ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

‘মানুষের মতো বাঁচতে চাই’

‘মানুষের মতো বাঁচতে চাই’

খুলনার পাইকগাছা পৌরসভার স্যানিটেশন কর্মী লক্ষ্মী সরকার

শেখ হারুন অর রশিদ, কয়রা (খুলনা)

প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০১:৩৫ | আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৭:০২

দশ বছর আগে কাজের সন্ধানে মোংলা থেকে পাইকগাছায় এসেছিলেন মারকুস সরকার। সেখানে তাঁর এক আত্মীয়ের মাধ্যমে পৌরসভার স্যানিটেশন কর্মীর কাজ পান। দৈনিক দুইশ টাকা মজুরি দিয়েই কর্ম জীবন শুরু করেন তিনি। এখন পাচ্ছেন সাড়ে তিনশ টাকা। এ টাকায় চারজনের সংসার চলছে টেনেটুনে।
মারকুস সরকার বলেন, ‘দশ বছর আগে দুইশ টাকায় স্বামী-স্ত্রী দু’জনের দিন চলে যেত মোটামুটি। এখন মজুরি বাড়লিও সংসারে লোকও বাড়িছে। সেই সাথে জিনিসপত্রের দামও বাড়তি। মজুরির টাকায় দিন পার করা মুশকিল।’

মারকুসের স্ত্রী লক্ষ্মী সরকার বলেন, ‘স্বামী যে কাজ করেন তাতে কোনো আক্ষেপ নেই। আক্ষেপ সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি কইরে যা টাকা পান তা দিয়া ভাল খাবার জুটাতি পারি না। তার মধ্যি ঘর ভাড়া, ছাওয়াল-মাইয়ের পড়ালেখার খরচ কুলায়ে উঠতি কষ্ট হয়।’

এমন অবস্থা খুলনার পাইকগাছা পৌরসভার ২০ জন স্যানিটেশন কর্মীর পরিবারের। স্যাঁতসেঁতে ঘরে কীট-পতঙ্গের মতো বসবাস তাদের। খাবার টানাটানিতে এসব পরিবারের সন্তানরা ভুগছে পুষ্টিহীনতায়। অনেকেই সন্তানদের লেখাপড়া শেখাতে চাইলেও টাকার অভাবে পেরে উঠছেন না। ঝড়-বৃষ্টি, শীত উপেক্ষা করে তারা শহরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখেন। গভীর রাত থেকে সকাল পর্যন্ত শহরের অলি-গলিতে নির্ভীক সৈনিকের মতো কাজ করেন। কিন্তু এই মানুষগুলোই ব্যাপক অবহেলার শিকার। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করায় নানাবিধ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় অনেকেই। কিন্তু এসব কর্মী বা তাদের পরিবারের জন্য কিছুই করা হচ্ছে না। সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার আশায় স্যানিটেশন কর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে কিছু দাবি-দাওয়া জানালেও তাতে কর্ণপাত করে না কেউ।

১৩ নভেম্বর সকালে পৌরসভার বাতিখালি বাজারে গিয়ে দেখা যায়, স্যানিটেশন কর্মীদের কেউ রাস্তার পাশের আবর্জনা ঝাড়ু দিচ্ছেন। কেউ সেই আবর্জনা ভ্যানে করে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছেন। আবার কেউ নালার নোংরা আবর্জনা পরিষ্কারে ব্যস্ত আছেন। কাজের ফাঁকে কথা হয় তাদের কয়েকজনের সঙ্গে।

রানা সরকার নামে এক স্যানিটেশন কর্মী জানান, ভোর পাঁচটায় কাজে এসেছেন। একটানা ছয় ঘণ্টা কাজ করে ১১টার দিকে বাসায় ফিরবেন। গত দশ বছর এভাবে নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। মাসে কোনো ছুটি নেই তাদের। প্রথমে দৈনিক ১৫০ টাকা মজুরি পেতেন। সে সময় শীতের পোশাক ও সাবান-সোডা দেওয়া হতো। বর্তমানে ৩৫০ টাকা মজুরি হলেও শীতের পোশাক ও সাবান দেওয়া হয় না।

রানা সরকার বলেন, ‘আমার এই কষ্টের জীবন সন্তানরা যেন না পায়, সে জন্যি মেয়েডার পৌরসভার ভাল ইসকুলি পড়াচ্ছি। সে এখন ফোরে পড়ে। ছোট ছাওয়ালডাও ইসকুলি যাতি শুরু করিছে। টানাটানির মধ্যিও তাগের লেখাপড়ার খরচ চালাই যাচ্ছি।’

ভ্যানে করে ময়লা নিয়ে যাচ্ছিলেন সুশীল মণ্ডল। তিনি বলেন, ‘আমাগের কোন ছুটি নেই। বছরের প্রতিটা দিন শহরের আবর্জনা ছাপ করি আমরা। মানুষের ঘর-বাড়ির ময়লা বহন করে নিয়া যাই আমরা। সেই আমরাই বাস করি নোংরা-আবর্জনার মধ্যি।’

পাইকগাছা পৌর এলাকা থেকে দুই কিলোমিটার দূরে মাছ বাজারের পেছনের বস্তিতে ছোট ছোট খুপরি ঘরে কম ভাড়ায় বসবাস করেন স্যানিটেশন কর্মীরা। এর মধ্যে অনেকেই মিশনের জায়গায় ঘর বেঁধে থাকছেন। সেখানে ভাড়া দিতে না হলেও বসবাসের উপযোগী নয়। পাশে নর্দমার গন্ধ ও মশা মাছির উপদ্রব সারাক্ষণ লেগে আছে। 
স্যানিটেশন কর্মী মমতা মাখাল ওই মিশনে এক খণ্ড জায়গা পেয়েছেন। ভালো ঘর বাঁধার সাধ্য নেই তাঁর। মাসের বেতনের টাকা চলে যায় নিজের ভরণ-পোষণে। সঞ্চয়ের কোনো সুযোগ থাকে না। তিনি জানান, তাঁর স্বামী তনু মাখাল পক্ষাঘাতে মারা গেছেন, ১৫ বছর আগে। সেই থেকে দুই মেয়ে মণিকা ও মল্লিকা মাখালকে নিয়ে পড়েছিলেন বিপাকে। দিনমজুরি করে বড় মেয়েকে এসএসসি পর্যন্ত পড়িয়ে বিয়ে দিয়েছেন ভালো পরিবারে। ছোট মেয়েকে পড়াতে পারেননি এ আক্ষেপ রয়ে গেছে। এ অবস্থায় এক বছর আগে পৌরসভার স্যানিটেশন কর্মীর কাজ পেয়েছেন। এখন মা-মেয়ের খাওয়া পরার খুব একটা সমস্যা নেই। তবে ভালো জীবন-যাপনের স্বপ্ন দেখেন তাঁরা।

মমতা মাখাল বলেন, ‘আমাগেরও স্বপ্ন ছিল শহরের অন্যান্য পরিবারের মতো ভালোভাবে জীবন-যাপন করার। কিন্তু আমাগের ভাগ্যটাই যেন এমন। চাইলেও তা পূরণ করবার সাধ্যি নেই।’

পৌর সচিব লালু সরদার জানান, ১৯৯৭ সালে পৌরসভার কার্যক্রম চালু হওয়ার পর ১০ জন স্যানিটেশন কর্মীকে চুক্তিভিত্তিক (কাজ নেই মজুরি নেই) নিয়োগ দেওয়া হয় সেখানে। এরপর আরও ১০ জন বাড়ানো হয়। বর্তমানে ২০ জন স্যানিটেশন কর্মী রয়েছেন। এখন পর্যন্ত তারা সকলে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগেই রয়েছেন।

স্থানীয় সমাজকর্মী মো. আসাদুজ্জামান বলেন, পরিচ্ছন্ন শহর গড়তে স্যানিটেশন কর্মীরা শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষায়-এমনকি ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। অথচ তাদের পরিবারের কোনো সুযোগ-সুবিধার কথা ভাবে না কর্তৃপক্ষ। অনেক আশা করলেও দৈনিকভিত্তিক স্যানিটেশন কর্মীদের প্রত্যাশিত ঈদ, দুর্গাপূজা, বৈশাখী ভাতা দেওয়া হয় না। এমনকি শীত ও গ্রীষ্মের পোশাক, এপ্রোন, রেইনকোট, গামবুট এবং স্যানিটেশন কাজে ব্যবহৃত মালামালও ঠিকমতো দেওয়া হয় না।
স্যানিটেশন কর্মীরা জানান, বাজারমূল্য বিচার-বিচেনায় দৈনিক মজুরি ৩৫০ টাকায় তাদের সংসার চালানো দায় হয়ে পড়েছে। এ জন্য দৈনিক মজুরি বাড়িয়ে ৬৫০ টাকা নির্ধারণের দাবি জানিয়েছেন তারা। সেই সাথে স্যানিটেশনয় কর্মরত অবস্থায় নিহতদের ক্ষতিপূরণ ও দুর্ঘটনায় আহত হলে তাদের চিকিৎসার ব্যয় বহনসহ দুর্ঘটনার ধরন অনুযায়ী ক্ষতিপূরণের দাবি তাদের।

পাইকগাছা নাগরিক কমিটির সভাপতি মোস্তফা কামাল জাহাঙ্গীর বলেন, স্যানিটেশন কর্মীদের জীবনমান উন্নয়নে তাদের বেতন-ভাতা বাড়ানো দরকার। বর্তমান বাজারমূল্য বিবেচনায় তাদের যে মজুরি দেওয়া হচ্ছে তা দিয়ে একটা পরিবারের খরচ কুলিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। সরকারের অনন্য দপ্তরে কর্মরতরা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ভোগ করলেও স্যানিটেশন কর্মীরা বঞ্চিত হচ্ছেন। তাদের সঙ্গে এমন বৈষম্য দূর করা প্রয়োজন বলে মনে করি।

বর্তমানে পাইকগাছা পৌরসভার প্রশাসক হিসেবে দায়িত্বে আছেন ইউএনও মাহেরা নাজনীন। তিনি বলেন, পৌরসভার রাজস্ব আয় থেকেই স্যানিটেশন কর্মীদের বেতনসহ অন্যান্য খরচ চালানো হয়। তাদের দৈনিক মজুরি বাড়ানোর ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এছাড়া তাদের অন্য দাবিগুলো নিয়েও ভেবে দেখবেন বলে জানিয়েছেন তিনি।

আরও পড়ুন

×