ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

জর্ডানে ফিলিস্তিনিদের শরণার্থী জীবন

তবুও বাড়ি ফেরার আকুতি...

তবুও বাড়ি ফেরার আকুতি...

গাজায় জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরের প্রধান রাস্তা, ৬ এপ্রিল ১৯৫৭; ছবি : এপি

 সোহেল সুপান্থ

প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২৪ | ২৩:৩৭ | আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০২৪ | ১১:৩২

ইসরায়েলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন-গুরিয়ন মনে করতেন, ১৯৪৮ সালে জায়নবাদী মিলিশিয়াদের আক্রমণে সহিংসভাবে নিজভূমি থেকে বিতাড়িত কয়েক লাখ ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করা ‘নাকবা’ বা মহাবিপর্যয়ের স্মৃতি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ম্লান হয়ে যাবে। ১৯৪৯ সালে ইসরায়েল গঠনের এক বছর পর তিনি বলেছিলেন, ‘বৃদ্ধরা মারা যাবে আর তরুণরা ভুলে যাবে।’ এটি এমন একটি ভবিষ্যদ্বাণী, যা জর্ডানের রাজধানী আম্মানে বসবাসকারী ওমর ইহসান ইয়াসিন এবং তৃতীয় প্রজন্মের ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের আনন্দ দেয়। 

একসময় জাফা থেকে পাঁচ কিলোমিটার পূর্বে সালামাহে তার দাদা-দাদির পাথরের বাড়ি ছিল। এখন সেটি তেল আবিবের অংশ। ওই বাড়ির পুরোনো আমলের একটি মোটা চাবি হাতে ওমর বলেন, ‘আমরা ফিরে আসব, আমি নিশ্চিত।’ এই চাবি ফিলিস্তিনি পরিচয় ও গর্বের প্রতীক। এটি ওমরের চশমার দোকানে প্রদর্শনীর জন্য রাখা আছে।

ওমরের বাবা ইহসান মোহাম্মদ ইয়াসিন শ্রদ্ধার সঙ্গে জাফার কিছু মাটি তুলে এনেছিলেন। মাটিসহ স্মৃতিচিহ্নের একটি বড় সংগ্রহ রয়েছে। প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় (মে ১৯৪৮ থেকে জানুয়ারি ১৯৪৯ সাল) এই পরিবারের বাড়িটি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। ৫৮ বছর বয়সী ইহসান জানান, ‘চাবিটি উত্তরাধিকার হিসাবে রয়ে গেছে। সেই সঙ্গে এটি প্রতিরোধের প্রতীক; যা আমাদের ফিরে আসার অধিকার ধারণ করে।’ ইহসান তার সারাজীবন আল-ওয়েহদাতে বসবাস করেছেন, দক্ষিণ-পূর্ব আম্মানের হায় আল-আওদাহ শহরতলিতে অবস্থিত এটি এক ব্যস্ত ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবির। এখানে প্রায় ৬২ হাজার ফিলিস্তিনির বাস। নাকবার পর কয়েক হাজার ফিলিস্তিনি শরণার্থীর বসবাসের জন্য জর্ডানে স্থাপিত চারটি শরণার্থী শিবিরের একটি। এই শিবিরের বেশির ভাগ ফিলিস্তিনির মতো ইহসানেরও গোটা জীবন এখানেই কেটেছে; কিন্তু এখনও তারা স্বপ্ন দেখেন স্বদেশে ফিরে যাওয়ার। এটিকে একটি অস্থায়ী সমাধান হিসাবে দেখেন তারা।

