সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিতে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন জরুরি

হিল্লোল চৌধুরী
প্রকাশ: ২৫ মে ২০২৫ | ২২:৪৪
সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘জন্মসনদ তাঁর প্রাপ্য, যে কোনো সময়, যে বয়সেই হোক, তাঁকে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। কী করতে হবে, সৃজনশীল হতে হবে। এটা থেকে আমাদের নিয়ম বের করতে হবে।’ এই আহ্বান নাগরিক সমাজ ও সরকারি সংস্থাগুলোর চলমান জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন কার্যক্রমে নতুন গতি আনছে বলে মনে করা হচ্ছে।
জন্ম নিবন্ধন প্রতিটি শিশুর মৌলিক অধিকার এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক সুরক্ষায় প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। তবে বাস্তব ক্ষেত্রে অনেক সময় মানুষ প্রক্রিয়াগত জটিলতা এবং তথ্যের অভাবে নিবন্ধন করতে ব্যর্থ হন। এই প্রেক্ষাপটে বৃহস্পতিবার (২২ মে) ঢাকায় ‘জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন প্রক্রিয়া বিষয়ে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের সঙ্গে জ্ঞান বিনিময় কর্মশালা’ অনুষ্ঠিত হয়। নারী মৈত্রী ও ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের যৌথ উদ্যোগে এবং গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটরের (জিএইচএআই) সহায়তায় আয়োজিত এই অর্ধদিবস কর্মশালায় স্থানীয় সরকার বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক, সচিব, প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, প্রধান সমাজকল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন কর্মকর্তা, ওয়ার্ড-ভিত্তিক নিবন্ধক এবং সংশ্লিষ্ট সিভিল রেজিস্ট্রেশন কর্মকর্তারা অংশগ্রহণ করেন। স্থানীয় সরকার কর্মকর্তাদের সঙ্গে বর্তমান জাতীয় নীতি ও আইনি কাঠামো সম্পর্কে আলোচনা এবং মাঠ পর্যায়ের চ্যালেঞ্জ এবং সুপারিশ নিয়ে সরাসরি মতবিনিময় ছিল এই কর্মশালার মূল উদ্দেশ্য।
কর্মশালায় নারী মৈত্রীর নির্বাহী পরিচালক শাহীন আক্তার ডলি বলেন, ‘জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন কেবল একটি প্রশাসনিক প্রক্রিয়া নয়, এটি নাগরিকের অধিকার প্রতিষ্ঠার পথ। এই উদ্যোগ মাঠ পর্যায়ে সরকারের কার্যকারিতা ও জনগণের আস্থা বাড়াতে সহায়ক হবে। আমি মনে করি এই ক্ষেত্রে সিভিল সোসাইটি প্রতিষ্ঠানগুলোও সরকারের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করতে পারবে।’
গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটরের কান্ট্রি লিড মুহাম্মদ রুহুল কুদ্দুস বলেন, ‘বাংলাদেশে প্রায় ৭০ শতাংশ জন্ম স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে ঘটে; কিন্তু জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন, ২০০৪ এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রাথমিক তথ্যদাতা হিসেবে স্বীকৃতি না দেওয়ায় অনেক জন্ম নিবন্ধিত হয় না। এই অপূর্ণতা শিশুর আইনগত পরিচয় দান বিলম্বিত করে, ফলে তারা শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। আমরা বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ জানাই যেন আইনটি সংশোধন করে স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রাথমিক তথ্যদাতা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, যাতে প্রতিটি শিশুকে জন্ম থেকেই গণনা ও সুরক্ষার আওতায় আনা যায়।’
কর্মশালায় নারী মৈত্রী কর্তৃক ‘নাগরিক নিবন্ধন ব্যবস্থা (সিআরভিএস) ও এর গুরুত্ব’ এবং ‘সরকারি উদ্যোগ ও সুপারিশ’ নিয়ে কারিগরি অধিবেশন পরিচালিত হয়। ভাইটাল স্ট্র্যাটিজিস-এর বাংলাদেশের কান্ট্রি কোঅর্ডিনেটর মো. নজরুল ইসলাম ‘বাংলাদেশে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন: নীতি ও চর্চা’ শীর্ষক প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, ‘২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে অনূর্ধ্ব এক বছর বয়সী শিশুর জন্ম নিবন্ধন হয়েছে ৫ শতাংশ এবং একই সময়ে মৃত্যুর এক বছরের মধ্যে নিবন্ধন হয়েছে ৯ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে টাস্কফোর্সের নিয়মিত সভা অনুষ্ঠান এবং স্বাস্থ্য বিভাগের সাথে নাগরিক নিবন্ধনের নিবিড় সংযোগ অত্যন্ত জরুরি।’
কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীগণ মতবিনিময়ের মাধ্যমে মাঠপর্যায়ে কর্মরতরা বাস্তব অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন এবং নিবন্ধন প্রক্রিয়াকে আরও সহজ, স্বচ্ছ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করার জন্য করণীয় বিভিন্ন পদক্ষেপের পরামর্শ দেন। তারা উল্লেখ করেন, সরকারি অফিসে পর্যাপ্ত রিসোর্সের অভাব রয়েছে, যা কাজের গতি ব্যাহত করে। মাঠপর্যায়ে তারা প্রতিনিয়ত যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন, সে সম্পর্কে সরকার সরেজমিনে তথ্য সংগ্রহ করলে বাস্তবভিত্তিক নীতিনির্ধারণ সম্ভব হবে। নিজেদের সমস্যাগুলো জানানোর বা মত প্রকাশের সুযোগও তারা পান না বলে আক্ষেপ করেছেন কেউ কেউ।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ইমরুল কায়েস চৌধুরী বলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে যথাযথ নির্দেশনা পেলে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের সমস্যাগুলোর সমাধান স্বাস্থ্য বিভাগ দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে দুর্নীতির সব সুযোগ এখনই বন্ধ করতে হবে।’
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের উপ-প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মো. ইমদাদুল হক বলেন, ‘যার জন্ম নিবন্ধন, তিনি নিজে বা তার অভিভাবক এসে নিবন্ধন কার্য সম্পন্ন করবেন। এ ছাড়া, বিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে সব জায়গায় শিশুর বয়সের মানদণ্ড একই রকম করতে হবে।’
এই কর্মশালার মাধ্যমে সিভিল সোসাইটি প্রতিষ্ঠান ও মাঠ প্রশাসনের মধ্যে একটি কার্যকর সংযোগ তৈরি হবে এবং ভবিষ্যতে তা নাগরিক নিবন্ধন ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে সহায়ক হবে বলে সংশ্লিষ্টদের প্রত্যাশা।
- বিষয় :
- সিআরভিএস
- জন্ম নিবন্ধন
- মৃত্যু নিবন্ধন
- কর্মশালা