ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

ইতিহাসের আলোকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা

ইতিহাসের আলোকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা

মুনতাসীর মামুন

প্রকাশ: ০৬ অক্টোবর ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০২৩ | ০৯:০৮

বিষয়টি পাশ্চাত্যে বহুল চর্চিত, যা নিয়ে আমরাও কমবেশি আলোচনা করি। প্রাচ্যে বহুমত চর্চার বিষয়টি অপেক্ষাকৃত নতুন। এশিয়ার অধিকাংশ দেশে ছিল ঔপনিবেশিক শাসন। সেখানে বাধ্য হয়ে কখনও কখনও তারা সীমিত গণতন্ত্রের পথ উন্মুক্ত করেছিল। যেমন, ভারত। এবং এসব দেশে, রাজনীতিতে তারা ঔপনিবেশিক মনমানসিকতা প্রোথিত করতে পেরেছে।

আমাদের এখানে গণতন্ত্রের কথা বললেই অধিকাংশ বলবেন, ওয়েস্টমিনস্টার মডেলের গণতন্ত্র চাই। গণতন্ত্রের রূপ ও প্রয়োগ একেক জায়গায় একেক রকম। পাশ্চাত্যে এটিতে অভ্যস্ত। তাই তারা আমাদের সবক দেয় তাদের ধাঁচের গণতন্ত্র নির্মাণে। এর সঙ্গে নতুন অনুষঙ্গ যুক্ত হয়েছে ‘মানবাধিকার’। এ মানবাধিকার তারা তাদের মতো চর্চা করে। একটি উদাহরণ দিই। ‘অধিকার’ মামলার রায় হয়েছে। তারা মিথ্যা প্রচার করেছিল, এটি প্রমাণিত হয়েছে। ‘অধিকার’ আওয়ামীবিরোধী একটি প্রতিষ্ঠান। তাতে আপত্তি নেই। আপত্তি, বিএনপি জোটের ধর্মাশ্রয়ী মনোভাবের অনুসরণ।

‘অধিকার’ হেফাজতের কল্পিত ‘শহীদ’ সংখ্যা প্রচার করতে লাগলে, শাহরিয়ার কবিরের নেতৃত্বে নির্মূল কমিটি ‘শহীদদের’ বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ নেয় এবং দেখায় যে ‘অধিকার’-এর বয়ান সম্পূর্ণ বানোয়াট। এখন পাশ্চাত্যের কয়েকটি দেশ এই রায়ে আপত্তি জানিয়েছে। কেউ প্রশ্ন করেনি, গণতান্ত্রিক সমাজে মিথ্যা রটনার অধিকার আছে কিনা? মিথ্যা রটনা অন্যের মানবাধিকার লঙ্ঘন করে কিনা? আজ শক্তি ও অর্থ নির্ধারণ করছে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের সংজ্ঞা।

কমিউনিস্ট রাষ্ট্রে কিছুদিনের জন্য মাও সে তুং ‘শত ফুল ফুটতে দাও’ স্লোগান চালু করেছিলেন, অর্থাৎ বহুমতের চর্চা। তারপর হঠাৎ তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। গত শতকের নব্বইয়ের দশকে প্রথম যখন চীনে গেলাম, তখন আমাদের বোঝানো হয়েছিল, চীনে বহুমত বিদ্যমান। আমাদের সঙ্গে বেশ কয়েকজনের আলাপ করিয়ে দেওয়া হলো বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ব্যক্তিদের। বলা বাহুল্য, এসব রাজনীতিবিদ বা রাজনৈতিক দলের নামও আমরা শুনিনি। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বহুমতের চর্চা সম্ভব। পাশ্চাত্য এই ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পেরেছে, অন্যরা নয়। ভারতে একসময় বহুমতের চর্চা ছিল। ঐ সময় যারা নেতৃত্বে ছিলেন তারা পাশ্চাত্য শিক্ষায় ছিলেন শিক্ষিত, লিবারেল চিন্তাধারার মানুষ। শুধু কমিউনিস্টদের তারা সহ্য করতে পারতেন না, কিন্তু রাজনীতি করার অধিকার তাদের ছিল। সে ভারতে এখনও গণতন্ত্র আছে কিন্তু মুসলমানরা অস্পৃশ্য। পাকিস্তানে যেমন হিন্দুরা। শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধদের সব মাফ; তামিল, মুসলমানদের সব মাফ নয়। মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে, একটি রাষ্ট্রে কি সংখ্যাগরিষ্ঠরাই নির্ধারণ করবে গণতন্ত্রের মত ও পথ কেমন হবে? আমাদের দেশের কথায় আসি। বঙ্গবন্ধু যে রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে গণতন্ত্র রেখেছিলেন তার একটা কারণ আছে। পাকিস্তান ঔপনিবেশিক শাসনে বহুমত শাসকরা মানতে চাননি। সংসদীয় ব্যবস্থা এসেছিল ভারতের ব্যবস্থার উত্তরাধিকার সূত্রে।

