পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের ‘অপরিচ্ছন্ন’ জীবন

কুমিল্লার সুজানগরে সিটি করপোরেশনের সুইপার কলোনি
কামাল উদ্দিন, কুমিল্লা
প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০১:৩০ | আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৭:১৩
ছোট্ট টিনশেড ঘর। শোবার বিছানা একটি। তাও পরিবারের চার-পাঁচ জন সদস্যকে ভাগ করে নিতে হয়। চার পাশে পূঁতিগন্ধময় স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ। স্বাস্থ্যঝুঁকির এমন পরিবেশে নাক-মুখ চেপে ঘরে ঢুকতে হয়। প্রতিটি ঘরের ফাঁকা স্থান দিয়ে দুইজন লোকও একসঙ্গে হেঁটে যাওয়া কষ্টকর। নেই পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থা। এমনই মানবিক বিপর্যস্ত অবস্থা কুমিল্লা সিটি করপােরেশন নিয়ন্ত্রিত সুইপার কলোনি। ওই কলোনিতে বর্তমানে তিনশ পরিবারের নারী-শিশু, বয়স্কসহ সাত শতাধিক লোকের বসবাস। তাদের কেউ সুইপার, কেউবা ঝাড়ুদার পদে অস্থায়ী ভিত্তিতে সিটি কর্পোরেশনে চাকরি করেন। পরিবারের সদস্যদের কেউ কেউ অন্য পেশায়ও জড়িত। সুইপার কলোনি ঘুরে দেখা গেছে, নগর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা যাদের দায়িত্বে তারাই বাধ্য হয়ে অনেকটা ‘অপরিচ্ছন্ন’ পরিবেশে কষ্টে জীবন যাপন করছেন।
সরেজমিনে নগরীর চকবাজারসংলগ্ন ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের সুজানগর পশ্চিম পাড়া এলাকার তামিরুল উম্মাহ আল-আরাফাত জামে মসজিদের উত্তর পাশের রাস্তা দিয়ে ভেতরে যেতেই চোখে পড়ে সারি সারি অসংখ্য টিনশেড আধা-পাকা ঘর। প্রতিটি ঘর খণ্ড খণ্ড ভাগ করা। এর ভেতরই রান্না করা, ওয়াশ রুম ও শোবার ঘর। গাদাগাদি তৈরি করা এসব ঘরেই সুইপার, ঝাড়ুদার এবং তাদের স্ত্রী-সন্তানদের জীবন কাটে। ভেতরে কলোনিবাসীর কেনাকাটার জন্য নিত্য জিনিসপত্রের দুটি দোকান আছে। কলোনিতে ঢুকতেই সামনে ১০/১২ ফুট খালি জায়গা থাকলেও পুরো কলােনিতে বাসাবাড়িতে প্রবেশের জন্য দেড়/দুই ফুট প্রশস্ত রাস্তা। বাসিন্দাদের অভিযোগ, মালপত্র নিয়ে ভেতরে ঢুকতে সমস্যায় পড়তে হয়। কেউ মারা গেলে মরদেহ বের করতেও কষ্ট হয়!
দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে এ কলোনিতে তারা থাকছেন। জনসংখ্যা বাড়লেও সেখানে বাড়ছে না জমি। ৬ তলা করে দুটি উচ্চ ভবন তৈরির কথা থাকলেও এখনও কাজের টেন্ডার আহ্বান হয়নি। আকাশ চাঁদ নামের এক ব্যক্তি বলেন, ‘সব মিলিয়ে সাড়ে ১৩ হাজার টাকা বেতন দিয়ে পাঁচ সদস্যের সংসার ও ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ কি চলে? চাকরি অস্থায়ী। অসুস্থ হলেও যেতে হয়, না হয় হাজিরা কাটা তো বেতনও নাই। কোনো উৎসবে বোনাসও পাই না। শেষ জীবনে কী করে চলবো।’ চন্দন দত্ত বলেন, ‘আমরা জন্মগতভাবে সুইপার। তাই সামাজিকতা, বিয়ে-সাদি সবই আমাদের একই গোত্রের সাথে হয়। সমাজের লোকজন আমাদের সাথে মিশে কম। কলোনির অনেকের ছেলেমেয়ে সাধ্য অনুসারে লেখাপড়া করে অন্য পেশায় যাচ্ছে। আমরা চাই না ছেলেমেয়েরাও এ পেশায় আসুক।’
