’৭২-এর সংবিধানে ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানের ২৩ বছরের শোষণ-পীড়নের কারণে। এমনকি ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত যাবতীয় যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও গণহত্যার মতো ভয়ংকর অপরাধগুলোকে বৈধতা দেওয়া হয়েছিল ইসলামের দোহাই দিয়ে। ’৭২-এর সংবিধান গৃহীত হওয়ার প্রাক্কালে গণপরিষদে প্রদত্ত ভাষণে (৪ নভেম্বর, ১৯৭২) বঙ্গবন্ধু স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, ধর্মের পবিত্রতা রক্ষার পাশাপাশি ধর্মের নামে শোষণ-পীড়ন-বৈষম্যের অবসান ঘটানোর জন্য ধর্মকে রাষ্ট্র ও রাজনীতি থেকে পৃথক রাখতে হবে। একটি মানবিক ও কল্যাণ সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের জন্য বাংলাদেশের মূল সংবিধানে ধর্মের নামে রাজনৈতিক বা যে কোনো সংগঠনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। জেনারেল জিয়া এই নিষেধাজ্ঞা তুলে দিয়ে জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম ও মুসলিম লীগের মতো মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক দলগুলোকে বাংলাদেশে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছেন; যেসব দল মুক্তিযুদ্ধকালে ধর্মের নামে গণহত্যা, গণধর্ষণসহ মানবতাবিরোধী যাবতীয় অপরাধকে বৈধতা দিয়েছিল। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য– স্বাধীনতা লাভের ৫২ বছরে অধিকাংশ কাল প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দেশটি শাসন করেছে স্বাধীনতাবিরোধী-মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক অপশক্তি। এদের ক্ষমতায় থাকাকালে আমরা যাবতীয় সাম্প্রদায়িক সহিংসতা এবং জঙ্গি মৌলবাদী সন্ত্রাসের উত্থান ও বিস্তৃতি প্রত্যক্ষ করেছি। অপার সম্ভাবনাময় আলোকাভিসারী একটি দেশ ও জাতিকে মধ্যযুগীয় তামসিকতার অতলগহ্বরে নিক্ষেপ করেছিল ’৭৫-পরবর্তী পাকিস্তানপ্রেমী শাসকগোষ্ঠী।
বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে আমরা দেখেছি সাময়িকভাবে পরাজিত করা গেলেও এ দেশের মানুষ কখনও পরাভব মানেনি। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সহমর্মিতা এবং ধর্মীয় সমন্বয় বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতির অন্যতম অভিব্যক্তি। চর্যাপদের যুগ থেকে এই উদারনৈতিকতা, মরমিবাদ ও ইহজাগতিকতার বোধ আমাদের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। প্রায় সাতশ বছর আগে মধ্যযুগের কবি চণ্ডীদাস (১৩৩৯-১৩৯৯ খ্রিষ্টাব্দ) লিখেছিলেন ‘শুনহ মানুষ ভাই–/ সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’
বাংলাদেশসহ এই উপমহাদেশে ইসলাম প্রচার করেছেন সুফি আউলিয়া দরবেশরা। ইসলামের ইতিহাসে আমরা দেখেছি কোনো দেশে কোনো জাতিগোষ্ঠীর ওপর তরবারির জোরে ইসলাম প্রচারের চেষ্টা কখনও ফলপ্রসূ হয়নি। সুফিদের ইসলাম সম্প্রীতির ও সহমর্মিতার সমার্থক হওয়ায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এই ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। বাংলাদেশে আদি ইসলাম প্রচারকদের অন্যতম সিলেটের হজরত শাহজালাল ছিলেন আনাতোলিয়ার (বর্তমান তুরস্ক) সুফি সাধক ও কবি হজরত জালালউদ্দিন রুমির শিষ্য। রুমির নির্দেশেই তিনি সাতশ বছর আগে এই উপমহাদেশে এসেছিলেন। রুমির একটি কালাম হচ্ছে– ‘সব ধর্মেই ভালোবাসার কথা বলা হয়েছে। ভালোবাসার কোনো ধর্ম নেই। ...আমার ধর্ম হচ্ছে ভালোবাসা। প্রতিটি মানবহৃদয় আমার উপাসনাস্থল।’ রুমি আরেকটি কালামে বলেছেন– ‘তুমি যেই হও এসো। ভবঘুরে, বিশ্বাসী, অবিশ্বাসী কিছুই যায় আসে না; তুমি এসো। আমার দুয়ার সকলের জন্য উন্মুক্ত।’ রুমির ধর্মনিরপেক্ষ মানবতা ও ভালোবাসার বাণী উপমহাদেশে সন্ত কবীর থেকে আরম্ভ করে বুল্লে শাহ, লালন, এমনকি রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকেও প্রভাবিত করেছিল। সুফি ধর্মপ্রচারকরা স্থানীয় বা লোকজ ধর্ম ও সংস্কৃতি বর্জন না করে সমন্বয় ও সহাবস্থানের কথা বলেছেন।
