কৃষিপণ্যের উৎপাদন বাড়াতে দরকার নতুন উদ্যোক্তা

কোলাজ
জসিম উদ্দিন বাদল
প্রকাশ: ১৫ নভেম্বর ২০২৪ | ২৩:৩৬ | আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০২৪ | ১২:০০
শিল্পায়ন, নগরায়ণসহ নানা কারণে কৃষিজমির পরিমাণ কমছে। বিপরীতে জনসংখ্যা বাড়তে থাকায় দিন দিন বাড়ছে কৃষিপণ্যের চাহিদা। সেই তুলনায় বাজারে পণ্যের সরবরাহ কম। ফলে নিত্যপণ্যের ‘আগুন দর’। অন্যদিকে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সাম্প্রতিক বন্যায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে ফসলের, যা আরও উস্কে দিচ্ছে পণ্যমূল্যকে। এ পরিস্থিতিতে কৃষিবিদ ও ভোক্তাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, উৎপাদন বাড়ানোর বিকল্প নেই। সেজন্য উন্নত বীজ ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো, উৎপাদন খাতে নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি, উদীয়মান নতুনদের অগ্রাধিকার দেওয়া, বাজারে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি ও কোম্পানিগুলোর গোপন সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়ার মতো উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
কৃষিপণ্য উৎপাদন খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, আধিপত্য বিস্তারকারী কিছু প্রতিষ্ঠানের দাপটে নতুনরা প্রসারিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন না। বীজ, সার, কীটনাশক থেকে শুরু করে প্রতিটি খাতে রয়েছে পুরোনোদের একক কর্তৃত্ব। এসব খাতের টেন্ডারও রয়েছে তাদের কবজায়। বাজার নিয়ন্ত্রণে উৎপাদন বাড়াতে হলে কৃষিতে নতুন কোম্পানি সৃষ্টির বিকল্প নেই। স্থাপন করতে হবে নতুন গবেষণা কেন্দ্র। বৈচিত্র্য আনতে হবে উৎপাদনে। উচ্চ ফলনশীল পণ্যের উদ্ভব ঘটাতে হবে। তাতে খাদ্য ঘাটতি কমবে। আমদানিনির্ভরতা কাটিয়ে উৎপাদনশীল হয়ে উঠবে দেশ।
বাংলাদেশ পরিসংখান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুসারে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ছিল ১১ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ, যা তার আগের বছরে ছিল ১১ দশমিক ৩০ শতাংশ। জিডিপিতে কৃষির অবদান ক্রমেই কমে এলেও মোট জনশক্তির ৪৫ দশমিক ৪ শতাংশ এখনও কৃষিতে নিয়োজিত।
কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য খাতের সম্ভাবনা নিয়ে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) এবং ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে বাংলাদেশ কৃষিপণ্যের বাজার ছিল ৪ হাজার ৭৫৪ কোটি ডলারের। বিপুল সম্ভাবনা থাকলেও কৃষি খাত জলবায়ু পরিবর্তন, সম্পদের সীমাবদ্ধতা এবং ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদার মোকাবিলার মতো নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। সংশ্লিষ্টদের মতে, এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রযুক্তি, কৃষি উপকরণ এবং কৃষিবিষয়ক উদ্যোগে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতের গুরুত্ব বাড়ছে। গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে নতুন জাত এবং টেকসই কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন সম্ভব। তবে সেজন্য নতুন কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। কৃষকদের সুলভ মূল্যে উচ্চ প্রযুক্তি সরবরাহ করতে হবে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, অতিবৃষ্টি ও বন্যায় এবার ২৩ জেলার ফসল উৎপাদন ও ১৪ লাখের বেশি কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাতে প্রায় ৯ লাখ ৮৬ হাজার টন ফসল উৎপাদন বিনষ্ট হয়েছে। বেশি ক্ষতি হয়েছে আউশ-আমন ধান ও শাকসবজির। এ পরিস্থিতিতে খাদ্যের বর্ধনশীল চাহিদা মেটাতে উন্নত বীজ দরকার। সরকার ২০-২৫ শতাংশ বীজ সরবরাহ করে। বাকি ৭৫-৮০ শতাংশ সরবরাহ করে বেসরকারি খাতের ছোট-বড় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। কৃষিবিদরা মনে করেন, এ খাতে নতুন নতুন আইডিয়া এবং উদ্যম নিয়ে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসা দরকার। তবে উদ্যোক্তাদের শঙ্কা, সিন্ডিকেটের কারণে এবার ধানের সময় হাইব্রিড বিজের বড়জোর ১০ শতাংশ কৃষক পেতে পারে। বীজ সরবরাহে সরকারকে নজরদারি করতে হবে।
