ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

মতামত

অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষায় প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব

অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষায় প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব

ড. এম মাসরুর রিয়াজ

ড. এম মাসরুর রিয়াজ

প্রকাশ: ২২ জুন ২০২৫ | ০০:১৪ | আপডেট: ২২ জুন ২০২৫ | ১৭:২৪

বাংলাদেশের মতো একটি ঘনবসতিপূর্ণ এবং জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ দেশের প্রেক্ষাপটে প্লাস্টিক ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশগত ও জনস্বাস্থ্যগত ইস্যু। এটি এখন আর কেবল শহরকেন্দ্রিক কোনো সমস্যা নয়, বরং দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়া একটি বাস্তবতা। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, নগরায়ণ এবং ভোক্তা অভ্যাসের পরিবর্তনের ফলে প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার ক্রমাগত বাড়ছে, যার পরিণতিতে প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণও দ্রুতগতিতে বাড়ছে। এই বর্জ্য যথাযথভাবে ব্যবস্থাপনা না করা হলে ভবিষ্যতে তা পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।

প্লাস্টিক বর্জ্য পরিবেশের জন্য কতটা বিপজ্জনক, তা স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যখন দেখা যায় এই বর্জ্য জলাশয়, নদনদী, খাল-বিল এমনকি সাগরেও গিয়ে পৌঁছায়। এটি নদীর স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে, জলজ প্রাণীর জীবন হুমকির মুখে পড়ে এবং সামগ্রিকভাবে বাস্তুসংস্থান বিপর্যস্ত হয়। শহরাঞ্চলে অপরিকল্পিতভাবে ফেলা প্লাস্টিক বর্জ্য ড্রেনেজ ব্যবস্থা বন্ধ করে দিয়ে বর্ষাকালে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে। একদিকে এটি যেমন জনদুর্ভোগ বাড়ায়, অন্যদিকে অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হয়ে ওঠে।

প্লাস্টিক বর্জ্যের আরেকটি উদ্বেগজনক দিক হলো, এটি পরিবেশে শত বছর পর্যন্ত থেকে যেতে পারে এবং সহজে পচে না। ফলে এটি মাটির উর্বরতা নষ্ট করে কৃষি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। অন্যদিকে, যখন এই বর্জ্য পোড়ানো হয়, তখন তা থেকে বায়ুতে বিষাক্ত রাসায়নিক, যেমন– ডাইঅক্সিন ও ফিউরান ছড়িয়ে পড়ে, যা মানুষের শ্বাসযন্ত্র, স্নায়ুতন্ত্র এবং অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি করে। খাদ্য ও পানির মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করা মাইক্রোপ্লাস্টিক ভবিষ্যতের জন্য এক ভয়ংকর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিভিন্ন পরিবেশগত চাপে রয়েছে।

এ পরিস্থিতিতে প্লাস্টিক বর্জ্য যদি সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা না করা হয়, তাহলে তা পরিবেশগত দুর্যোগকে আরও ত্বরান্বিত করতে পারে। আজকের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে পরিবেশগত সুরক্ষা ও পরিবেশগত বিধিমালা মেনে চলা বিশ্বব্যাপী রপ্তানি বাজারে প্রবেশাধিকার, মানসম্পন্ন মূলধন এবং ভোক্তাদের আস্থায় প্রবেশের জন্য অত্যাবশ্যক পূর্বশর্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই কারণে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আগামী দিনে বাংলাদেশের রপ্তানি ও বিনিয়োগ প্রতিযোগিতার সক্ষমতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক হয়ে উঠবে। পরিবেশ ও অর্থনীতির স্বার্থে তাই টেকসই প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কোনো বিকল্প নেই। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, সঠিক কাঠামো ও বাস্তবভিত্তিক কৌশল না থাকায় দেশে এখন পর্যন্ত একটি সমন্বিত প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এই সংকট নিরসনে সরকারি ও বেসরকারি খাতের অংশীদারিত্বমূলক পদক্ষেপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এ ক্ষেত্রে কার্যকর ও পরীক্ষিত ব্যবসায়িক মডেল গ্রহণ করা বিস্তৃত বেসরকারি খাতের জন্য সাফল্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হবে।

এই দৃষ্টিকোণ থেকেই ২০২২ সালে ইউনিলিভার, ইপসা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর করে, যার লক্ষ্য ছিল চট্টগ্রাম নগরীতে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নত করা। এই উদ্যোগটি একটি সময়োপযোগী ও বাস্তবমুখী দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। প্রকল্পের আওতায় নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডে বর্জ্য সংগ্রহ, পৃথক্‌করণ, রিসাইক্লিং এবং জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। স্থানীয় জনসাধারণ, বর্জ্য সংগ্রহকারীদের এবং বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারকে সম্পৃক্ত করে প্রকল্পটি একদিকে যেমন প্লাস্টিক বর্জ্য কমাচ্ছে, অন্যদিকে বর্জ্য সংগ্রহকারীদের জীবনমান উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা রাখছে।
জুন ২০২২ থেকে এপ্রিল ২০২৫ সময়ে প্রকল্পটি প্রায় ২৪ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করেছে, যার মধ্যে রয়েছে ১৬ হাজার ৮০ টন একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক (এসইউপি) এবং ৭,৯২০ টন রিসাইকেলযোগ্য রিজিট প্লাস্টিক। এই উদ্যোগ দেখিয়েছে, একটি সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা ও সমন্বিত প্রয়াস থাকলে বাংলাদেশেও প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সফলতা অর্জন সম্ভব। প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সার্কুলার বা চক্রাকার ইকোনমি মডেল গ্রহণের মাধ্যমে বর্জ্যকে সম্পদে রূপান্তর করে পুনর্ব্যবহার ও পুনঃচক্রায়নের সুযোগ তৈরি করা সম্ভব, যা পরিবেশ সংরক্ষণ ও টেকসই অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এদিকে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এক্সটেন্ডেড প্রডিউসার রেসপনসিবিলিটি (ইপিআর) বা উৎপাদকের বর্ধিত দায়িত্ব নীতি বাস্তবায়নের দিকে এগোচ্ছে। ২০২১ সালে সরকার কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা প্রণয়ন করে এবং একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের একটি নির্দিষ্ট তালিকা প্রকাশ করে। তবে এই নীতি বাস্তবায়নে পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো বিবেচনায় না নিলে এর কার্যকারিতা ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।

বর্তমানে বাংলাদেশের বাজারে প্লাস্টিক পণ্যের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ উৎপাদন ও বিপণনে বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্রিয় অংশগ্রহণ রয়েছে। এদের অনেকেই ভোগ্যপণ্য, খাদ্য ও পানীয়, প্রসাধনী কিংবা মোড়কজাত পণ্যে ব্যাপকভাবে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের ওপর নির্ভরশীল। যদিও এই প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে, তবুও টেকসই উন্নয়ন ও পরিবেশ সুরক্ষার স্বার্থে তাদেরও সামাজিক ও পরিবেশগত দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে এগিয়ে আসতে হবে।

এই প্রতিষ্ঠানের অনেকেই ইতোমধ্যে পরিবেশবান্ধব প্যাকেজিং, রিসাইক্লিং প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ এবং প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাতে কিছু উদ্যোগ নিয়েছে, যা ইতিবাচক। তবে আরও কার্যকর ও দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন আনতে হলে করপোরেট পর্যায়ে নিজ উদ্যোগে প্লাস্টিক ব্যবহারে স্বচ্ছতা, নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ এবং উৎপাদনের প্রতিটি স্তরে পরিবেশ সচেতনতা অন্তর্ভুক্ত করা অপরিহার্য।

সরকারের ইপিআর নীতিমালার কার্যকর বাস্তবায়নে এসব করপোরেট প্রতিষ্ঠানকে শুধু অংশীদার নয়, বরং সমাজে নেতৃত্ব প্রদানকারী ভূমিকায় দেখতে চায়। কারণ, টেকসই প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হলে নীতিনির্ধারকদের পাশাপাশি বৃহৎ শিল্প উদ্যোক্তাদেরও সামনে এগিয়ে এসে দায়িত্ব ভাগ করে নিতে হবে।

এই প্রক্রিয়ায় করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) নীতিকে শুধু প্রচারণার উপকরণ না বানিয়ে, বরং বাস্তবমুখী পরিবেশ সুরক্ষামূলক কর্মকাণ্ডে রূপান্তর করাই সময়ের দাবি। একটি পরিচ্ছন্ন, বাসযোগ্য ও টেকসই বাংলাদেশ গড়ার পথে করপোরেট বাংলাদেশ যদি সত্যিকার অংশীদার হতে পারে, তাহলে প্লাস্টিক দূষণের বিরুদ্ধে লড়াই অনেক সহজ ও কার্যকর হয়ে উঠবে।

সার্বিকভাবে, একটি পরিবেশবান্ধব ও টেকসই বাংলাদেশ গড়তে হলে এখনই প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে। সরকার, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, শিল্প খাত, নাগরিক সমাজ এবং সাধারণ জনগণ ও সব পক্ষকে একযোগে কাজ করতে হবে। পুনর্ব্যবহারযোগ্য বিকল্প পণ্যের ব্যবহার, জনসচেতনতা বাড়িয়ে এবং সুনির্দিষ্ট আইন ও নীতিমালা বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্লাস্টিকদূষণ মোকাবিলা সম্ভব। এটিই হবে আগামী প্রজন্মের জন্য একটি পরিচ্ছন্ন ও নিরাপদ বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি।

লেখক: চেয়ারম্যান ও সিইও পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশ

আরও পড়ুন

×