কিন্তু যেহেতু তা ছিল ঔপনিবেশিক শাসন, সেজন্য কেন্দ্রের অবাঙালিরা তা মানতে চায়নি। সেখানে মুসলিম লীগের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ঘোষণা করেছিলেন, ‘যো আওয়ামী লীগ করেগা উসকা শির কুচাল দেঙ্গা।’ কমিউনিস্টদের প্রায় পুরোটা সময় কাজ করতে হয়েছে আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকে। বিরোধীদের জীবনের একটা সময় জেলে থাকতে হয়েছে। সামরিক শাসন সে ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছিল। বাংলাদেশে মতামতের সহাবস্থানের একটি ঐতিহ্য ছিল সেই প্রাচীন আমল থেকেই। না হলে, এত ছোট ভূখণ্ডে এত মতামত পাশাপাশি অবস্থান করতে পারত না। স্বাধীন বাংলাদেশে সে অবস্থায়ই ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুই একমাত্র গণতান্ত্রিক নেতা, যিনি রাজনীতিতে ধর্মের অনুপ্রবেশ এবং ধর্মভিত্তিক দল নিষিদ্ধ করেছিলেন। বহু মতামত প্রবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে এক ধরনের মতামত নিষিদ্ধকরণের একটা ডিফেন্স তো আছেই।

তাঁর এবং সংবিধানপ্রণেতাদের মনে হয়েছিল, রাজনীতিতে ধর্ম আনয়নের কারণে সিকি শতক তাদের ওপর নির্যাতন হয়েছে। সুতরাং, গণতন্ত্রের স্বার্থে তা নিষিদ্ধ থাক। অন্যদিকে, ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞায় আবার যার যার ধর্ম পালনে অধিকার দেওয়া হয়েছে। আজ ৫০ বছর পর ফিরে দেখলে মনে হয়, এ ব্যবস্থার একটি ইতিবাচক দিক ছিল। রাজনীতিতে বহুমত থাকতে বাধা নেই, কিন্তু ধর্ম রাজনীতিতে আসবে না। বাকশালের আগে বঙ্গবন্ধু সব মতামতকে সহ্য করেছেন, হুমকি-ধমকি দিয়েছেন; কিন্তু জাসদ হোক বা কঠিন বাম-ই হোক, তিনি তাদের মতামত সহ্য করেছেন। কিন্তু সে মতামত জীবনযাপনের হুমকি, রাষ্ট্রের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ালে তিনি বাকশাল ছাড়া অন্য পথ খুঁজে পাননি। জিয়াউর রহমান সে ব্যবস্থা ভেঙে নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন পাকিস্তানের আদলে। সে কারণে, পরাজিত ও রাজনীতিতে ব্যর্থ শক্তিদের নিয়ে দল করেন; এরশাদ, খালেদা জিয়াও সেই ব্যবস্থা অক্ষুণ্ন রাখেন।

ক্রমে তারা পরিচিত হয়ে ওঠে ‘স্বাধীনতাবিরোধীদের দল’ হিসেবে। এখানে এ প্রশ্নটা জরুরি, একটি দেশ স্বাধীন হয়ে গেলে, সেখানে বহুমতের পরিপ্রেক্ষিতে ‘পরাজিত দল’গুলো গণতন্ত্রে থাকতে পারে কিনা? পৃথিবীর কোথাও তা স্বীকৃত হয়নি। বাংলাদেশে তা হয়েছে। সেদিক থেকে বহুমতের ক্ষেত্র হিসেবে বাংলাদেশ অসম্ভব এক নজির স্থাপন করেছে। কিন্তু সে নজির রাষ্ট্র সমাজের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এক অস্বাভাবিক রাষ্ট্রের সৃষ্টি করা হয়েছে। পৃথিবীতে কোনো রাষ্ট্রে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি রাজনীতি/গণতন্ত্র বহুমত-চর্চা করতে পারে না। কেননা, সেই মতাদর্শ সমাজ রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে হুমকি হয়ে উঠতে পারে। নাজি বা ফ্যাসিবাদ এ কারণেই নিষিদ্ধ।

