ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

নৌপথের পদে পদে কেন এত বাধা

নৌপথের পদে পদে কেন এত বাধা

.

সারোয়ার সুমন

প্রকাশ: ৩০ আগস্ট ২০২৪ | ২৩:৫২ | আপডেট: ৩১ আগস্ট ২০২৪ | ১৩:৩২

ক্রমেই বাড়ছে দেশের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম। বাড়ছে চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য ওঠানামার হারও। কিন্তু উল্টো পথে হাঁটছে বন্দর থেকে নৌপথে পণ্য  পরিবহনের কার্যক্রম। বন্দর থেকে নারায়ণগঞ্জের পানগাঁও টার্মিনালে গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরেই গেছে সর্বনিম্ন পণ্য।  এ বিষয়ে বিস্তারিত জানাচ্ছেন সমকাল চট্টগ্রাম ব্যুরোর রিজিওনাল এডিটর সারোয়ার সুমন

চট্টগ্রাম বন্দরে গত অর্থবছরে ২০ ফুট দীর্ঘ কনটেইনার ওঠানামা হয়েছে প্রায় ৩২ লাখ। চলতি অর্থবছরে এটি বাড়বে আরও। এ জন্য চাপ বাড়ছে মহাসড়কে। এ চাপ কমাতে হলে সক্ষমতা বাড়াতে হবে নৌপথের। কিন্তু বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে সেই পথে। গত পাঁচ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে নৌপথে পানগাঁও টার্মিনালে গড়ে ২৪ হাজার কনটেইনার আসা-যাওয়া করলেও সর্বশেষ অর্থবছরে কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে মাত্র ১০ হাজার ২৪০টি। বেসরকারি চারটি প্রতিষ্ঠান এ রুটে ১৭টি জাহাজ পরিচালনা করলেও পদে পদে বাধা পাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, নৌরুটে সক্ষমতা বাড়ানো হলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ওপর চাপ কমবে। কমে আসবে পণ্য পরিবহন খরচও।

নতুন উদ্যোগ
বন্যায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক সম্প্রতি অচল হয়ে পড়লে চট্টগ্রাম-পানগাঁও রুটে চলাচলকারী ১৭টি জাহাজ কোম্পানির প্রতিনিধিকে নিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষ জরুরি বৈঠক করে। বৈঠকে ১৭টি জাহাজের একটি শিডিউল প্ল্যান তৈরি করে দেওয়া হয়। এই শিডিউল অনুযায়ী জাহাজগুলোকে চলাচলের কড়া নির্দেশনা দেওয়া হয়। কোনো জাহাজ শিডিউল মিস করলে পরবর্তী জাহাজ ওই শিডিউলে প্রবেশ করে চলাচল করবে। এতে পানগাঁওয়ে আমদানি-রপ্তানি পণ্য পরিবহনে অনিশ্চয়তা থাকবে না। এ শিডিউল আগামী ছয় মাস বলবৎ থাকবে বলে গত 
সপ্তাহে জারি করা এক সার্কুলারে বলা হয়েছে। 

পদে পদে বাধার কথা বলছেন ব্যবসায়ীরা 
বন্দর কর্তৃপক্ষ নতুন উদ্যোগ নিলেও পানগাঁও টার্মিনাল থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয় বলে অভিযোগ করছেন ব্যবসায়ীরা। চারটি প্রতিষ্ঠানকে জাহাজ পরিচালনার অনুমোদন দেওয়া হলেও তারা নির্ধারিত সময় মেনে জাহাজ পরিচালনা করছে না। পথে পথে ডুবোচর থাকায় জাহাজ গন্তব্যে যায় অনেক দেরি করে। চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক জানান, অপেক্ষাকৃত ছোট জাহাজগুলো গড়ে ১০০ টিইইউএস কনটেইনার পরিবহন করতে পারে। বড় আকারের জাহাজগুলো পরিবহন করে ১৫০ টিইইউএস কনটেইনার। আবার জাহাজগুলো চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কনটেইনার নিয়ে পানগাঁও টার্মিনালে গেলেও ফিরতি পথে কোনো কনটেইনার পায় না। এতে জাহাজ পরিচালনার ব্যয় বাড়ছে। আছে হয়রানিও। ঢাকা ও আশপাশের এলাকার ব্যবসায়ীরা পানগাঁওয়ে পণ্য খালাস করতে চাইলেও কাস্টমস সেখানে হয়রানি করে বলে অভিযোগ উঠেছে। সেখানে একটি কনটেইনার গড়ে ৩০ থেকে ৪০ দিন সময় নিয়ে খালাস হওয়ার অভিযোগ করেছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের এমন অভিযোগ আমলে নিয়ে সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, দ্রুত পণ্য খালাসে প্রয়োজনীয় সব সহায়তা দেবে এনবিআর।

