ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

মুক্তচিন্তা ও মৌলবাদের চালচিত্র

মুক্তচিন্তা ও মৌলবাদের চালচিত্র

শাহরিয়ার কবির

প্রকাশ: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ০১:২৮

বাংলাদেশে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের পাশাপাশি রাজনৈতিক ধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতার দ্বৈরথ আমরা লক্ষ্য করছি মুক্তিযুদ্ধের আগে পাকিস্তানি কলোনিকাল থেকে। সভ্যতার ঊষালগ্নে থেকেই আমাদের ভারতবর্ষে ধর্মের সঙ্গে নাস্তিকতা ও ইহজাগতিকার বিরোধ ছিল। পাকিস্তান পর্বে বাঙালির সব গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও সংগ্রামকে পাকিস্তানি শাসকরা ইসলাম ও পাকিস্তানের অখণ্ডতার বিরুদ্ধে চক্রান্ত হিসেবে অভিযুক্ত করেছে। '৪৮ থেকে '৫২-র ভাষা আন্দোলন; '৬২-র শিক্ষা আন্দোলন; ষাটের দশকে সরকারিভাবে রবীন্দ্রনাথকে বর্জন ও নিষিদ্ধকরণকে কেন্দ্র করে বাঙালির সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের আন্দোলন; '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান সর্বোপরি '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ- সবই ছিল পাকিস্তানি শাসক এবং তাদের সহযোগী ধর্মীয় মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলগুলোর বিবেচনায় ইসলামবিরোধী; কমিউনিস্ট ও ভারতের ষড়যন্ত্র। মুক্তিযুদ্ধকালে রাজনৈতিক ইসলামের জড় চিন্তা মুক্তমনা শিল্পী-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবী নিধনের জমিন প্রস্তুত করেছে।

ভারতসহ মুসলমিপ্রধান দেশগুলোয় যখন থেকে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার আরম্ভ হয়েছে; যখন থেকে রাজনৈতিক ইসলাম ও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠনের সূচনা হয়েছে, তখন থেকে মুক্তচিন্তার অনুসারী এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ধর্মবিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। হত্যার ফতোয়া এবং তাদের বিরুদ্ধে জেহাদ বা ধর্মযুদ্ধের ডাক দেওয়া হয়েছে। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের রাজ্য দখল এবং সাম্রাজ্য বিস্তারের যুদ্ধ; যুদ্ধজনিত গণহত্যা-নির্যাতনসহ যাবতীয় ধ্বংসযজ্ঞকে জেহাদ আখ্যা দিয়ে ধর্মীয় বৈধতা আরোপ করা হয়েছে। ইসলামের উন্মেষকাল থেকেই এই জেহাদ আমরা অবলোকন করছি।

আদি মানব যেমন নিজের বুদ্ধিবৃত্তিক ও হৃদয়বৃত্তিক প্রয়োজনে ঈশ্বর আবিস্কার করে ধর্মীয় বিধান ও অনুশাসন প্রচলন করেছে; একইভাবে নিজের বিশ্বাস দ্বারা অপরকে প্রভাবিত, পরাজিত ও অনুগত করতে চেয়েছে। ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব নির্বিঘ্ন করবার জন্য শক্তিমান গোত্রপ্রধান, রাজা ও সম্রাট নিজেদের ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে ঘোষণা করেছেন। ধর্ম প্রচারকারী ও ব্যাখ্যাকারী পুরোহিতরা রাজন্যবর্গের এই অভিপ্রায় প্রথমে মেনে না নিলেও পরে নিজেদের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে তা অনুমোদন করেছেন। ধর্ম ও রাষ্ট্র পরিচালনা বা রাজনীতি এভাবেই যুগলবন্দি হয়ে দীর্ঘকাল সমাজে নিজেদের আধিপত্য নিরঙ্কুশ রেখেছিল। বাংলাদেশসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ধর্মীয় কুসংস্কার ও জড়চিন্তার বিপরীতে মুক্তচিন্তার বিকাশও স্বাভাবিক নিয়মে হয়েছে।

