নারীর পোশাক ও সিদ্ধান্ত: অধিকার কার?

অলংকরণ :: বোরহান আজাদ
দ্রোহী তারা
প্রকাশ: ১২ অক্টোবর ২০২৪ | ২৩:৪৭ | আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০২৪ | ১৩:৫৩
শাড়ি পরা, টিপ বা ওড়না নিয়ে সম্প্রতি নারীদের কটূক্তি করা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কেউ কেউ নারীর পোশাক নিয়ে সামাজিক শালীনতার দোহাই দেন, আবার কেউ ধর্মের নামে নারীর ওপর নিজেদের ইচ্ছা চাপিয়ে দিতে চান। বিশ্লেষকদের মতে, সমাজে নারীকে নিয়ন্ত্রণের যে মনোভাব, সেটিই এই আগ্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য দায়ী...
‘এক মাস ধরে আমাকে যতবার শুনতে হয়েছে– কেন আমি ওড়না পরি না, ওড়না কই, বেশরম; তা আমার সারাজীবনেও শুনতে হয়নি’– হতাশভাবে কথাগুলো বলছিলেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদে কর্মরত নারী দোলা (ছদ্মনাম)।
ক্ষুব্ধ এই নারী আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হোক বা না হোক; মেয়েরা গোটা পৃথিবীতেই নির্যাতিত হয়ে এসেছে, হচ্ছে। মুখ বুজে সহ্য করতে হয় ঘরে-বাইরে আমাদের। মুখ খুললেই হয় মার খেতে হবে বা মেরেই ফেলবে। আমি সব সময় ঢোলা কুর্তা-পায়জামা পরতে অভ্যস্ত। আমাকে এখন কেউ কটূক্তি করে গেলে গায়ে লাগে না। যেখানে বোরকা পরিহিত নারীও বাদ যায় না কটূক্তি থেকে, সেখানে আমার আর কী-ই বা হতে পারে।’ কথাগুলো বলে দোলা ব্যাগ থেকে একটা ওড়না বের করে গলায় ঝুলিয়ে হেঁটে রাস্তা পার হয়ে যান।
শাঁখারীবাজারে কলেজছাত্রী কুসুম বন্ধুদের সঙ্গে পূজা দেখতে এসেছেন। বারংবার তিনি নিজের পোশাক-শাড়ি টেনেটুনে ঠিক করায় ব্যস্ত। তাঁর বন্ধুরা জানান, খুব হাসিখুশিভাবে ঘুরতে বেরোলেও রাস্তায় কিছু বিকৃত রুচির মানুষ শাড়ি পরা নিয়ে অশালীন মন্তব্য করে। এতে কুসুমের মন খারাপ হয়ে গেছে। এর পর থেকেই ও নিজের পোশাকের ব্যাপারে বেশি সচেতন হয়ে এমন করছে।
ওপরের দুটি ঘটনা বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। এ রকম হাজারো ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটে আসছে আমাদের সমাজে। সাম্প্রতিক সময়ে নারীর সঙ্গে ‘কটূক্তি’র বিষয়টি বেশি ঘটছে। হরহামেশাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ বিষয়ে বিভিন্ন পোস্টের পাশাপাশি আমাদের আশপাশের পরিচিত নারীদের মুখেও এ রকম পোশাককেন্দ্রিক বিব্রতকর পরিস্থিতির কথা শোনা যাচ্ছে। নারীর সঙ্গে ঘটা এ ধরনের ঘটনার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা বলেন, ‘নারীর পোশাক, চলাফেরা নিয়ে কথা বলা আমাদের সমাজে নতুন কিছু নয়। অনেক আগে থেকেই এটা হয়ে আসছে। বাংলাদেশে মেয়েদের জামাকাপড় কী হবে, মেয়েরা কেমন করে চলবে– এ বিষয়ে বলে দেওয়া হচ্ছে। আমরা হয়তো ভাবতে পারি যে, আন্দোলন-সংগ্রামের সময়টুকুতে এই প্রশ্নগুলো ওঠেনি, এখন এসব কথা উঠছে কেন। এর কারণ হলো– সমাজটা এ রকমই। এর আগেও এ রকম হতো। মেয়েরা চলাচল করতে গেলে এ রকম বিপদেই তারা পড়ত। বিপদটা যারা ঘটাত, তখন তারা হয়তো একটা বিশেষ দলের ছিল। সে জন্য তারা পার পেয়ে যেত। ধর্ষণ, হত্যা, যৌন নিপীড়ন, রাস্তাঘাটে কটূক্তি করে পার পেয়ে যেত। প্রতিটি নিপীড়নের ক্ষেত্রেই যারা ক্ষমতার সঙ্গে থাকে, তারা পার পেয়ে যেত।’
এ প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক শরমিন্দ নীলোর্মি বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থানে নারী-পুরুষ সবার অংশগ্রহণ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ৫ আগস্টের পর যত সময় যাচ্ছে, নারী শিক্ষার্থীদের ভূমিকাকে অস্বীকার করার একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। সমন্বয়ক হিসেবে নারী শিক্ষার্থীদের অবস্থান কম গুরুত্ব পাচ্ছে। এটা বাস্তবতা। এরপর পাবলিক পরিসরে বেশ কিছু নারী হেনস্তার ঘটনা সামনে এসেছে। এর পেছনে দুটি কারণ থাকতে পারে। এক. পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বর্তমান বাস্তবতা ঘোলাটে করা এবং দুই. নারীকে এই বিদ্বেষের জায়গা থেকেই অনেকে দেখেন। আইনশৃঙ্খলার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তারা হয়তো নিজের ভেতরের বিদ্বেষটুকু উগরে দিচ্ছেন।’
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার সঙ্গে তাৎক্ষণিক কিছু পদক্ষেপ নেওয়া দরকার বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, ‘সমাজের মধ্যে বিদ্যমান নারীবিদ্বেষী অবস্থানে পরিবর্তন আনতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা থাকতে হবে। কীভাবে সচেতনতা বাড়াতে হবে, শিক্ষাক্রমে কীভাবে তা যুক্ত করা হবে– এগুলো দীর্ঘমেয়াদি বিষয়। আমাদের আগামী প্রজন্ম যেন এসব ঘৃণা-বিদ্বেষ নিয়ে বড় না হয়, সে জন্য দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ আবশ্যক। তবে এখন কিছু জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। এর মধ্যে একটি হলো, একটি পরিষ্কার বার্তা দেওয়া যে জনপরিসরে কেউ যদি নারী হওয়ার কারণে হেনস্তার শিকার হন, তাহলে কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে। দ্রুত বিচারের আওতায় এনে এমন কিছু শাস্তির উদাহরণ থাকলে কেউ নারীকে হেনস্তা করতে অন্তত দ্বিতীয়বার ভাববে। নারী-পুরুষের সব ক্ষেত্রে সমানাধিকার একটি মীমাংসিত বিষয়। এ নিয়ে কোনো ধরনের বৈষম্য যেন আমরা না দেখি। এতে কোনো আলোচনার বিষয় নেই। এই বার্তাটা দেওয়া খুব জরুরি। আমাদের সামনে অনেক বিতর্কিত ও কঠিন চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আমরা প্রতি পদে সেসবে আত্মনিয়োগ করতে গিয়ে বাধাগ্রস্ত হবো, যদি মীমাংসিত বিষয় নিয়ে অহেতুক প্রশ্ন তোলা হয়।’
নিপীড়নের বিপরীতে প্রতিরোধের জন্য নারীদেরই এগিয়ে আসতে হবে বলে মনে করেন সামিনা লুৎফা। তিনি বলেন, ‘যখনই, যেখানে এই নিপীড়নমূলক ঘটনা ঘটবে, সেখানেই নিপীড়কের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হবে। প্রতিরোধ করতে হবে। সেটাকে থামানোর চেষ্টা করতে হবে। গণঅভ্যুত্থানে জয়লাভের পর অন্য কোনো কাজ বাকি নেই; সব অন্য কেউ করে দেবে, বিষয়টা এমন নয়। অধিকার নারীকে লড়াই করেই আদায় করতে হবে। আমাদের আগে নারীরা লড়াই করে গেছে, আমরা করছি বর্তমানে; ভবিষ্যৎ প্রজন্মও করবে। মনে রাখতে হবে, আমাদের লড়াই করে যেতে হবে। কেউ আমাদের লড়াইটা করে দেবে না। যে কোনো নারীর যদি মনে হয়, তার নারী পরিচয়ে বৈষম্য হচ্ছে, নিপীড়ন হচ্ছে, সেটা তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিবাদ করতে হবে। একদিনে সব বদলাবে না। আমাদের আচরণ, প্রতিবাদ, প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে এটাকে বদলাতে হবে।’
- বিষয় :
- নারী
- নারীর ক্ষমতায়ন
- নারী বিদ্বেষী