ঢাকা বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫

‘আজুরা’ ও শান্তা কবীর

‘আজুরা’ ও শান্তা কবীর

শান্তা কবীর

আফরোজা চৈতী

প্রকাশ: ২২ জুন ২০২৫ | ০০:৫০ | আপডেট: ২২ জুন ২০২৫ | ১৫:৪৮

শান্তা কবীর একজন মা, একজন স্ত্রী, একজন উদ্যোক্তা। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি সফল একজন মানুষ। একজন নারীর পরিচয়ের গণ্ডিতে তিনি কখনও নিজেকে আবদ্ধ রাখতে চাননি; বরং একজন সফল মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে চেয়েছেন। একমুঠো উজ্জ্বল হাসি ছড়িয়ে পঞ্চাশোর্ধ্ব বলে দাবি করা যে মানুষটি আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন, তিনি যে সম্প্রতি ছেলে বিয়ে দিয়ে শাশুড়ি হয়েছেন এটি ভাবলেই অবাক লাগে। জানালেন, গত ২০ বছরে তিল তিল করে ‘আজুরা বাই শান্তা কবীর’ গড়ে তোলার পেছনে যে মানুষটা সবসময় সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে গেছেন, তিনি তাঁর জীবনসঙ্গী। তিনি বলেন, ‘একজন বেগম রোকেয়া তৈরি হওয়ার পেছনে যেমন একজন সাখাওয়াত হোসেন ছিলেন, তেমনি আমার আজকের আমি হয়ে ওঠার পেছনে একজন কবীরের অনেক বড় অবদান।’ মিরপুর-১২ নম্বরে একটি দারুণ আউটলেট আছে শান্তা কবীরের। তিনি জানান, বহুবার তাঁর এ ব্যবসা মুখ থুবড়ে পড়েছে। প্রতিবারই তিনি তাঁর জীবনসঙ্গীর অনুপ্রেরণা আর নিজ পরিশ্রম ও চেষ্টায় ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। মাত্র এক হাজার টাকা দিয়ে শুরু করা ব্যবসা আজ কোটি টাকার বেশি।

শান্তা কবীর বলেন, ‘এত সহজ নয় নিজের একটি ব্যবসা দাঁড় করানো– শুধু পরিবারের সহযোগিতা বা জীবনসঙ্গীর আবেগীয় দক্ষতার সাপোর্ট ছাড়াও যা লাগে সেটি হলো নিজের পরিশ্রম, সততা আর দেশের প্রতি ভালোবাসা।’

দেশের প্রতি ভালোবাসার কথা শুনে কিছুটা অবাকই লাগল। তিনি তা বুঝতে পেরে বলেন, ‘আমার দেশ আমার মা, আমার দেশের জল-হাওয়া আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, দেশ আমার শিকড়। দেশ যদি না বাঁচে, দেশের পণ্য যদি না বাঁচে তবে আমি কি বাঁচতে পারব? আর দেশ তো আমার প্রকৃতির বাইরে নয়।’ জানালেন, এ কারণেই তিনি পরিবেশবান্ধব ন্যাচারাল ডাই, হ্যান্ডলুম তাঁতের কাপড়, প্রাকৃতিক রঙের টাইডাই, কলাগাছের তৈরি সুতার কাপড়– এসব নিয়ে কাজ করছেন।