জাহাজ আছে ২১টি, সচল ১৭
চট্টগ্রাম-পানগাঁও রুটে চলাচলের জন্য নিবন্ধিত জাহাজ আছে ২১টি। এর মধ্যে কার্যক্রম চালাচ্ছে ১৭টি। এসব জাহাজের মধ্যে সর্বোচ্চ ১০টির 
স্থানীয় এজেন্ট হচ্ছে সি গ্লোরি। বিআইডব্লিউটিসির চারটি জাহাজের স্থানীয় এজেন্ট হচ্ছে ম্যাঙ্গো শিপিং লাইন। তিনটি জাহাজের লোকাল এজেন্ট নামিরা ফিরোজা। স্থানীয় এজেন্টরা এসব জাহাজ পরিচালনার জন্য বন্দর থেকে বার্থিং শিডিউল নেয়। বন্দরের সরাসরি অন্য কোনো হস্তক্ষেপ নেই এসব জাহাজ পরিচালনায়।

মাস্টার নিতে হয় বিআইডব্লিউটিএ থেকে
চট্টগ্রাম-পানগাঁও রুটে চলাচল করা জাহাজগুলো চালানোর জন্য মাস্টার নিতে হয় বিআইডব্লিউটিএ থেকে। এ প্রতিষ্ঠানের যুগ্ম পরিচালক আবদুস সবুর খান বলেন, ‘চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা রুটে চলাচল করা জাহাজ দুটি ধাপে পরিচালনা করেন মাস্টাররা। প্রথম ধাপে জাহাজ চট্টগ্রাম থেকে যায় জনতা বাজারসংলগ্ন চরগজারিয়াতে। সেখানে আবার মাস্টার পরিবর্তন হয়। চাঁদপুর থেকে নতুন মাস্টার ওই জাহাজ নিয়ে যান পরবর্তী গন্তব্যে। এই পয়েন্টে রুট দুই ভাগে বিভক্ত। যারা বাঘাবাড়ী, চাঁদপুর ও ভৈরবের দিকে যাবেন, তারা এক রুটে যান। আর যারা বরিশাল কিংবা খুলনার দিকে আসবেন, তারা যান অন্য রুট দিয়ে। দেশে এখন ৭০ থেকে ৮০টি জাহাজ চলাচল করলেও মাস্টার পাইলট মাত্র ৩৮ জন। এর মধ্যে আবার খণ্ডকালীন চুক্তিভিত্তিক আছেন ১২ জন। মাস্টারের এই সংকটের কারণে জাহাজ পরিচালনা করতে অসুবিধা হচ্ছে।

পথে আছে ডুবোচর 
শুধু মাস্টার সংকট নয়, নৌপথে জাহাজ পরিচালনা করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত পড়তে হচ্ছে দুর্ঘটনায়। কারণ চট্টগ্রাম-ঢাকা রুটের দুটি স্থানে আছে ডুবোচর। সন্দ্বীপের দক্ষিণ ভাটিতে ফুলতলা পয়েন্ট ও ভাসানচরের দক্ষিণ ভাটিতে আকতার বানু পয়েন্টে ডুবোচর রয়েছে।  ভাটার সময় এ দুটি পয়েন্টে জাহাজ চালানো চরম ঝুঁকির। তাই এসব পয়েন্ট অতিক্রম করার সময় জোয়ারের জন্য অপেক্ষা করতে হয় মাস্টারদের। অন্যথায় ঘটে দুর্ঘটনা। গত এক বছরে এ দুটি পয়েন্টে ২৪টি জাহাজ দুর্ঘটনায় পড়েছে বলে জানান বিআইডব্লিউটিএর যুগ্ম পরিচালক আবদুস সবুর খান। ব্যবসায়ীরা বলছেন, নিয়মিত ড্রেজিং করে এসব ডুবোচরে নাব্য ফিরিয়ে না আনলে পণ্য পরিবহনে ঝুঁকি কমবে না।

নৌপথে কমছে পণ্য পরিবহন
২০১৩ সালে প্রায় ৩৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় পানগাঁও কনটেইনার টার্মিনাল। বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে বিআইডব্লিউটিএর মালিকানাধীন ৫৫ একর জায়গার ওপর এই কনটেইনার টার্মিনাল গড়ে তোলা হয়। কিন্তু নানা বাধার কারণে এটির সুফল সেভাবে পাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা। এ জন্য কনটেইনার পরিবহনের হার ক্রমে কমছে নৌপথে। ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে পরবর্তী চার বছরে এ নৌরুটে যথাক্রমে ২৫ হাজার ৪১১, ২৪ হাজার, ২৫ হাজার ৩৭০ ও ৩৫ হাজার টিইইউএস কনটেইনার আসা-যাওয়া করে। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আসা-যাওয়া করে মাত্র ১০ হাজার ২৪০ টিইইউএস কনটেইনার। 
 

আরও পড়ুন

×