কৃষিপণ্য খাতে যেসব সমস্যা
সংশ্লিষ্টদের মতে, বীজের পাশাপাশি সারের ক্ষেত্রেও আছে নানা সমস্যা। চলতি অর্থবছরে সারের মোট চাহিদা হতে পারে ৬৯ লাখ টন। চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশই আমদানি করতে হয়। এ খাতের ব্যবসায়ীরা জানান, দু-তিনটি কোম্পানি বছরের পর বছর সার আমদানি করে সরকারকে সরবরাহ করছে। টেন্ডারে অন্যদের যুক্ত করা হচ্ছে না। ফলে তাদের কাছ থেকে বেশি দরে সার কিনতে বাধ্য হচ্ছে সরকার। এ ক্ষেত্রে আরও বেশি উদ্যোক্তা ও করপোরেট হাউসগুলোর সমন্বয় ঘটলে প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হবে। সরকার কম দরে সময়মতো সার পাবে। তাতে প্রত্যক্ষভাবে উপকৃত হবেন কৃষকই।
কৃষি খাতের ব্যবসায় সম্পৃক্ত এমন নতুন কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বলছে, সরকারকে সার সরবরাহে যেমনি গুটি কয়েক কোম্পানি যুক্ত, ঠিক তেমনি কীটনাশক-বীজের ক্ষেত্রেও রয়েছে সেই চক্রটি। ফলে অন্যরা চাইলেও প্রতিযোগিতার সুযোগ পাচ্ছেন না। দেশে বছরে ৩৮ থেকে ৩৯ হাজার টন কীটনাশকের দরকার হয়। যার সিংহভাগই আমদানি করতে হয়। কৃষিপণ্য আমদানির ক্ষেত্রেও পুরোনো কিছু প্রতিষ্ঠান বাধা হয়ে দাঁড়ায়। লাইসেন্সে উল্লেখিত কোম্পানির বাইরে কারও কাছ থেকে আমদানি করা যায় না। আবার লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে মাসের পর মাস ঘুরতে হয় খামারবাড়ির কর্মকর্তাদের দ্বারে দ্বারে। এ কারণে নতুন উদ্যোক্তাদের বেশি দরে কৃষিপণ্য ও সরঞ্জাম আমদানি করতে হয়। সরকার এসব বিষয়ে নজরদারি করলে কৃষিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন উদীয়মান উদ্যোক্তারা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কৃষি খাতের শীর্ষ পর্যায়ের একটি কোম্পানির একজন পরিচালক সমকালকে বলেন, কয়েকটি বড় কোম্পানির হাতে পুরো কৃষি খাত জিম্মি। তাদের একক আধিপত্যের কারণে নতুনরা প্রসারিত হতে পারছেন না। সার, কীটনাশক, বীজ ও কৃষি প্রযুক্তিতে কঠোর নজরদারি করলে সিন্ডিকেট ভাঙবে। উৎপাদনেও বিপ্লব ঘটবে।
কৃষিবিদ গ্রুপের কৃষিবিদ সীড লিমিটেডের সিনিয়র মহাব্যবস্থাপক সাজ্জাদ ফেরদাউস শিশির সমকালকে বলেন, বীজ আমদানির ক্ষেত্রে এলসি খোলাই বড় সমস্যা। আগে ১০ শতাংশ মার্জিন দিয়ে এলসি খোলা যেত, এখন ১০০ শতাংশ দিতে হয়। কাস্টমসেও অনেক সমস্যা আছে। তারা মরিচের বীজকে মসলা হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে শুল্ক আদায় করতে চায়। সরকারের এ বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার।
তিনি বলেন, বড় প্রতিষ্ঠানগুলো উন্নত বীজ আমদানি করে। কিন্তু স্থানীয় কিছু ছোট কোম্পানি বা উদ্যোক্তা ভারত থেকে নিম্নমানের বীজ আনেন। এতে বড় কোম্পানিগুলোর ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিছু কোম্পানি নিজেদের কর্তৃত্ব ধরে রাখতে চায়। যেমন পেস্টিসাইডের ক্ষেত্রে এর কিছুটা লক্ষণ দেখা যায়। নতুনরাও মনে করেন, তাদের বিকাশের ক্ষেত্রে পুরোনো কোম্পানিগুলো বড় বাধা।
এ বিষয়ে কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন সমকালকে বলেন, প্রতিযোগিতা না থাকলে বাজার ব্যবস্থাপনা কিংবা কৃষি উৎপাদন– কোনো খাতেই নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। সেজন্য নতুন কোম্পানিগুলোকে সুযোগ-সুবিধা দিয়ে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করতে হবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ছাইফুল আলম সমকালকে বলেন, ২০১০ সালে পেস্টিসাইডবিষয়ক বিধিমালা প্রণয়ন হয়েছে। এর পর ২০১৮ সালে একটা আইন তৈরি হয়। তবে এখনও আগের বিধিমালাই অনুসরণ করতে হচ্ছে। এ বছর নতুন বিধিমালা হওয়ার কথা। সেটি হলে পেস্টিসাইড সোর্সিংয়ের ক্ষেত্রে হয়রানি কমে যাবে।