ইহসান তাঁর মায়ের বরাত দিয়ে বলেন, জায়নবাদী মিলিশিয়া সংগঠন হাগানাহ গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। তাদের সুখস্মৃতি সহিংসতায় পরিণত হয়। তিনি একটি হাঁটার লাঠি বের করেন, যা ছিল তাঁর মায়ের। সেখানে ‘উম্মি’ (আমার মা) শীর্ষক একটি গানের কথা খোদাই করা। ইহসানের ২৮ বছর বয়সী মেয়ে আসিল ইয়াসিন তাঁর বাবা ও ভাইয়ের সঙ্গে ওই গানে যোগ দেন। এই চাবি, লাঠি, গান– সবই তাদের প্রতিরোধের অংশ।

জর্ডানে এখন প্রায় ২০ লাখ ফিলিস্তিনি শরণার্থীর বাস; যাদের মধ্যে প্রায় তিন লাখ ৭০ হাজার এখনও শিবিরে বাস করে। শরণার্থী শিবিরের সংখ্যাগরিষ্ঠ ফিলিস্তিনির মতো ইহসান কখনও ফিলিস্তিনে নিজ ভূখণ্ডে যেতে পারেননি। 

নাকবার পর মিসরীয় সেনাবাহিনী গাজা উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ নেয় আর জর্ডানের সেনাবাহিনী পূর্ব জেরুজালেমসহ পশ্চিম তীরে প্রবেশ করে। নাকবা চলাকালে ইসরায়েল যখন এই অঞ্চলগুলো দখল করে, তখন পশ্চিম তীর থেকে জর্ডানে পালিয়ে যাওয়া ফিলিস্তিনিদের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছিল। যারা গাজা থেকে এসেছিল তাদের তা দেওয়া হয়নি। কারণ, মিসর ছিটমহল নিয়ন্ত্রণ করছিল এবং গাজা থেকে আগতরা বিদেশি বাসিন্দা হিসেবে বিবেচিত হন। তারা জর্ডানের নাগরিকদের প্রদত্ত অধিকার এবং পরিষেবা থেকে বাদ পড়েন। জর্ডানে ছয় লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনির এখনও নাগরিকত্ব নেই, তাদের বেশির ভাগই নাকবার পর গাজা উপত্যকা থেকে নিবন্ধিত হন।

মূল বাড়ি জাফা হলেও ইয়াসিনের পরিবার গাজা উপত্যকা থেকে ১৯৪৯ সালে বাস্তুচ্যুত হওয়ার কারণে নিবন্ধিত হয়। তাদের কাছে জর্ডানের অস্থায়ী পাসপোর্ট রয়েছে, যা অস্থায়ী এবং পুনঃনবায়ন করতে হয় এবং নিয়মিত পাসপোর্টের চেয়ে বেশি খরচ করতে হয়। ওই পাসপোর্টে আরও উল্লেখ করা আছে, তারা গাজার ফিলিস্তিনি। তার মানে তাকে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েল-নিয়ন্ত্রিত চেকপয়েন্ট অতিক্রম করতে দেওয়া হবে না।

৫৪ বছর বয়সী আলি আল-মাশায়েখের একটি রেস্তোরাঁ আছে। আম্মানের ব্যস্ত বাণিজ্যিক কেন্দ্র আল-বালাদে অবস্থিত ওই রেস্তোরাঁয় ঐতিহ্যবাহী ফিলিস্তিনি খাবার পরিবেশন করা হয়। এর ডিসপ্লেতেও মোটা, জীর্ণ চাবির ছবি রয়েছে। এই চাবিটি একসময় তারই ছিল। দখলীকৃত পশ্চিম তীরের শহর হেবরনের কাছে মাটির ইটের তৈরি একটি বাড়ি ছিল তাদের। এখন সেখানে একটি ইসরায়েলি কোম্পানির কারখানা রয়েছে। জর্ডানে সফল রেস্তোরাঁ ব্যবসা ফেলে তিনি এখনও নিজভূমে ফিরতে চান। জানান, যদি তার পরিবার হেবরনে ফেরার সুযোগ থাকে; তবে হৃদস্পন্দনের বিনিময়ে হলেও তিনি তা করতে চান।

আরও পড়ুন

×