বাংলাদেশে প্রত্যক্ষভাবে জামায়াতে ইসলামী পরোক্ষভাবে বিএনপি এবং ধর্মাশ্রিত দল ও গ্রুপ এ ধরনের সমাজ ও রাষ্ট্রবিরোধী মতের প্রতিনিধি। ফলে এ দেশে সুস্থভাবে বহুমতের চর্চা ও কার্যকর গণতন্ত্রের আশা দুরূহ। ১০০ বছর পর যদি এ ধরনের দলের মতাদর্শ পরিবর্তন হয় বাংলাদেশের আদর্শের [মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ] সঙ্গে সাযুজ্য থাকে, তাহলে হয়তো স্বাভাবিক অবস্থা ফিরবে বাংলাদেশে। ধর্ম রাজনীতিতে আনলে রাষ্ট্র কীভাবে ব্যর্থ হয় তার নজির শুধু পাকিস্তান বা আফগানিস্তানই নয়; নেপাল এ কথা মনে রেখে রাজার প্রস্থানের পর ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ খেতাবটি বাতিল করেছিল।

বহুমত গ্রহণীয় কিন্তু একটি পর্যায় পর্যন্ত। যেমন, গণতন্ত্রও অবাধ নয়। কিছু অলিখিত বিধিনিষেধ থাকে। অবশ্যই এ দেশের নাগরিক হিসেবে আমি বহুমত সমর্থন করব যেখানে পরাজিত ঘাতক শক্তি, ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রগঠনের ঝোঁক পরিত্যাজ্য থাকবে। গণতন্ত্রের কারণেও তাদের এ ধরনের মতামতের চর্চা নিষিদ্ধ করা উচিত। বহুমতের চর্চা যত আকর্ষণীয়ই হোক না কেন, এশিয়ার বিভিন্ন দেশে নানা কারণে সম্ভবপর হওয়া দুরূহ। বিরোধীদের কণ্ঠ রোধের জন্য সব সময়ই এখানে জেলের ব্যবস্থা থাকবে। এশিয়ানদের মানস জগতের হয়তো এটি একটি বৈশিষ্ট্য। মুসলমানগরিষ্ঠ দেশগুলোতে পরিপূর্ণ গণতন্ত্র খানিকটা অসম্ভব। কারণ, ইসলামের ইতিহাসে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কোনো ঐতিহ্য ছিল না। আমাদের দেশে বঙ্গবন্ধু সে বৃত্ত ভেঙেছিলেন। ১৯৭৫ না হলে হয়তো সে ব্যবস্থা দৃঢ় হতো। প্রকৃত গণতন্ত্রে আজকের যেটি সবচেয়ে বড় সমস্যা সেটি কমত। কিন্তু উপমহাদেশে সে ঐতিহ্য সৃষ্টি করা যায়নি। ধর্ম ব্যবহার করে ধর্মরাষ্ট্র গড়া যেতে পারে কিন্তু সেখানে গণতন্ত্র বা বহুমতের স্থান হবে না। ভারতে যে অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে তাতে অন্তিমে ভারত দুর্বলই হয়ে পড়বে।

আমাদের ইতিহাসের, ঐতিহ্যের পটভূমিকায় বলতে পারি, বহুমতের পাশাপাশি অবস্থান মৌলবাদকে নিরুৎসাহিত করেছে যে কারণে, উনিশ শতকে অনেক চেষ্টার ফলেও এখানে ওহাবিবাদ স্থান করে নিতে পারেনি এখনও। এখানে অনার্য সংস্কৃতিতে এখনও প্রভাবান্বিত হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ মন। মুক্তিযুদ্ধের সময়, বাঙালি আত্মপরিচয় ধর্মকে হটিয়ে মানস জগতে স্থান করে নেওয়ায় ঐক্যবদ্ধভাবে যুদ্ধ করা গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু সেই দৃষ্টিভঙ্গিতে জীবনচর্যার অঙ্গীভূত করতে চেয়েছিলেন, পারেননি। উল্লিখিত দুই ঐতিহ্য সামনে রেখে এগোতে গেলে অবশ্যই প্রথমে ‘স্বাধীনতাবিরোধী’ মনোভাবাপন্ন দলগুলোকে প্রতিরোধ করতে হবে। ক্ষমতায় আরও দু’একবার আসতে না পারলে এ ধরনের দল নিতান্তই দুর্বল হয়ে পড়বে। এবং সরকারে ডান পন্থার ঝোঁক নয় [আওয়ামী লীগ হলেও] মধ্যবামের ঝোঁক থাকতে হবে, যেটি বঙ্গবন্ধুর সময় ছিল। হয়তো সময়ের ব্যাপার, কিন্তু তরুণরা চেষ্টা করলে সাফল্য আসবে। আমরা কি ৪০ বছর যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য মাটি কামড়ে পড়ে থাকিনি?

লেখক প্রাবন্ধিক শিক্ষাবিদ 

আরও পড়ুন

×