মানুষের জানার আগ্রহ যেমন ঈশ্বর বা ধর্ম সৃষ্টি করেছে; একইভাবে অর্জিত জ্ঞান মানুষকে যুক্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ধর্মবিশ্বাস থেকে মুক্ত থাকতে সাহায্য করেছে। আস্তি ও নাস্তির এই দ্বন্দ্ব প্রথম বিধৃত হয়েছে ঋগ্‌বেদের যুগে। সেই যুগের ঋষি বৃহস্পতিকে আমরা ভারতীয় জ্ঞান সাধনায় প্রথম মুক্তচিন্তক বা নাস্তিক হিসেবে আখ্যায়িত করতে পারি। সর্বসিদ্ধান্তসমগ্রে বৃহস্পতি দেবপূজার সমালোচনার পাশাপাশি মন্দির নির্মাণেরও সমালোচনা করেছেন। বেদের বহু সূত্র তিনি নাকচ করে দিয়েছেন। বৃহস্পতির শিষ্য চার্বাকগণ ঈশ্বর, পরকাল, স্বর্গ, নরক, পাপ, পূণ্য, প্রার্থনা সবকিছু প্রত্যাখ্যান করে যে লোকায়ত দর্শনের সূত্রায়ন করেছেন এটিই বিশ্বের প্রথম নাস্তিক বা ইহজাগতিক ধারণা। চার্বাকের অনুসারী মুক্তচিন্তকরা প্রতিনিয়ত ধর্মের ধ্বজাধারীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন। তাঁদের মূল রচনা ধ্বংস করা হয়েছে। তারপরও শ্রুতি থেকে দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতকে সংকলিত সূত্রগুলো ইহজাগতিকতা অর্থে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের উজ্জ্বল উদাহরণ হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে। আবুল ফজলের 'আইনি আকবরি'তে আকবরের রাজত্বকালে মুক্তচিন্তার অনুসারী চার্বাকপন্থিদের প্রশাসনিক ও বিচারিক দক্ষতার উল্লেখ রয়েছে।

ভারতীয় দর্শনে আস্তিক বলা হয় তাদের, যারা সাধারণভাবে বেদ ও পুনর্জন্মে বিশ্বাস করে। যারা করে না তারা নাস্তিক। আবার আস্তিক দর্শনের দুই প্রধান শাখা সাঙ্খ্য ও মীমাংসা নিরীশ্বরবাদী। প্রাচীনতম হিন্দু ধর্ম নাস্তিকতাকে যেমন স্বীকৃতি দিয়েছে; একইভাবে অন্য ধর্মকেও অস্বীকার করেনি। বৈদিক দর্শন ভারত থেকে দূরপ্রাচ্যে, ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলোয় এবং আরবে গিয়েছে। গ্রিক ও রোমান দার্শনিকরা যেভাবে বেদ ও উপনিষদ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন; একইভাবে চার্বাকের দর্শন দ্বারাও প্রভাবিত হয়েছেন।

বাংলাদেশের পাঁচ হাজার বছরের লিখিত ও অলিখিত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, মুক্তচিন্তা বা সেক্যুলারিজমের চেতনা এ দেশে পশ্চিম থেকে আমদানি করা হয়নি। ভারতবর্ষে যখন থেকে বৈদিক ধর্মের প্রবর্তন হয় তখন থেকেই উদ্ভব ঘটেছে ধর্মবিরোধী চিন্তা। খ্রিষ্টের জন্মের প্রায় দেড় হাজার বছর আগে চার্বাক দর্শন ঈশ্বর, পরলোক, স্বর্গ, নরক, জন্মান্তর প্রভৃতি বৈদিক ধর্মের মূল বিষয় অস্বীকার করে ভারতীয় উপমহাদেশে বস্তুবাদী দর্শনের জন্ম দিয়েছে। ঋগ্‌বেদে এই দর্শনের আদি গুরু বৃহস্পতি বলেছেন, 'বস্তুই হচ্ছে চরম সত্তা'। চার্বাক দর্শনের অনুসারীরা জীবনকে পরিপূর্ণভাবে উপভোগের কথা বলেছেন। এই ভোগবাদ ধর্মবিশ্বাসীদেরও প্রভাবিত করেছিল। হিন্দুর বৈদিক ধর্মকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে এসেছিল জৈন ও বৌদ্ধ ধর্ম, যা বৈদিক ধর্মাবলম্বীদের দ্বারা সমালোচিত হয়েছে নাস্তিকতা হিসেবে।

নাস্তিকতার প্রভাবে বাঙালি হয়েছে সেক্যুলার। তবে বাঙালির চেতনায় সেক্যুলারিজম ধর্মের বহু আচার-অনুষ্ঠানের সঙ্গে সহঅবস্থান করেছে; বিশেষভাবে যেসব আচার-অনুষ্ঠান পার্থিব প্রাপ্তির সন্ধান দেয়।

অধ্যাপক আহমদ শরীফ বাঙালির সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলেছেন, 'আমাদের দেশের নাম বাংলাদেশ, তাই ভাষার নাম বাঙলা এবং তাই আমরা বাঙালী। আমরা এদেশেরই জলবায়ু ও মাটির সন্তন। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই এদেশের মাটির পোষণে, প্রকৃতির লালনে এবং মানুষের ঐতিহ্য-ধারায় আমাদের দেহ-মন গঠিত ও পুষ্ট। আমরা আর্য নই, আরবি, ইরানি কিংবা তুর্কিস্তানিও আমরা নই। আমরা এদেশেরই অস্ট্রিক গোষ্ঠীর বংশধর। আমাদের জাত আলাদা, আমাদের মনন স্বতন্ত্র, আমাদের ঐতিহ্য ভিন্ন, আমাদের সংস্কৃতি অনন্য।

'আমরা আগে ছিলাম animist, পরে হলাম pagan, তারও পরে ছিলাম হিন্দু-বৌদ্ধ, এখন আমরা হিন্দু কিংবা মুসলমান। আমরা বিদেশের ধর্ম নিয়েছি, ভাষা নিয়েছি, কিন্তু তা কেবল নিজের মতো করে রচনা করবার জন্যেই। তার প্রমাণ নির্বাণকামী ও নৈরাত্ম-নিরীশ্বরবাদী বৌদ্ধ এখানে কেবল যে জীবনবাদী হয়ে উঠেছিল, তা নয়, অমরত্বের সাধনাই ছিল তাদের জীবনের ব্রত। বৌদ্ধচৈত্য ভরে উঠেছিল অসংখ্য দেবতা ও উপদেবতার প্রতিমায়। হীনযান-মহাযান ত্যাগ করে এরা তৈরি করেছিল বজ্রযান-সহযান, হয়েছিল থেরবাদী। এতে নিহিত তত্ত্বের নাম গুরুবাদ।

'সে জীবনবাদী, তাই বস্তুকে সে তুচ্ছ করে না, ভোগে নেই তার অবহেলা, তাই জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে যা কর্তব্য, তাতেই সে উদ্যোগী। সে জন্যেই সে তার গরজমতো জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তার দেবতা সৃষ্টি করেছে। পারলৌকিক সুখী জীবনের কামনা তার আন্তরিক নয়- পোশাকীই। তাই সে মুখে বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্যবাদ গ্রহণ করেছিল, অন্তরে কোনোদিন বরণ করেনি। তার পোশাকী কিংবা পার্বণিক জীবনে বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য ধর্ম এবং আচার আবরণ ও আভরণের মতো কাজ দিয়েছে, কিন্তু তার আটপৌরে জীবনে ঠাঁই পায়নি।' (বাংলা বাঙালী ও বাঙালিত্ব, অনন্যা, ঢাকা, ২০০১)

হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মকে বাঙালি যেভাবে নিজের বস্তুবাদী চেতনার উপযোগী করে গ্রহণ করেছে; পরবর্তী সময়ে একইভাবে গ্রহণ করেছে ইসলাম ও খ্রিষ্ট ধর্মকে। ইসলাম এ দেশে এসেছে এক হাজার বছর আগে এবং তা প্রচারিত হয়েছে প্রধানত সুফিদের দ্বারা। দু'একটি ব্যতিক্রম ছাড়া সুফিরা তলোয়ারের জোরে নয়; মানবপ্রেম অবলম্বন করে ইসলাম প্রচার করেছেন। হিন্দু ধর্মের বর্ণবৈষম্যের শিকার নিম্নবর্ণের মানুষ ব্রাহ্মণের সমান হওয়ার জন্য কিংবা পরবর্তী সময়ে মুসলিম শাসকদের অনুগ্রহ লাভের জন্য ইসলাম গ্রহণ করেছে। তবে এই ইসলাম আরবের বিশুদ্ধ বা কট্টর ইসলাম ছিল না। ইরানে উদ্ভূত সুফিবাদের ওপর মুতাজিলাদের প্রভাবের ফলে কিতাবসর্বস্ব আনুষ্ঠানিকতার পরিবর্তে উদারনৈতিক মানবিকতার যে পরিচয় ইসলামে পাওয়া যায়, তা এতদঞ্চলের মানুষদের বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছিল।

রক্ষণশীল ইসলামে নৃত্যকলা, সংগীত ও চিত্রকলা নিষিদ্ধ। সুফিরা মুতাজিলাদের মতো এই নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে এর চর্চা করেছেন। বিশেষভাবে চিশতিয়া ও সোহরাওয়ার্দী তরিকার সুফিদের প্রভাবে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম ভারতে উচ্চাঙ্গ সংগীতের চর্চায় মুসলিম শিল্পীরা অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। উত্তর ভারতীয় উচ্চাঙ্গ নৃত্যশিল্পের বিকাশেও মুসলমানরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। বাংলার হিন্দু জমিদাররা লক্ষেষ্টৗ, জয়পুর, আগ্রা ও এলাহাবাদ থেকে মুসলিম ওস্তাদ ও বাঈজিদের আনতেন দুর্গোৎসব কিংবা কোনো পারিবারিক উৎসবে।

সুফিবাদের সাম্য ও মানবিকতা বাংলার সনাতন হিন্দু ধর্মকে কীভাবে প্রভাবিত করেছিল, তার প্রমাণ হচ্ছে মধ্যযুগে চৈতন্যদেবের বৈষ্ণব ধর্ম। বৈষ্ণব কবিদের রচনায় মানবপ্রেম নানাভাবে মূর্ত হয়েছে। এ সময়ের কবি চণ্ডীদাসই মানবতার শাশ্বত বাণী উচ্চারণ করেছিলেন :'শুনহ মানুষ ভাই-/ সবার উপরে মানুষ সত্য/ তাহার উপরে নাই।'

এর আগে চর্যাপদের যুগে বৌদ্ধ কবিরাও মুক্তচিন্তা ও মানবিকতার জয়গান গেয়েছেন এবং জীবনবিমুখ ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের সমালোচনা করেছেন। ১১০০ বছর আগে চর্যাপদকর্তা সরহপার একটি দোহা গানের কথা হচ্ছে- 'কী হবে তোর দীপে, কী হবে তোর নৈবেদ্যে?/ কী হবে তোর মন্ত্র ও সেবায়?/ তীর্থে তপোবনে গিয়েই বা তোর কী হবে?/ মোক্ষ কি লাভ হয় জলে স্নান করে?' (চর্যাগীতি পদাবলী, সম্পাদনা সুকুমার সেন, কলকাতা-১৯৬৬)
এরই চূড়ান্ত রূপ আমরা পাই ফকির লালন শাহ এবং তাঁর সগোত্রীয় বাউলদের গানে। দেড়শ বছর আগে লালন লিখেছেন, 'এমন মানব সমাজ কবে গো সৃজন হবে/ যবে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ খ্রিষ্টান জাতিভেদ নাহি রবে।' কিংবা 'সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে/ লালন কয় জাতের কী রূপ দেখলাম না এই নজরে .../ জগৎজুড়ে জাতের কথা/ লোকে গল্প করে যথাতথা/ লালন বলে জাতের ফাতা/ ডুবাইছি সাত বাজারে।' মুক্তচিন্তক লালন এভাবেই জড়ধর্ম বিসর্জন দিয়েছিলেন।

