ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

সংগ্রাম ও সাফল্যের পথচলা

সংগ্রাম ও সাফল্যের পথচলা

ছবি:: আরিফুল হক

তানজিলা মুস্তাফিজ

প্রকাশ: ০৬ এপ্রিল ২০২৫ | ০০:৫১ | আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০২৫ | ১৭:০৩

নারী শুধু গৃহকর্মে সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ নন, তারা পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি। বিশেষ করে নারী অভিবাসীরা প্রবাসের অচেনা পরিবেশে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজেদের ভাগ্য গড়ে তোলেন এবং দেশে ফিরে নতুন উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তারা শুধু নিজেদের জন্য নয়, বরং পরিবারের জন্য, সমাজের জন্য এবং দেশের অর্থনীতির জন্য অবদান রাখেন।

একজন নারী যখন স্বপ্ন দেখেন, তখন সেই স্বপ্ন কেবল ব্যক্তিগত নয়, তা হয়ে ওঠে একটি পরিবারের, একটি সমাজের, এমনকি একটি জাতির ভবিষ্যৎ গঠনের অংশ। বিদেশে কঠোর শ্রমের মাধ্যমে অর্জিত সাফল্যকে দেশে কাজে লাগিয়ে যারা নতুন কিছু করার সাহস দেখান, তারাই প্রকৃত উদ্যোক্তা। এই গল্প শুধু একজন নারীর নয়, এটি হাজারও সংগ্রামী নারীর অনুপ্রেরণার গল্প।

সেই সাহসী নারীদেরই একজন সানজিদা, যার জীবন-সংগ্রাম শুধু কষ্টের নয়; এটি এক অনন্য জয়ের কাহিনি। কঠোর পরিশ্রম আর আত্মবিশ্বাসের মাধ্যমে জীবনের বাধাগুলো অতিক্রম করেছেন, হয়েছেন সফল। 

কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া গ্রামের মেয়ে সানজিদা। শৈশব পেরোনোর আগে সংসারের বন্ধনে জড়িয়ে যান। তখনও জীবনের মানে বোঝার সময় হয়নি, তবু কপালে জুটেছিল বউ হওয়ার গুরুদায়িত্ব। স্বপ্ন দেখা তো দূরের কথা, এক অজানা ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। পরিবারের অবস্থা ছিল নড়বড়ে, তাই লেখাপড়ার অধিকারও পাওয়া হয়নি। বিয়ের কয়েক বছর পর পৃথিবীতে এলো তাঁর সন্তান। সেই আলোও বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।

সন্তানের বয়স যখন মাত্র এক বছর, তখনই ঝড় নেমে এলো জীবনে। ছেলের বাবা তাঁকে একা ফেলে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলেন। এক মুহূর্তে যেন পৃথিবী শূন্য হয়ে গেল। একা এক নারী, কোলে এক বছরের শিশু–কোথায় যাবেন? কী করবেন?

স্বজনেরা মুখ ফিরিয়ে নিল, কেউ পাশে দাঁড়াল না। বেঁচে থাকার সংগ্রাম তখন যেন আরও কঠিন হয়ে উঠল। বাধ্য হয়ে জীবনের কষ্টগুলো গিলে ফেলে শহরের পথে পা বাড়ালেন। গার্মেন্টসে কাজ নিলেন। কঠোর পরিশ্রমে নিজেকে টিকিয়ে রাখার লড়াই শুরু করলেন।

তবে সানজিদা শুধু হারানোর গল্প নয়, তিনি এক অদম্য লড়াকুর নাম। যে জীবনের যত কঠিন আঘাতই আসুক, সন্তানকে বুকের মধ্যে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে পথ চলতে জানেন। সমাজের চোখে তিনি হয়তো এক সাধারণ নারী, কিন্তু তাঁর ভেতরের শক্তি অসীম।

গার্মেন্টসে পাঁচ বছর ধরে পরিশ্রম করার পর সানজিদা নতুন স্বপ্ন দেখলেন বিদেশ যাওয়ার, ভাগ্য পরিবর্তনের। ২০১৫ সালের শেষের দিকে তিনি পাড়ি জমালেন জর্ডানে, হাতে মাত্র ১৮ হাজার টাকা বেতনের চাকরি। অচেনা দেশ, অজানা ভাষা, নতুন পরিবেশ– সবকিছুই চ্যালেঞ্জিং। তাঁর সংকল্প ছিল অটুট। কঠোর পরিশ্রম আর মনের জোরের ফলে মাত্র তিন মাসের মাথায় তাঁর ভাগ্য বদলাতে শুরু করেন। দক্ষতার প্রমাণ দিয়ে তিনি কোয়ালিটি কন্ট্রোলার হিসেবে পদোন্নতি পেলেন, বেতন বেড়ে হলো ৪০ হাজার টাকা। 

২০২১ সালে আবার এক কঠিন মুহূর্ত এলো তাঁর জীবনে। তাঁর মা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। মাকে একা রেখে বিদেশের মাটিতে থাকা সম্ভব ছিল না। তাই সব ছেড়ে তিনি দেশে ফিরে এলেন। দেশে ফিরে তিনি নতুন করে স্বপ্ন দেখলেন, নতুন পথ খুঁজলেন। নিজের সঞ্চিত অর্থ দিয়ে একটি বস্ত্রালয় চালু করলেন, যেখানে আজ তাঁর অধীনে কাজ করছেন ৮ জন কর্মী। শুধু তাই নয়, জায়গা কিনে গড়ে তুলেছেন নিজের বাড়ি, একটি স্থায়ী আশ্রয়, যা শুধু ইট-পাথরের কাঠামো নয়, এটি তাঁর পরিশ্রম আর আত্মনির্ভরতার প্রতীক।

আরও পড়ুন

×