সারের বিষয়ে তিনি বলেন, সরকার কৃষকদের ভর্তুকি মূল্যে সার সরবরাহ করে, যাতে তাদের উৎপাদন খরচ কম হয়। এখানে যে প্রতিষ্ঠান থেকে কম দরে সার পাবে, তাকেই অনুমোদন দেওয়া উচিত। ভবিষ্যতে সার সংগ্রহের ক্ষেত্রে অনিয়ম রোধ ও প্রতিযোগিতা সৃষ্টির বিষয়ে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।
প্রযুক্তির সমন্বয় দরকার
শ্রমিক সংকট, সময় ও উৎপাদনশীলতার নিম্নমানের কারণে কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। প্রায় ৮০ শতাংশ কৃষক ছোট জমিতে চাষাবাদ করেন। সেগুলোর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আধুনিক যন্ত্রপাতি পৌঁছায় না। সরকার ৫০ শতাংশ ভর্তুকিতে সমতলে এবং ৭০ শতাংশ ভর্তুকিতে হাওর ও উপকূলে কৃষি যন্ত্রপাতি দিচ্ছে। তাতে বন্যায় ফসল তলিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি কমছে। এ ধারা অব্যাহত রাখা প্রয়োজন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
কৃষি উদ্যোক্তাদের মতে, প্রতিটি গ্রামে একটি করে হলেও ধান সংগ্রহের যন্ত্র দরকার। সেজন্য আধুনিক প্রযুক্তি সরবরাহের আগাম প্রস্তুতি নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে বড় বিনিয়োগ দরকার। কোম্পানি বেশি হলে প্রতিযোগিতা বাড়বে। কৃষকরা মানসম্পন্ন ও সাশ্রয়ী দামে যন্ত্রপাতি পাবে। তবে এসব যন্ত্রপাতি সরবরাহের নিয়ন্ত্রণও রয়েছে গুটি কয়েক প্রতিষ্ঠানের কবজায়। সেটি তদারকির মধ্যে রাখতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. আনোয়ার হোসেন সমকালকে বলেন, বিদ্যমান বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠান সিন্ডিকেট করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলে সুযোগ নেয়। এ প্রেক্ষাপটে প্রযুক্তিভিত্তিক নতুন কোম্পানি গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে। তাতে কৃষকদের জন্য উদ্ভাবনী সমাধান মিলবে, যা উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও খরচ কমাবে। এ ক্ষেত্রে পুরোনো এবং নতুন কোম্পানির সমন্বিত উদ্যোগ দরকার। পুরোনো প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞতা এবং নতুন কোম্পানির উদ্ভাবনী সক্ষমতা একসঙ্গে কাজ করলে চ্যালেঞ্জগুলো সফলভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, কিছু কোম্পানির আবির্ভাব কৃষি খাতে নতুন পথ উন্মোচন করেছে। মূলত প্রযুক্তি, উদ্ভাবননির্ভর এবং টেকসই কৃষির জন্য নতুন নতুন ধারণা নিয়ে কাজ করছেন তারা।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্লান্ট প্যাথলজি বিভাগের অধ্যাপক আবু নোমাক ফারুক আহম্মেদ বলেন, কৃষি সব সময় চ্যালেঞ্জিং। সার, বীজ, কীটনাশকের দাম বাড়ানোর কারণে কৃষিপণ্যের দর বাড়ছে। কোয়ালিটি নিশ্চিত করতে নকল ওষুধ, বীজ, কীটনাশক বাজারজাত করা রোধ করতে হবে। এসব পণ্যের বাজারে সরকারের তদারকি নেই। তবে প্রতিযোগিতা তৈরি করতে নতুন কোম্পানিগুলোকে ট্যাক্স রিবেটসহ অন্যান্য সুবিধা দিতে পারে সরকার। পাশাপাশি বিদেশিদের চেয়ে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে বেশি।
কী বলছেন সরকারের সংশ্লিষ্টরা
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, তারুণ্যনির্ভর আধুনিক কৃষি উদ্যোক্তা তৈরি করতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের বেশ কিছু প্রকল্প কাজ করছে। এসব প্রকল্পের মাধ্যমে সারাদেশে প্রায় ৫০ হাজার উদ্যোক্তা তৈরি করা হবে। কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বলেন, সরকার নতুন ও উদীয়মান প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহায়তা করতে প্রস্তুত। তবে কোন খাতে, কী ধরনের সহায়তা দরকার, সেটি স্পষ্ট করতে হবে। একই সঙ্গে সার, বীজ কিংবা কীটনাশক কোনো খাতে যেন কেউ অনিয়মের সুযোগ নিতে না পারে, সে বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রয়েছে বর্তমান সরকারের।
তিনি বলেন, যুগোপযোগী ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। প্রান্তিক কৃষকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ, আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দিতে হবে। এসব খাতে সরকারের পাশাপাশি করপোরেট প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করা যেতে পারে।