কবিতার চরিত্র
যদি সে মৃতদেহটিরে চিনিবারে পারি

.
শোয়াইব জিবরান
প্রকাশ: ০৩ জুন ২০২৫ | ২৩:৫৮ | আপডেট: ০৪ জুন ২০২৫ | ১২:২৪
দ্বৈতসত্তার ধারণা আছে অধ্যাত্মবিদ্যায়, দর্শনে, মনোবিজ্ঞানে, এমনকি পদার্থবিদ্যার সাম্প্রতিক শাখা কোয়ান্টাম মেকানিক্সে। অধ্যাত্মবিদ্যায় স্রষ্টা ও সৃষ্টিকে একই সাথে আবার পরস্পরের পৃথক সত্তা হিসেবে কল্পনা করা হয়। এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড স্রষ্টার সত্তার অংশ আবার সৃষ্টি ও স্রষ্টা পৃথক সত্তাও বটে। দর্শন আরেক কাঠি সরেস। সে বিদ্যা এমনকি ব্যক্তির মন ও শরীরকে পৃথক সত্তা হিসেবে বিবেচনা করে। যেখানে একটি ছাড়া অন্যটির অস্তিত্বই নেই। মনোবিজ্ঞানে দ্বৈতচেতনা বলে আলাদা তত্ত্ব তৈরি হয়েছে; যার ওপর ভিত্তি করে মৃগী রোগীদের চিকিৎসা পরিচালনা করা হয়। মনে করা হয়, মানুষের মস্তিষ্কের ডান ও বাম অংশ পৃথক পৃথক ভাগ। অপারেশন করে তাদের মধ্যে যোগাযোগ বন্ধ করে দিলে একই ব্যক্তির ভেতর একদম পৃথক দুটো সত্তার প্রকাশ ঘটবে; যার একটির সাথে অন্যটির যোগাযোগ বা নিয়ন্ত্রণ পর্যন্ত থাকবে না। আর কোয়ান্টাম মেকানিক্স তো ক্ষুদ্র ব্যক্তিসত্তা ছাড়িয়ে সমান্তরাল বিশ্বের (Parallel Universe) ধারণা দিয়েছে। যেখানে সমরূপ বিশ্ব একই সাথে বিরাজমান। মানে আমাদের পৃথিবীর মতো ঠিক আরেকটি পৃথিবী মহাশূন্যে অন্য কোথাও আছে। এমনকি আমার মতো আরেকজন শোয়াইব জিবরান সে পৃথিবীতে বসে এই সময়ে একই লেখা লিখেছে! বেশ বিদঘুটে আর গোলমেলে ব্যাপার। তাতে সমস্যা নেই। কিন্তু সমস্যা তখনই সৃষ্টি হয়, যখন স্রষ্টা গল্পটি লিখতে গিয়ে নিজেই সে গল্পের ভেতর ঢুকে পড়েন। গল্পের ভেতর আটকা পড়েন। চরিত্র হয়ে ওঠেন।
আখ্যানে সেটি সহজে চিহ্নিত করা যায়। সে চিহ্নিত করার হাতিয়ারটির নাম পয়েন্ট অব ভিউ। কার দৃষ্টিতে লেখা হয়েছে বা বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু টুলটি যে সব সময় নিশ্চিতভাবে কাজ করে, এমনটি নয়। তাই আমরা নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি না অপু কি নিজেই বিভূতিভূষণ, মিসির আলী কি হুমায়ূন আহমেদের যুক্তিবাদী আর হিমু কি বাউণ্ডুলে সত্তা? সে তর্ক আপাতত তোলা থাক। অখনে কথাসাহিত্য বাদ দিয়ে কবিতায় যাওয়া যাক।
আমাদের হাতে আসা পৃথিবীর প্রাচীন অন্যতম কবিতাটি একজন নারীর লেখা। তাঁর নাম সাফো। তিনি লেসবন নামক শহরে বাস করতেন। অনেকে মনে করেন লেসবিয়ান শব্দটি সে শহরের নাম থেকে এসেছে। সাফো ছিলেন মন্দিরের দাসী। তাঁর কবিতাটিতে একজন নারীর প্রতি আরেকজন নারীর ভালোবাসার প্রকাশ ঘটেছে। তাতে কি আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে পারি সাফো নিজে সমকামী ছিলেন? নাকি তিনি তাঁর অপর সহকর্মীদের নিয়ে লিখেছিলেন? নাকি নিজের অজানা কোনো সত্তা নিয়ে লিখেছিলেন? আমরা ঠিক উত্তরটি নিশ্চিত করে বলতে পারব না। কবিতা সাধারণত কী কী নিয়ে লেখেন, এর একটি তালিকা করতে বললে একজন সাধারণ মানুষও বলবেন, ফুলপাখি, নদীনালা, নারী, দেশ ও মানুষকে নিয়ে লেখেন। আসলেই কি তাই? আমার তো মনে হয়, কবিরা এগুলোর কোনোটাকেই নিয়ে লেখেন না। লেখেন একটি বিষয় নিয়েই। নিজেকে লেখেন। গল্প বা উপন্যাসে যেমন অসংখ্য চরিত্র থাকে। তার মধ্যে একটি প্রধান চরিত্রও থাকে। কবিতারও তেমনি প্রধান চরিত্রটি কবি নিজে। বাকিগুলোও তাঁরই চূর্ণ।
২.
নব্বই দশকের আমার পরিচিত এক তরুণের কবিতার উদাহরণের মাধ্যমে আমরা বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করতে পারি। তার কবিতায় নগরে সদ্য আসা একটি তরুণকে দেখতে পাই। যে নগর বিদ্যালাভে এসে সব হারিয়ে নিজেকে শেখ ফরিদের সাথে উপমিত করছে। লিখছে– শেখ ফরিদের জীবন। চক্ষু দুটো দিয়েছি তাকে। অন্ধতা নিয়ে আজ তোমার দরোজায়। পুত্র ফিরেছি মা গো, দোয়া ইউনুস পড়ে তোমারে যে ডাকি, দ্বার খুলে দাও। জ্ঞান লাভে যে পুত্র শহরেতে যায়, সে মানুষ থাকে না, তার দেহ থাকে না, হৃদয় থাকে না, ঈমান থাকে না, শুধু কাকের ঠোঁটের মতো তীক্ষ্ণ বেঁচে থাকার নখর ইচ্ছে ছাড়া। (শেখ ফরিদ)
বোঝা যাচ্ছে ছেলেটি শহরে এসে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেনি। তাই ডুব দিচ্ছে ফেলে আসা শৈশবে। কিন্তু শৈশবের সব স্মৃতিও তার কাছে ঝাপসা। সে ইশারাগুলো ধরে যেন ফেলে আসা জীবনে ঢু মারছে–
রাত্রি ছিল। রাস্তায় একা পেয়ে শুনিয়েছ গান, মানে বুঝিনি। ... ভাষা তার অর্ধ বুঝি। যিনি জেগে আছেন মাঠের ওপারে, বটগাছ নদী আর বাতাস নিয়ে। আত্মা মাঝে মাঝে পাঠাই তার খোঁজে, কী কঙ্কাল বেঁচেবর্তে থাকা, অর্ধ স্বপ্ন আর অর্ধ জাগরতা নিয়ে। দিবানিশি। ... সে ডাকে। দিঘির জলে ডুবে গেলে চাঁদের দেহ। আমি কি আর ফিরে যেতে পারি? ফিরে কি কেহ? যে ফেলে এসেছে ছায়া পথের ধুলোয়। (ছায়া এলিজি)
এই শহরকে তার ভয় লাগে। মনে হয় সে কোনো বুনো মানুষ। নিষাদের পুত্র। মাথায় পালক নিয়ে বনে শিকারে করে ক্ষুন্নিবৃত্তি মেটাত। কিন্তু শহরের রাস্তায়ই এখন সে পোশাকে বের হওয়া ঠিক হবে কিনা ঠিক করতে পারছে না।
মাথায় পালক নিয়ে এই অসময়ে বেরুনো কী ঠিক হবে?/ চারিদিকে আগুন নদী, পথঘাট অগ্নিবাতাস। যারা গিয়েছিল অন্ধ পাখি হাতে কোড়া শিকারে/ ফিরেনি। রক্তের ঘ্রাণ বাতাসে/ চাপ চাপ ছড়িয়ে আছে। (শিকারী)
তার তখন সে শহরে একটি আশ্রয়ের দরকার, ভালোবাসা দরকার। ঘর দরকার।
একটুখানি ঘরের জন্যই তো/ আমাকে এত বাহিরে ঘুরে মরতে হয়/ ঝড়, বৃষ্টি, আগুন ঝঞ্ঝায়, একেলা সন্ধ্যায়। ... আমি দশ ফুট বাই দশ ফুট ছায়ার জন্য ঘুরিয়া বেড়াই দশ দিগন্ত। (ঘর)
আমরা ওই তরুণের পরের কবিতাগুলোতে দেখতে পাই নানা চড়াই-উৎরাই পার হয়ে সে ঘরটি, এমনকি ভালোবাসার মানুষটি পায়। কিন্তু ততদিনে তার কাছে এগুলো অর্থহীন হয়ে পড়েছে। ততদিনে সে ভেতর থেকে মরে গেছে। একদিন সে উঁকি দিয়ে দেখতে পায় তার সে ঘরের ভেতর, তার আত্মার ভেতর একটি লাশ পড়ে আছে। তরুণটির কাছে সে লাশটি খুব পরিচিত মনে হয়।
কী ভেবে দিচ্ছি উঁকি/ নিজ সত্তার গভীরে/ যদি সে মৃতদেহটিরে/ চিনিবারে পারি/ একটুখানি। (যমজ ভাই)
হ্যাঁ, লাশটি সে দেখতে পায়। বিপন্ন বিস্ময়ে তরুণটি বুঝতে পারে এ মৃতদেহটি তার নিজেরই।
আর এই লেখাটির লেখকও উপলব্ধি করেন নব্বই দশকের সে তরুণ কবিটি তিনি নিজেই। কবিতার সে মৃহদেহটিও তার।
- বিষয় :
- কবিতা