ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

গণতন্ত্রেই বহুমতের সহাবস্থান নিশ্চিত হয়

গণতন্ত্রেই বহুমতের সহাবস্থান নিশ্চিত হয়

মতিয়া চৌধুরী

প্রকাশ: ০৬ অক্টোবর ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০২৩ | ২০:৫৮

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যাত্রাই হয়েছিল বহুমতের সহাবস্থান ও চর্চা দিয়ে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সংঘটিত মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭২ সালে আমরা একটি সংবিধান পেয়েছিলাম; যা বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধান হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। সেখানে বলা আছে, ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে।’ একই সংবিধানে আলাদাভাবে ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাদান’ করা হয়েছে। ওই সংবিধানের আওতায় আমরা যে সংসদীয় গণতন্ত্রের সরকার পদ্ধতি বেছে নিয়েছিলাম, সেটাও ভিন্ন মত-পথের সহাবস্থানের পক্ষে জাতির পিতার দৃঢ় অবস্থানকে তুলে ধরে।

মনে রাখতে হবে আমরা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছি পাকিস্তানি স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ধারাবাহিকতায় সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে। পাকিস্তানি শাসকরা আমাদের ওপর শুধু অর্থনৈতিক শোষণ চালায়নি, আমাদের ভাষা-সংস্কৃতিকেও দাবিয়ে রাখতে চেয়েছিল। ভিন্ন ধর্ম তো দূরের কথা, মুসলমানদের বিভিন্ন অংশের মানুষও সেখানে নিরাপদ বোধ করত না। সেখানে গণতন্ত্রের লেশমাত্র ছিল না। এমন এক প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু একদিকে আওয়ামী লীগকে সব শ্রেণি-পেশা-লিঙ্গ-ধর্ম-বর্ণের মানুষের সংগঠন হিসেবে গড়ে তোলেন, অন্যদিকে আপামর জনসাধারণকে যুক্ত করে গণতন্ত্রের সংগ্রাম পরিচালনা করেন; যার ধারাবাহিকতায় সংঘটিত হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ।

পাকিস্তানের ওই তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে আমরা বুঝেছি গণতন্ত্র ছাড়া জাতি হিসেবে বিকাশের বিকল্প কোনো পথ নেই। আর গণতন্ত্রেই শুধু সব মত-পথের মানুষের সহাবস্থান নিশ্চিত করা সম্ভব। বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে বলেছিলেন, ‘যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও, সে একজনও যদি হয়, তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।’ এর চেয়ে বড় গণতন্ত্র আর কী হতে পারে? ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাই বা এর চেয়ে ভালোভাবে কীভাবে প্রকাশ করা যায়?

বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে এ দেশে বাম-ডান বিচিত্র ধারার রাজনীতি সক্রিয় ছিল। এমনকি– আজকে যে যা-ই বলুক– এসব ধারার মধ্যে অনেক বিভ্রান্তি এবং আক্রমণাত্মক ও রক্তক্ষয়ী রাজনীতিও ছিল। শত চক্রান্তের মাঝেও বঙ্গবন্ধু তাদের নিয়ে চলার চেষ্টা করেন। কিন্তু একটা পর্যায়ে– ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট– বঙ্গবন্ধু তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ নিহত হলেন পাকিস্তানপন্থিদের হাতে, যারা গণতন্ত্র চায় না, মানুষের অধিকার চায় না, সর্বোপরি বাংলাদেশের বিকাশ চায় না। এখানে খুনিদের সহায়তাকারী হিসেবে আমেরিকার কথা বলতেই হবে, যারা বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয়ের বিরোধিতা করেছিল।

বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দীর্ঘ সময় এখানে সামরিক শাসন চলে, যারা সংবিধানকে কাটাছেঁড়ার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধূলিসাৎ করে, গণতন্ত্র-মানবাধিকারসহ মানুষের সব ধরনের অধিকার পদদলিত করে। সার্বিক অর্থেই এক ঘোর অমানিশা নেমে আসে জাতির ওপর। একদিকে আওয়ামী লীগসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ওপর পৈশাচিক নির্যাতন চলে, অন্যদিকে যুদ্ধাপরাধীসহ সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী অপশক্তিকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া হয়। যার পরিণামস্বরূপ ভয়ংকর জঙ্গিবাদী অপশক্তির বিরুদ্ধে আমাদের এখনও লড়াই করতে হচ্ছে।

যাহোক, ওই অমানিশার বিরুদ্ধে লড়াই করতে জননেত্রী শেখ হাসিনা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে এলেন। ইতিহাসে বিরল এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে ছোট দুটো সন্তানকে বিদেশ-বিভুঁইয়ে বোনের কাছে রেখে দেশের মাটিতে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের হাল ধরলেন। মানুষ তখন স্লোগান তুলেছিল– ঝড়বৃষ্টি আঁধার রাতে, শেখ হাসিনা– আমরা আছি তোমার সাথে। এ ঝড়বৃষ্টি শুধু প্রাকৃতিক ঝড়বৃষ্টি নয়, তৎকালীন দেশের অগণতান্ত্রিক স্বৈরশাসকেও বুঝিয়েছিল।