এ বিষয়ে ২০১৮ সালে প্রকাশিত আমার ‘বাংলাদেশ কোন পথে’ গ্রন্থে ঐতিহাসিক মন্দিরা ভট্টাচার্যের একটি উদ্ধৃতি দিয়েছিলাম– “বাংলায় অসাম্প্রদায়িক সমাজ গঠনে সুফি ও ভক্তিবাদের প্রভাব সম্পর্কে ঐতিহাসিক মন্দিরা ভট্টাচার্য তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘দশম-একাদশ শতক থেকে বাংলার গ্রামগঞ্জে যে পীর, মুর্শেদদের আগমন ঘটেছিল, তারা একবাক্যে বলত মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ নেই। এই সমতার বাণী নিশ্চয়ই মানুষের হৃদয়তন্ত্রীতে ঘা দিয়েছিল। গ্রামীণ মানুষ পরস্পরের ধর্ম নিয়ে কৌতূহলী হয়েছিল। তাই অশিক্ষিত কিন্তু পরমতসহিষ্ণু মানুষরা ধর্মের বিভেদ নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে একসঙ্গে বনবিবি, দক্ষিণ রায়, বদর পীরকে একইভাবে ডেকেছেন। তাদের দৈনন্দিন জীবনে সকলেই উপাস্য। তারা বটগাছের গোড়ায় জমা করে মানতের ঘোড়া-হাতি, পীরের মাজারে মানত করে গাছের ডালে লাল-হলুদ সুতো বাঁধে। নানা জায়গায় কদম রসুলের মকবরা, দরগার দর্শনে আসে উভয় ধর্মের মানুষ। এই সাধারণ মানুষ বনবিবি, দক্ষিণ রায়, বদর পীরের মাহাত্ম্যের কথা নানা পালাগানের মাধ্যমে প্রচার করেছে। এই মানুষরা প্রধানত প্রান্তবাসী জনগণ। অতি নিকট এই সম্পর্কের ফলে রামাই পণ্ডিত রচনা করেন ‘শূন্য পুরাণ’। নিরাকার ব্রহ্মের ধারণায় খোদ পয়গম্বর, বুদ্ধ সব একাকার হয়ে যায়।”
‘এভাবেই প্রান্তবাসী মানুষের কাছে একাকার হয়ে যায় সত্যপীর ও নারায়ণ। প্রায় সমস্ত হিন্দু গৃহে শুভক্ষণে সত্যনারায়ণের পূজা হয়। উপাচার সাধারণ মানুষ আরও অতি সাধারণভাবে সংগ্রহ করে। পার্বণে উপস্থিত থাকে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ। পূজা শেষ হয় পাঁচালি অথবা ব্রতকথায়–
হাসিয়া ফকির বলে শুন দ্বিজবর।
পুরাণ ও কোরানে নাহি কিছু মতান্তর॥
রাম ও রহিমে জেনো নাহি ভেদাভেদ।
ত্রিজগতে এই দুই জানিবে অভেদ॥
এই পাঁচালি গানগুলি মানুষের মিলনের বাণীর প্রচার করেছে কত যুগ ধরে কে জানে! কবে থেকে সেই মানুষেরা পরস্পরকে শত্রু মনে করতে লাগল! কী জটিল অবস্থার মধ্যে এই পরিবর্তন সংঘটিত হলো! ভারতের ইতিহাসে যাকে আমরা প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে গর্ব অনুভব করি, সেখানে হিন্দু-মুসলমান উভয়ে একত্রিত হয়ে, দিল্লির বাদশাহকে মাথায় নিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। সেই ১৮৫৭ সালে ইংরেজকে প্রধান শত্রু বলে চিহ্নিত করেছে, সেই বাধাটি ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ পাল্টে গেল। ইংরেজ-এর বদলে হিন্দু-মুসলমান পরস্পরের শত্রুতে পরিণত হলো। ইংরেজ আড়াল থেকে ক্রমাগত ইন্ধন জুগিয়ে গেল।’ (মন্দিরা ভট্টাচার্য, ওই দেখা যায় বাড়ি আমার, দীপ প্রকাশন, কলকাতা জানুয়ারি ২০১৭)
মন্দিরা ভট্টাচার্যের বহু আগে ফকির দুদ্দু শাহও লিখেছেন– ‘শুধু রে ভাই জাতাজাতির দোষে, ফিরিঙ্গিরা রাজা হল এ দেশে এসে/ হিন্দু বৌদ্ধ জৈন মুসলমান পরস্পরে হিংসায় দিল প্রাণ/ তাই তো পাদ্রী খ্রিষ্টান যিশুখ্রিষ্টের দ্বিন প্রকাশে।/ কোটি কোটি ভারতবাসী এক হয়ে রইল না মিশি/ কয়জন ফিরিঙ্গি আসি, এ দেশে জুড়ে বসে।’
দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, ওহাবি-সালাফিরা ধর্মের নামে রাজনীতি করতে গিয়ে যাবতীয় সন্ত্রাস, হত্যা, নির্যাতনকে বৈধতা দিয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে ১৯৭১ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটলেও সে দেশটি আজ ধর্মীয় মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত ছোবলে জর্জরিত। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালে ধর্মনিরপেক্ষতার বোধ নেতৃবৃন্দের ওপর কেউ চাপিয়ে দেয়নি। বঙ্গবন্ধু তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এবং অন্যান্য রচনাবলি ও ভাষণে মুক্তিযুদ্ধের অনেক আগে থেকেই ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বলেছেন। অসাম্প্রদায়িক মানবতার বোধ আমাদের হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অন্তর্গত। ১৯৭৫-এর পর থেকে পাকিস্তানপন্থি শাসকরা তাদের যাবতীয় দুষ্কর্মকে বৈধতা দেওয়ার জন্য সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতির ইসলামীকরণের উদ্যোগ নিয়েছেন, যার কালো থাবা থেকে আজও নিষ্কৃতি মেলেনি। বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগও এখন ধর্মের নামে রাজনীতি করতে কুণ্ঠাবোধ করছে না। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ ও বিপক্ষ শক্তি এই একটি ক্ষেত্রে এক হয়ে গেছে, যা বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনার ওপর হতাশার কৃষ্ণপক্ষ সেঁটে দিয়েছে।
পৃথিবীর প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান রচনার কৃতিত্ব নিঃসন্দেহে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দাবি করতে পারে। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এই সংবিধানের অন্যতম রচয়িতা টমাস জেফারসন বলেছিলেন– ‘ধর্ম ও রাষ্ট্রের মাঝখানে দেয়ালস্বরূপ’। ২০০৮ সালে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আমন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. অস্টিন ডেসি বাংলাদেশে এসেছিলেন। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের তুলনামূলক আলোচনায় তিনি বলেছিলেন, ধর্মনিরপেক্ষতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সংবিধান যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে উন্নত ধর্মনিরপেক্ষতার বোধ প্রতিষ্ঠার জন্য ধর্মকে শুধু রাষ্ট্র নয়, রাজনীতি থেকেও পৃথক করেছে। আমাদের আগে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের বাইরে মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের তুরস্ক ছাড়া পৃথিবীর কোনো দেশ ধর্মের নামে রাজনৈতিক দল বা অন্য কোনো সংগঠনের ওপর সাংবিধানিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারেনি।
স্বাধীনতার ৫২ বছর অতিক্রান্ত হতে চলেছে। আর্থসামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ব্যাপক উন্নয়ন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। মধ্যপ্রাচ্যে জনশক্তি রপ্তানি করে বাংলাদেশ বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করছে। আমাদের মাথাপিছু আয় ও জিডিপি ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ সবই ইতিবাচক দিক– এতে কোনো সন্দেহ নেই। চার দশক ধরে বাংলাদেশের পেট্রো ডলারের আগমনের পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের ওহাবি সালাফি সংস্কৃতির আমদানি যেভাবে ঘটছে, বাঙালির হাজার বছরের সম্প্রীতি ও সম্মিলনের মানবিক সংস্কৃতির নাভিশ্বাস উঠেছে। বাংলাদেশের ওয়াজ ব্যবসায়ীরা যেভাবে ইসলামের নামে ভিন্নমত, ভিন্নধর্ম, ভিন্ন জীবনধারায় বিশ্বাসী মানুষ এবং বিশেষভাবে নারী স্বাধীনতার প্রতি বিষোদ্গার করছে, ধর্মের নামে সমাজে যেভাবে সন্ত্রাস, বৈষম্য, নির্যাতন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন– বিশেষভাবে মানবাধিকার প্রচণ্ড হুমকির মুখে।
ওহাবি-সালাফি মতাদর্শের সূতিকাগার সৌদি আরব যখন যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য মধ্যযুগীয় তামসিকতার অবসান ঘটাতে চাইছে, বাংলাদেশের আলোকাভিসারী মানুষ তখন মধ্যযুগে ফিরে যেতে চাইছে। শুধু ধর্মান্ধ রাজনৈতিক দল বা পেশাজীবী ধর্ম ব্যবসায়ীরা নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থেকে আরম্ভ করে জাতীয় ক্রিকেট দলের তারকা খেলোয়াড় পর্যন্ত প্রকাশ্যে তালেবানি সংস্কৃতি প্রচার করছেন, যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থি; ৩০ লাখ শহীদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি। সরকার এসব ক্ষেত্রে দুর্ভাগ্যজনকভাবে নির্লিপ্ত। এভাবেই হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের সকল স্বপ্ন ও সম্ভাবনা। রবীন্দ্রনাথের গানের ভাষায় বলতে পারি– ‘আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়’।
লেখক: সভাপতি, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি