নিয়োগ দিতে হবে। প্রতিবারের মতো এবার নারীর অবদান বিলীন হতে দেওয়া যাবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই অভ্যুত্থানে অনেক মা রাস্তায় নেমে এসেছেন, রান্না করে সন্তানকে খাইয়ে আন্দোলনে পাঠিয়েছেন, পানি নিয়ে রাস্তায় নেমে গেছেন। কিন্তু তাদের কথা নেই কেন– তার মানে নারীকে খাটো করে দেখা বা আড়াল করে রাখা হচ্ছে। ক্ষুব্ধ নারীসমাজের মধ্য দিয়ে এই কথা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে পৌঁছে দিতে চাই।’

গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত সচেতন ব্যক্তিত্ব ফেরদৌসি রিতা বলেন, ‘আমরা প্রত্যেকেই জানি, যে কোনো আন্দোলনে নারীর অগ্রণী ভূমিকা থাকে। ২০২৪ সালের কোটা আন্দোলনের প্রথমদিন থেকেই নারীর ভূমিকা ছিল। ১৩ জুলাই থেকে আমি মাঠে থেকেছি, নানানজনের সঙ্গে এ নিয়ে মতবিনিময় করেছি– রামপুরা থেকে শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত। ১৫ তারিখে আমি সরাসরি দেখেছি যে, রামপুরায় প্রচুর নারী শিক্ষার্থী রাস্তায় নেমেছে। কলেজ, স্কুল, পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েরা পুরো আন্দোলনে শুধু অগ্রণী ভূমিকা পালন করেনি, ফ্রন্টলাইনে ছিল।’ তিনি আরও জানান, ‘নারী শিক্ষার্থীদের অন্যরা বলছে যে, এখন আক্রমণ হতে পারে, তোমরা পিছিয়ে যাও। তখন মেয়েরা বলছে যে, আমরা ফ্রন্টলাইনে থাকব। কারণ, তাহলে মারতে এলে হেজিটেট ফিল করবে। এ আন্দোলন তো সবার। এই মেয়েরা কিন্তু রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল না। অনেক মেয়ে আহত হয়েছে, নিহতও হয়েছে। হাসপাতালে গিয়ে দেখেছি, অনেক মেয়ে আহত হয়ে ভর্তি ছিল। ৫ আগস্ট সবকিছু পরিবর্তন হলো; এরপর মেয়েদের নিয়ে তেমন কোনো ভাবনা নেই। কোনো নারীর উপস্থিতি নেই, এটার ইমপ্যাক্ট এখন আমরা দেখছি। দেখবেন যে, ধানমন্ডিতে একজন পর্বতারোহী নারীকে আক্রমণ করল, টি-শার্ট পরা মেয়েকে আক্রমণ করছে; এগুলো কিন্তু নারীর অংশগ্রহণ না থাকার কারণে ঘটছে। সমন্বয়কদের মধ্যে দুই-তিনজন মেয়ে যদি ফ্রন্টলাইনে, দায়িত্বে থাকত; তাহলে কিন্তু ওরা আক্রমণের আগে ভাবত। এটা যদি এখনই সমাধান না হয়; তাহলে এর ভয়াবহ প্রভাব আমাদের ওপর পড়বে।’

নারীমুক্তির কথা বলতে হলে এ বিষয়গুলো নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম জারি রাখতে হবে। একুশ শতকে এসেও নারীর এ সংকট আমাদের ভাবায়। যেসব সংকটের মূলে আঘাত করার মধ্য দিয়েই একমাত্র পরিবর্তন সম্ভব।

আরও পড়ুন

×