আজকে এটা স্বীকার করতে হবে, শেখ হাসিনা আছেন বলেই আমরা গণতন্ত্রের পথে হাঁটতে পারছি। হয়তো গণতন্ত্রের পথে খানাখন্দক আছে, তবে সেটাও পেতাম না তিনি না থাকলে। এ কথার জন্য অতিজ্ঞানী হওয়ার দরকার নেই যে, ১৫ আগস্টের মতো একটা বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের পর এর হোতা এবং তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দানকারীদের সঙ্গে ভুক্তভোগীদের সহাবস্থান সম্ভব না। তদুপরি ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে সরাসরি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে ঘটানো হলো আরেক জঘন্য হত্যাকাণ্ড, যার মূল লক্ষ্য ছিলেন শেখ হাসিনা। দেশবাসীর দোয়ায়, আল্লাহর অশেষ রহমতে তিনি– আহত হলেও– বেঁচে যান, তবে আমরা হারাই আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতাকর্মী; আহত হন আরও কয়েকশ নেতাকর্মী। কিন্তু এত কিছুর পরও শেখ হাসিনা কোনো প্রতিহিংসার পথে যাননি; সবারই রাজনীতি করার অধিকার তিনি দিয়েছেন।

একটা কথা স্বীকার করতে হবে, যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের অর্জনগুলোকে ধরে রাখতে চান তাদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী এবং তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দানকারীদের সহাবস্থান সম্ভব নয়। আপনি যতই চেষ্টা করুন, তেলে আর জলে মেশাতে পারবেন না। তেমন কোনো চেষ্টা হলে তা মুক্তিযুদ্ধকেই অস্বীকারের নামান্তর হবে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গণহত্যা যারা ঘটিয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে এ দেশের জনগণকে অস্ত্র ধরতে হয়েছিল। যারা একটা চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধে আত্মরক্ষার্থে, নিজের অস্তিত্ব রক্ষার্থে অস্ত্র ধরল তাদের পক্ষে ওই গণহত্যাকারীদের সঙ্গে কীভাবে সহাবস্থান সম্ভব?

যারা আজকে এ দুই পক্ষের সহাবস্থানের পক্ষে কথা বলেন, তারা কি ভেবে দেখেছেন, যদি আমরা ১৯৭১ সালে হেরে যেতাম তাহলে আজকে আমাদের অবস্থা কী হতো? আমরা তো ঘানি ঘোরানোর দাসে পরিণত হতাম। আমার মনে হয়, যারা ওই আক্রমণকারী ও আক্রান্তের সহাবস্থানের কথা ভাবেন, তারা একপ্রকার কল্পনাবিলাসে ভুগছেন। শেখ হাসিনা যেভাবে দেশটাকে সাফল্যের সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, এটা তাদের সহ্য হচ্ছে না। কথায় আছে না, সুখে থাকলে ভূতে কিলায়!

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কিন্তু আজকে শুধু আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী দিয়ে দেশ চালাচ্ছেন না। রাষ্ট্রযন্ত্রে এখন এমন বহু মানুষ আছেন, যারা আওয়ামী লীগের বাইরের লোক; এমনকি আমাদের বিরোধিতা করেন এমন লোকেরাও সেখানে আছেন। পারলে শেখ হাসিনাকে কালকেই দাফন-কাফন করে ফেলেন, এমন লোকও কিন্তু আছে। প্রধানমন্ত্রী সবাইকে সঙ্গে নিয়েই দেশ পরিচালনা করছেন। তাই তিনি বলেছেন– শত ফুল ফুটতে দাও, আমি সেরা ফুলটাকে বেছে নেব। এটাই দায়িত্বশীল রাজনীতি; এটাই স্টেটসমেনশিপ বা রাষ্ট্রনায়কোচিত কাজ।

প্রতিনিয়ত ঝগড়া-বিবাদ বা একজনের পেছনে আরেকজনের লেগে থাকা– এভাবে যেমন সংসার চলে না, তেমনি জীবনও চলে না। রাজনীতিও তার বাইরে নয়। শেখ হাসিনা তাই রাজনীতিতেও সবাইকে নিয়ে চলার পক্ষপাতী। রাজনীতিতে মতভিন্নতা বা মতবিরোধ থাকাটাই স্বাভাবিক। এমনকি এক পক্ষ আরেক পক্ষকে কথা-কৌশলে ঘায়েলও করতে পারে, যেটা রাজনৈতিক রণনীতি-রণকৌশল বলে স্বীকৃত। কিন্তু ‘ধরো অস্ত্র, করো রণ’– এ নীতিতে একটা দেশ চলতে পারে না। অন্তত যুদ্ধ করে যারা দেশটা স্বাধীন করেছে তারা দেশটাকে প্রতিদিনকার হানাহানির মধ্যে ফেলতে পারে না। আওয়ামী লীগও তা চায় না। দেশটার স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগ, তাই দলটা দেশকে এগিয়ে নিতে চায়।

লেখক বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের উপনেতা

আরও পড়ুন

×