খাবারকে শান্তা কবীর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুষঙ্গ ভাবেন। সেই সঙ্গে তাঁর কারখানায় কাজ করা প্রত্যেক শ্রমিকের জন্য রয়েছে স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থা। কিন্তু আজকের এ অবস্থানে আসার পেছনে কঠোর পরিশ্রমের গল্প, বারবার ঠকেও তাঁর ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প যখন করছিলেন এক ফাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম– কী করে সুস্থ থেকেছেন? শুধু তো শারীরিক স্বাস্থ্য নয়, বরং মানসিক স্বাস্থ্যও খুব গুরুত্বপূর্ণ। তিনি জানালেন, নিয়মিত মেডিটেশন আর ইয়োগা করেন। নিজের শরীর, মন, আত্মাকে তিনি এক সূত্রে গেঁথে নিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি দিনের প্রতিটি মুহূর্ত কাজে লাগাতে পারেন। আরেকটি কাজ তিনি করেন, সেটি হলো দক্ষতা, জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা কাজে লাগান নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে, যারা নিজেরাই নিজেদের ক্ষেত্রে আরও দক্ষ ও যোগ্য হয়ে উঠতে পারেন। তিনি একা চলায় বিশ্বাস করেন না; বরং আরও শত শত উদ্যোক্তা গড়ে তুলতে চান।

এ উদ্যোক্তা বলেন, ‘বহু বহুদিন এমন হয়েছে আমি চিৎকার করেছি, রাগ হয়েছে, ক্ষোভে ফেটে পড়েছি, যেখানে কবীর কিছুই হয়তো জানে না। কিন্তু সে সারাদিন অফিস শেষে আমার সেই ক্ষোভ আর কষ্টের কথা ধৈর্য ধরে শুনেছে, আমি সঠিক না বেঠিক তা না দেখে আমাকে বোঝার চেষ্টা করেছে। সে আমাকে তৈরি হওয়ার পথে একজন স্বামী নয়; বরং একজন বন্ধু হিসেবে অটল, অনড় থেকেছে।’
একজন উদ্যোক্তার মূলধন কী? এমন প্রশ্নের জবাবে শান্তা কবীর বলেন, ‘টাকা নয়, সময়। আপনার হাতে ২৪ ঘণ্টা সময় থাকে আর এ ২৪ ঘণ্টাকে যদি ভাগ করেন শক্তি আর বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগিয়ে, তবে আপনার জয় নিশ্চিত। টাকা তো চলে যাবে; কিন্তু মেধা, দক্ষতা সঙ্গেই থাকবে। তাই সময়কে ব্যবহার করতে হবে নিজের সুস্থতা আর দক্ষতা বাড়াতে।’

নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য তাঁর পরামর্শ– ‘তাদের অবশ্যই দেশকে ভালোবাসতে হবে, দেশি পণ্য এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দক্ষতা এবং সাহস থাকতে হবে আর অবশ্যই নিজের সময়কে খুব হিসাব করে খরচ করতে হবে। একজন উদ্যোক্তা একজন শিল্পী। তাঁকে এই শিল্পচর্চাকে মনেপ্রাণে ধারণ করতে হবে। আরেকটি গুণ তাঁকে শিখতে হবে– টাকা দিয়ে কীভাবে টাকা তৈরি করতে হয়, সেই কৌশলটি শেখা জরুরি।’

বর্তমানে শান্তা কবীর যুক্ত আছেন ‘পাওয়ার অব শি’ নামক একটি অনলাইন উদ্যোক্তাদের সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে। সেখানে আরও নারী উদ্যোক্তাকে অনুপ্রেরণা দেওয়ার পাশাপাশি সংগঠনটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কাজ করছেন। তাঁর পোশাক দেশ ছাড়িয়ে পাড়ি জমাচ্ছে বিদেশের মাটিতে। চীন, রাশিয়া, আমেরিকা, নেদারল্যান্ডস, আরব আমিরাত, ইংল্যান্ডসহ অনেক দেশে পৌঁছে গেছে তাঁর সিগনেচার পোশাক ‘আজুরা বাই শান্তা কবীর’। তাঁর স্বপ্ন– বিদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে একদিন বাংলাদেশের কাপড় নিজ মহিমায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। কোনো দরিদ্র দেশ হিসেবে নয়, দুর্নীতির দেশ হিসেবে নয়; বরং আন্তর্জাতিক ফ্যাশনে বাংলাদেশের নাম উচ্চারিত হবে।

আরও পড়ুন

×