সেখানকার বাসিন্দা ছায়া রানী নামের এক নারীকর্মী বলেন, তিন মেয়ে নিয়ে তাঁর সংসার। সামান্য বেতনে কোনো রকম টেনেটুনে সংসার চলে যায়। এখন চিন্তা মেয়েদের বিয়ে নিয়ে। আমি মারা গেলে সন্তানদের কে দেখবে। শুধু ছায়া রানী নন, এ কলোনি ঘুরে দেখা গেছে তাঁর মতো আরও অনেকের কষ্টের সংসার। একদিকে নোংরা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, অন্যদিকে প্রকট অভাব। সেখানকার নারী-শিশুদের দুর্বিষহ জীবন। পুরুষদের পাশাপাশি নারীদের অনেকেই বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। কেউ কেউ গ্রামে গ্রামে সাপ খেলা দেখিয়ে কিংবা বাড়ি বাড়ি ঘুরে জিনিসপত্র বিক্রি করে সংসারের অভাব মেটায়। তবে অভাবের সংসারেও এ কলোনির বেশ কিছু ছেলেমেয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয় ও স্কুল-কলেজে লেখাপড়া করছে। অর্থ সংকটের কারণে অনেকেই প্রাথমিকের গণ্ডি শেষ করতে পারে না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দশম শ্রেণির এক ছাত্র বলে, আমরা সুইপার কলোনিতে বাস করি এ কথাও মুখ দিয়ে কারও কাছে প্রকাশ করি না। এ কথা জানলে কেউ আমাদের টেবিলে বসতে চাইবে না।’
ড্রেন পরিষ্কার করতে গিয়ে কষ্টের বর্ণনা করে অরুণ দাস নামের এক সুইপার বলেন, ‘মানুষ অনেক সময় ড্রেনে ধারালো জিনিস ও গ্লাস ভাঙা ফেলে দেয়, এতে আমাদের কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় হাত পা কেটে যায়। অনেকেই বাসার মলমূত্র সরাসরি পাইপের মাধ্যমে ড্রেনে ছেড়ে দেয়। এগুলো পরিষ্কার করতে হয়। মানুষ একটু সচেতন হলে আমাদের এতো কষ্ট হতো না।’
কলোনিতে বসবাস করার অযোগ্য বলে দাবি করে সুনীল দাস বলেন, তিনি ২০ বছর ধরে সুইপারের কাজ করছেন। সাড়ে ১৩ হাজার টাকার বেতন দিয়ে চলে স্ত্রী-সন্তানসহ পাঁচ জনের সংসার। মানুষের গোয়ালঘরও এর চাইতে অনেক ভালো থাকে। কুকুর-বিড়ালও তাদের ঘরে ঢুকতে চায় না। এটার নাম জীবন? আমরা কি মানুষ না? গন্ধের কারণে ভোটের সময় এলাকার জনপ্রতিনিধিরা ভোট চাইতেও আসেন না, লোক পাঠাইয়া ভোট চায়। এভাবেই আমরা বেঁচে আছি বছরের পর বছর। সোহেল লাল বলেন, আমাদের এ কলোনিতে দুটি উচ্চ ভবন নির্মাণের টাকা বরাদ্দের কথা শুনেছি। ভবনগুলো নির্মাণ হলে আমাদের থাকার সমস্যা দূর হবে। শুনেছি এ বছরই কাজ শুরু হবে। আমাদের চাকরি স্থায়ী করতে সিটি করপােরেশন কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মোঃ আলমগীর হোসেন বলেন, সুইপার, ঝাড়ুদারদের চাকরি অস্থায়ী। তাদের স্থায়ী করতে প্রতি মাসে অনেক টাকা দরকার, যা এখই সম্ভব নয়। তবে এসব কর্মীর বেতন সময় সময় বাড়ানো হয়। ওই কর্মকর্তার ভাষ্য, কর্মীদের অসুস্থতা, সন্তানদের লেখাপড়া ও বিয়ের সময় আবেদন করলে সিটি করপােরেশন থেকে সহায়তা করা হয়ে থাকে।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আবু সায়েম ভূঁইয়া সমকালকে বলেন, সুইপারদের আবাসন ব্যবস্থার উন্নয়নে ৪৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ছয় তলাবিশিষ্ট সেবক কলোনি নামের দুটি ভবন নির্মাণে এ বছরই টেন্ডার আহ্বান করা হবে। দুটি ভবন নির্মাণ শেষ হলে কর্মীদের আর আবাসন সমস্যা থাকবে না।
- বিষয় :
- পরিচ্ছন্নতাকর্মী