লালনের বহু গানে ধর্মনিরপেক্ষ মানবিকতার চেতনা প্রতিফলিত হয়েছে। লালনের মানবিক সৌন্দর্য ও রহস্যময়তা পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও প্রভাবিত করেছিল। তবে রবীন্দ্রনাথের মানবতাবোধ সর্বজনীন; দেশ ও কালের গণ্ডিতে আবদ্ধ নয়। তাঁর Religion of Man-এ তিনি স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘My religion is the reconciliation of the super-personal man, the universal human spirit in my own individual being.’

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর কবিতায় ভগবানের বুকে লাথি মেরে মানবতার জয়গান গেয়েছেন- 'গাহি সাম্যের গান/ মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান্‌।' নজরুলের সমসাময়িককালে ১৯২৫ সালে কলকাতায় সূচিত হয়েছিল 'বুদ্ধিমুক্তি'র আন্দোলন, যা শহরের শিক্ষিত মুসলমানদের ধর্মনিরপেক্ষ মুক্তচিন্তায় উদ্বুদ্ধ করেছে। আবুল হোসেন, কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল ফজল, কাজী মোতাহার হোসেনরা এ আন্দোলনের সূচনা করেছেন, যার স্লোগান ছিল- 'জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।'

এদের সমসাময়িক বাঙালি এমএন রায় 'র‌্যাডিক্যাল হিউম্যানিজম' আন্দোলনের জন্ম দিয়েছেন, যার ভিত্তি ছিল যুক্তি-নীতি-স্বাধীনতা। তিনি মানুষের স্বাধীন ব্যক্তিসত্তাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল সব রকম রাজনৈতিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় শৃঙ্খল থেকে মানুষের মুক্তি। উনিশ শতকে বাংলার বিদ্বৎ সমাজে ইউরোপের রেনেসাঁর প্রভাবে মুক্তচিন্তা এবং ধর্মনিরপেক্ষ মানবিকতার চর্চা যেমন নতুন মাত্রা লাভ করে; ইংরেজ শাসকদের উপনিবেশনীতি- ধর্মে ধর্মে বিভাজন ও বিরোধকে সমানভাবে উৎসাহিত করেছে।

গ্রামবাংলার লোকায়ত সংস্কৃতিতে সেক্যুলার মানবিকতার বোধ যতটা প্রবল; নগরকেন্দ্রিক বিত্তবান এলিটদের চেতনায় ততটা কখনও ছিল না। বাঙালির লোক-ঐতিহ্যে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলমান ধর্মের এক ধরনের সমন্বয় ঘটেছে, যা গ্রামবাংলার বাউল, জারি, সারি, কবি গান, বাংলা নববর্ষ, চৈত্রসংক্রান্তি ও নবান্ন উৎসবে আমরা দেখতে পাই। এসব সাংস্কৃতিক আয়োজন একান্তভাবেই অসাম্প্রদায়িক, সেক্যুলার, যা শত শত বছর ধরে গ্রামবাংলার মানুষ চর্চা করেছে।

রাজা ও ভূস্বামীদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের কারণে বিভিন্ন সময়ে ধর্মে ধর্মে বিরোধ ও হানাহানির ঘটনা ঘটলেও গ্রামবাংলার মানুষ তাতে খুব একটা সাড়া দেয়নি। এমনকি ধর্মীয় আচরণের ক্ষেত্রে এখনও হিন্দুরা যেমন মুসলিম পীরের মাজারে গিয়ে মানত করে; মুসলমানরাও বিপদের সময় হিন্দুদের অনেক কাল্পনিক দেব-দেবীর শরণাপন্ন হয়। এদের ভেতর সত্যনারায়ণ, ওলাইচণ্ডী, শীতলা দেবী, বন দেবীর নাম উল্লেখ করা যেতে পারে।

হিন্দুদের লোকজ দেবতা সত্যনারায়ণ হচ্ছেন মুসলমানদের সত্যপীর। মধ্যযুগে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে 'সত্য'র সাধনা করেছে। সেই সময়ে সত্য পীর বা সত্যনারায়ণকে বন্দনা করে বহু পুঁথি লেখা হয়েছিল। একটি পুঁথিতে বলা হয়েছে- 'হিন্দুর দেবতা হইল মুসলমানের পীর/ দুই কুলে সেবা লয় হইয়া জাহির।/ ...মক্কার রহিম আমি অযোধ্যার রাম/ কলিতে সম্প্রতি আমি সত্যনারায়ণ।' (প্রাগুক্ত)

এসব দেব-দেবী কিংবা পীর-মুর্শিদের কাছে হিন্দু-মুসলমান গিয়েছে পার্থিব প্রয়োজনে; পরকালে কিছু প্রাপ্তির আশায় নয়। বাঙালির চেতনায় পরকালের চেয়ে ইহকাল অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মধ্যযুগে বহু বাঙালি মুসলমান কবি হিন্দু দেব-দেবীর বন্দনা করে কবিতা লিখেছেন। হিন্দু কবি ও শিল্পীরা মুসলিম পীর-মুরশিদ ও শাসকদের বন্দনা করেছেন। তাঁদের রাজসভা অলংকৃত করেছেন।

তবে ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে এটাও আমরা দেখেছি, জড়বুদ্ধিসম্পন্ন এক শ্রেণির গোঁড়া ধর্মপ্রচারক বাংলায় সাধারণ মানুষের জীবনে সেক্যুলার জীবনযাপন বা ধর্ম-সমন্বয়ের আচরণকে সহজভাবে গ্রহণ করেননি। মধ্যযুগে দিল্লিতে সম্রাট আকবরের 'দ্বীন-ই-ইলাহী'র মাধ্যমে সর্বধর্ম-সমন্বয়ের উদ্যোগ এবং বাংলায় সুিফ-বৈষ্ণবদের সর্বধর্ম-সমন্বয়ের মাধ্যমে মানবধর্মের আবাহনকালে আবির্ভাব ঘটেছিল শেখ আহমদ সিরহিন্দ-এর নেতৃত্বে এক দল কট্টর ওলামার, যাঁদের লক্ষ্য ছিল হিন্দুদের প্রভাব থেকে মুসলমানদের বের করে আনা এবং শরিয়তের বিধান কঠোরভাবে পালন করা। এরই ধারাবাহিকতায় উনিশ শতকের প্রথমদিকে বাংলায় ওহাবি আন্দোলনের সূচনা হয়েছে।

শুরুতে ওহাবিরা ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও পরে তাদের বিরোধিতার লক্ষ্য ছিল ভারতের অমুসলিম ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং অন্তিমে ইসলামি হুকুমত কায়েম।

ধর্মের সঙ্গে রাষ্ট্র ও রাজনীতির মেলবন্ধনের পরিণতি কী ভয়ংকর হতে পারে- এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ পাকিস্তান। গণতন্ত্রহীনতা, জাতিগত ও সাংস্কৃতিক নিপীড়ন, কলোনিসুলভ শোষণ ও বঞ্চনা; সর্বোপরি পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার নামে ১৯৭১-এ বাংলাদেশে ৩০ লাখ নিরীহ মানুষ হত্যা, সোয়া ৪ লাখ নারীর ওপর পাশবিক নির্যাতন, ১ কোটি মানুষকে মাতৃভূমি থেকে বিতাড়ন- সবই বৈধকরণের অপচেষ্টা হয়েছে ইসলামের দোহাই দিয়ে। যে কারণে স্বাধীন বাংলাদেশকে রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে গ্রহণ করতে হয়েছে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদকে। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি হিসেবে গ্রহণের পাশাপাশি ধর্মের নামে রাজনৈতিক দল গঠনও নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, যা সমাজতান্ত্রিক শিবির ও তুরস্ক ছাড়া বিশ্বের অন্য কোনো ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক দেশে করা সম্ভব হয়নি।

১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর জেনারেল জিয়াউর রহমান সংবিধান থেকে 'ধর্মনিরপেক্ষতা', 'সমাজতন্ত্র' ও 'বাঙালি জাতীয়তাবাদ' মুছে ফেলে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ওপর সাংবিধানিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির যে 'পাকিস্তানীকরণ' ও 'ইসলামীকরণ' প্রক্রিয়া আরম্ভ করেছিলেন, তার মাশুল এখনও দিতে হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগেরও অনেক নেতা এখন বক্তৃতা শুরু করেন 'বিসমিল্লাহ...' বলে। ২০০৮ সালে তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি আসনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে 'ধর্মনিরপেক্ষতা'কে সংবিধানে ফিরিয়ে এনেছে বটে, তবে পাকিস্তানপন্থি দুই জেনারেল জিয়া ও এরশাদের ভন্ডামির কিছু অংশ সংবিধানে এখনও রেখে দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি ধর্মনিরপেক্ষতা হলেও এখনও সংবিধানের মাথায় 'বিসমিল্লাহ...' এবং ভেতরে 'রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম' অক্ষুণ্ণ আছে।

মৌলবাদীদের তুষ্ট করার জন্য সংবিধানে 'রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম' রেখেও আওয়ামী লীগ তাদের অপপ্রচারের বিষাক্ত ছোবল থেকে রেহাই পাচ্ছে না। জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের ছত্রছায়ায় হালে গজিয়ে ওঠা 'হেফাজতে ইসলাম'-এর নেতারা প্রকাশ্য জনসভায় বলেছেন, শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকার হচ্ছে নাস্তিকদের সরকার, ইসলামের দুশমন এবং এই জালেম ও দুশমন সরকারকে গদি থেকে হটাতে হবে। ২০১৩-এর ৫ ও ৬ মে বিএনপি-জামায়াতের সহযোগিতায় হেফাজতে ইসলাম শেখ হাসিনার সরকার উৎখাতের চূড়ান্ত পরিকল্পনা করেছিল, যা শেষ মুহূর্তে ভেস্তে গেছে বটে; কিন্তু তথাকথিত নাস্তিকদের বিরুদ্ধে তাদের জেহাদ অব্যাহত রয়েছে।

১৯৭১ সালে তালিকা প্রস্তুত করে যেভাবে মুক্তচিন্তার অনুসারী শিল্পী-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের হত্যা করা হয়েছে; হেফাজতে ইসলাম ও জামায়াতে ইসলামীর অনুসারীরা এখনও তাই করছে। কখনও ওয়াজের নামে, কখনও নামাজের খুতবার নামে, কখনও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তারা প্রতিনিয়ত আক্রমণ করছে মুক্তচিন্তকদের। বাংলাদেশে মুক্তচিন্তার বিকাশ ঘটাতে হলে সবার আগে ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। শিক্ষানীতি, সংস্কৃতিনীতিসহ রাষ্ট্রীয় সব নীতিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অনুশীলন করতে হবে।

মানব সভ্যতার অগ্রগতির চক্র কখনও থামিয়ে দেওয়া যায়; কখনও পশ্চাদপসরণ ঘটে। অন্তিমে মুক্তচিন্তার বিজয় অবশ্যম্ভাবী।
লেখক
প্রাবন্ধিক
সভাপতি, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি

আরও পড়ুন

×