বঞ্চনা আর উপেক্ষা নিত্য সঙ্গী

লালমনিরহাটের হরিজন সম্প্রদায়ের স্যানিটেশন কর্মীরা
আনোয়ার হোসেন স্বপন, লালমনিরহাট
প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০১:৩২ | আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৭:১০
লালমনিরহাট বিভাগীয় রেলওয়ে শহর হওয়ায় হরিজন সম্প্রদায়ের বেশি মানুষ এখানে বসবাস করেন। জেলার পাঁচ উপজেলায় এই সম্প্রদায়ের প্রায় ১২ হাজার মানুষ রয়েছে। সমাজে তাঁরা নানা বৈষম্যের শিকার। শহরের রেলওয়ে স্টেশন সংলগ্ন ড্রাইভার পাড়া এলাকায় কথা হয় স্যানিটেশন কর্মী নিমির (৩৫) সঙ্গে। নিমি দীর্ঘ ২৩ বছর যাবত লালমনিরহাট পৌরসভায় ঝাড়ুদার হিসেবে কাজ করছেন। শুরুতে তাঁর মাসিক বেতন ছিল মাত্র ছয়শ টাকা। এখন তা বেড়ে তিন হাজার টাকা হয়েছে। তিনি জানান, স্বামী নিমাই মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে মাসিক দুই হাজার টাকা বেতনে চাকরি করত। সম্প্রতি ওই চাকরি তাঁর চলে গেছে। তাঁদের এই আয়ে সংসার চলছে না।
ষাটোর্ধ্ব মজরী ও বিজলী ড্রাইভার পাড়া সুইপার কলোনিতে বসবাস করেন। থাকার জায়গা বলতে ঝুঁপড়ির মতো একটি ঘর। এখানেই তাদের জন্ম। বংশ পরাম্পরায় তাঁরা এই কাজ করছে। অন্য সবার মতো মজরী ও বিজলী ভোরের আলো না ফুটতে ঝাড়ু নিয়ে ছোটেন রাস্তা ঘাট পরিস্কার করতে। ভোর সাড়ে চাঁরটা থেকে সাড়ে ছয়টা-সাতটার মধ্যে কাজ শেষ করে হোটেলে নাস্তা সেরে বাড়িতে ফিরেন। দীর্ঘ ৫০ বছর যাবত নিরবিচ্ছিন্নভাবে স্যানিটেশনর কাজ করছেন। একদিন কাজে না গেলে একশ টাকা জরিমানা গুনতে হয় তাদের।
মজরী ও বিজলী জানান, হরিজন সম্প্রদায়ের লোকজন শহর স্যানিটেশনর কাজ করে। তাঁরা স্যানিটেশনর কাজ না করলে শহর দূর্গন্ধময় হয়ে যাবে। মানুষজন অসুস্থ হয়ে পড়বে। অথচ স্যানিটেশনকর্মীরা সমাজে অবহেলিত। সুইপার বলে তাঁদের গালি দেয়। রেস্টুরেন্টে বসতে দেয় না। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তাদের বসবাস। তিন সন্তানের মা রেখাও স্যানিটেশন কর্মী। তাঁর সঙ্গে এক ছেলে ও এক মেয়ে পৌরসভায় কাজ করে।
ছোট মেয়ে অনিকা পৌর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে। রেখা এক বুক কষ্ট নিয়ে বলেন, তারা সামাজিক বৈষম্যের শিকার। ভালো স্কুলে বাচ্চাদের পড়ার সুযোগ নেই। রেন্টুরেন্টে বসে খাওয়া নিষেধ। রোদে, বৃষ্টিতে ভিজে হোটেলের বাইরে বসে পত্রিকার পাতায় খাবার খেতে হয়। পানি দেয় ভাঙা গ্লাসে। তাও আবার ওপর থেকে পানি ঢেলে দেয় হোটেলের লোকজন। যাতে করে শরীরে কোনো স্পর্শ না লাগে। পুরুষ সদস্য কমলা (২৭) ও বিশাল পৌরসভায় ড্রেন পরিষ্কারের কাজ করে থাকেন। চার হাজার টাকা মজুরিতে সকাল নয়টা থেকে বারোটা পর্যন্ত কাজ করেন তারা। অন্য সবার মতো তাঁরাও সামাজিক বৈষম্যের কথা বলছেন। দেশের নাগরিক হয়েও তারা নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন বলে দাবি করেন।
লালমনিরহাটের স্যানিটেশন কর্মীদের (হরিজন সম্প্রদায়) নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল আলিমের একটি ফেসবুক পোস্ট ভাইরাল হয় গত বছরের ৩ জুন। মানবাধিকার কমিশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে দুটি ছবি দিয়ে তিনি লিখেন, এখনও কৈলাশদের রেস্টুরেন্টের বাইরে খেতে হয়। বিষয়টি তৎকালিন মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন বিষয়টি আমলে নিয়ে একে অনভিপ্রেত ও মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন বলে লালমনিরহাট জেলা প্রশাসককে তদন্তের নির্দেশ দেন। সে আলোকে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক টি এম এ মমিনকে আহবায়ক করে এক সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠিত হয়।
তৎকালীন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ উল্ল্যাহ মতবিনিময় সভা করে হোটেলে বসে খাওয়ার সুযোগ করে দিতে ব্যবসায়ী, হোটেল মালিকদের দিকনির্দেশনা দেন। ওই বছরের ১৮ জানুয়ারি মানবাধিকার কমিশনে তদন্ত প্রতিবেদন পাঠায় জেলা প্রশাসন। ওই তদন্ত প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে অধ্যাপক আব্দুল আলিম কমিশনকে লিখেন, বাস্তবে জেলা প্রশাসকের বক্তব্য সঠিক হলে তিনিসহ হরিজন সম্প্রদায়ের লোকজন খুশি হতেন। প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা ও কার্যকর পদক্ষেপের অভাবে এখনও সমাজে বৈষম্যমূলক আচরণ বিদ্যমান। তিনি হরিজনদের অধিকার রক্ষায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে সরাসরি তদন্তের অনুরোধ জানান।
অধ্যাপক আব্দুল আলিম তাঁর ফেসবুকে পোষ্ট করা ওই দুটি ছবি সম্পর্কে জানান, ওই দিন তীব্র শীতে হোটেলের পাশে খোলা আকাশের নিচে কৈলাশ বাসফোর তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে খাবার খাচ্ছিলেন। পত্রিকার কাগজের ওপর রুটি-ভাজি, সামনে ভাঙা গ্লাস। বিষয়টি তাঁকে নাড়া দেয়। মর্মাহত হয়ে মানবাধিকার কমিশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ফেসবুকে পোস্ট দেন বলে জানান তিনি। এ নিয়ে সমকাল পত্রিকায় ওই সময়ে তিনটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
অধ্যাপকের ফেসবুকে পোস্ট, মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যানের উদ্বেগ ও তদন্তের নির্দেশ, যথারীতি তদন্ত কমিটি গঠন, জেলা প্রশাসনের উদ্যোগ গ্রহণ। তারপরেও পরিবর্তন ঘটেনি তাদের অবস্থার, কমেনি বৈষম্য। লালমনিরহাটের স্যানিটেশন কর্মীদের আবাসস্থল শহরের স্টোরপাড়া ও ড্রাইভারপাড়া সরেজমিনে ঘুরে এর সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়। লালমনিরহাটের স্যানিটেশন কর্মীরা সবাই হরিজন সম্প্রদায়ের।
লালমনিরহাট জেলা হরিজন বাসফোর সম্প্রদায়ের সভাপতি শ্রী রংলাল ও সাধারণ সম্পাদক গুগলো বাবু বাসফোর বলেন, স্যানিটেশন কর্মীরা সামাজিক বৈষম্যের শিকার। তাদের অবহেলা ও ঘৃণা করা সামাজিক প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নেতারা প্রয়োজনে আমাদের সঙ্গে চা খান। ভোট গেলে গা ঘেঁষতেও দেন না। তবে হরিজন সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েরা এখন স্কুল কলেজে পড়াশোনা করছে। এটা ভাল লক্ষণ বলে তারা মনে করছেন।
- বিষয় :
- সঙ্গীর ব্যক্তিত্ব
- স্যানিটাইজার