কবি নজরুল জেগে আছেন আমাদের জীবনে

মোহীত উল আলম
প্রকাশ: ২৬ অক্টোবর ২০২০ | ১২:০০
করোনাকালে ডারউইনের উক্তিটিই যেন সত্য বলে প্রতিভাত হচ্ছে। ডারউইন বলেছিলেন, সার্ভাভাইবল অব দ্য ফিটেস্ট। অর্থাৎ যাদের রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা আছে তারাই বেঁচে থাকবে। এটা হলো বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব। মানুষ বেঁচে থাকে শুধু শারীরিকভাবে নয়, মানুষ বাঁচে মানসিক শক্তির ফলেও। কবিরা এই কথা মানেন, এবং আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রে বেশ খানিকটা জায়গা করে নিয়েছে মানসতার গঠনপ্রণালিও। শরীর ও মনের এই সমন্বিত চিকিৎসার নাম হচ্ছে- সাইকোসোম্যাটিক।
এই প্রেক্ষাপটে কবি নজরুলকে নিয়ে যদি ধ্যান করি, তাহলে দেখতে পাব, তিনি জেগে আছেন আমাদের জীবনে দুটি কারণে। এক. তার দারিদ্র্য-সংশ্নেষতা বা দারিদ্র্য-বান্ধবতা নিয়ে জীবনচর্যার জন্য; এবং, দুই. তার বিদ্রোহী সত্তার জন্য। বর্তমান লেখায় অতিমারি করোনার প্রেক্ষাপটে তাকে নিয়ে আলোচনা করার উদ্দেশ্য হলো এটি দেখা যে এ আতঙ্কিত সময়ে আমরা তাকে স্মরণ করে কীভাবে নিজেদের একটি করোনাবিরোধী প্রতিরোধী চরিত্রে লগ্নি করতে পারি।
নজরুল তার গান, 'আমি চিরতরে দূরে চলে যাব, তবু আমারে দেব না ভুলিতে' দিয়ে আজকে এ করোনাকালে আরও বেশি আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছেন তার কথা, যদি তিনি সুস্থ অবস্থায় এ সময় বেঁচে থাকতেন, তা হলে তার বিদ্রোহী সত্তা কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাত। তিনি কি লকডাউন মেনে নিয়ে গৃহবন্দি হয়ে বসে থাকতেন, আর ছোটাতেন কবিতার ফল্কগ্দুধারা এবং গানের লহরী, নাকি চুপচাপ বসে খবরের কাগজ পড়ে, মোবাইল ঘেঁটে আর টিভির নিউজ দেখে দিন কাটাতেন, আর ভাবতেন, এত মানুষ একটি অদৃশ্য জীবাণুর হাতে অক্কা পাচ্ছে, অথচ তিনি এই শত্রুর বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারছেন না। নাকি, 'থাকবোনাকো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগৎটাকে' বলে লকডাউনের শাসন না মেনে পথে পথে ঘুরতেন, কিংবা পার্কে একা বসে- যেমন ১৩৩৪ বঙ্গাব্দে কৃষ্ণনগরের একটি খোলা মাঠে বটগাছের নিচে টেবিল পেতে বসেছিলেন, সেভাবে ঝরঝর করে লিখে যেতেন আরেক প্রস্ত 'বিদ্রোহী'। নজরুল তার স্বভাবে যেভাবে আধুনিক গেজেটপাগল ছিলেন, আমার মনে হয় নজরুল তার অ্যানড্রয়েড সেটে ফোরজি নয়, ফাইভজি সেট করে যোগাযোগ চালাতেন। তার বৈচিত্র্যপূর্ণ চরিত্রের সঙ্গে এটি যায়।
কভিড-১৯ ঘরে ঘরে রোগের একটি বাতাবরণ তৈরি করেছে, কোথাও কোথাও সেটা মৃত্যুশোকেও পরিণত হয়েছে। নজরুলের জীবনে মৃত্যুশোক সবচেয়ে বড় করে বেজেছিল যখন তার দ্বিতীয় শিশুপুত্র বুলবুল (অরিন্দম খালেদ) মাত্র চার বছর বয়সে বসন্ত রোগে মারা যায় ৭ মে ১৯৩০ সালে। প্রচণ্ড আঘাত পেলেন নজরুল এবং লিখলেন তার বিখ্যাত গানটি, 'ঘুমিয়ে গেছে শ্রান্ত হ'য়ে আমার গানের বুলবুলি।' অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, বুলবুলের মৃত্যু নজরুলের সত্তাকে বিদ্রোহীজাত চেতনার চেয়েও আধ্যাত্মিক চেতনার দিকে ধাবিত করে। অধ্যাপক মাহবুবুল হক তার 'নজরুল তারিখ অভিধান' (২০১০) শীর্ষক গ্রন্থে লিখেছেন, 'পুত্রের শোক এত প্রবল হয়েছিল যে নজরুল পরে গভীরভাবে অধ্যাত্ম সাধনার দিকে ঝোঁকেন এবং লালগোলা স্কুলের হেডমাস্টার যোগসাধক বরদাচরণ মজুমদারের কাছে যোগ-সাধনায় দীক্ষা নেন। এই সময়ে লেখা সাধন সংগীতগুলোতে নজরুলের অধ্যাত্ম-সাধনার প্রভাব প্র বল।' (পৃ. ১৬৪) নজরুল তার দ্বিতীয় উপন্যাস 'মৃত্যুক্ষুধা' প্রকাশ করেন জানুয়ারি ১৯৩০ সালে। উপন্যাসটি এর আগে ধারাবাহিক প্রকাশিত হয় মাসিক সওগাত পত্রিকায় ১৯২৭ সাল থেকে। অর্থাৎ বুলবুলের মৃত্যুর তিন বছর আগে থেকেই। ১৯২৪ সালে, সম্ভবত ডিসেম্বর মাসে, কবির প্রথম পুত্র আজাদ কামালের (কৃষ্ণ মোহাম্মদ) অকাল মৃত্যু হয়। সম্ভবত এই মৃত্যুর স্মৃতি তাকে তাড়িত করে যার বেদনাবিধূর ছবি বিধৃত হয়েছে 'মৃত্যুক্ষুধা' উপন্যাসটিতে। উপন্যাসের নায়িকা মেজবৌ-এর নিজের ছেলে খোকাকে টাইফয়েড রোগের কাছে হারানোর বর্ণনা এটি। মেজবৌ তার ছেলে দুটিকে ফেলে ধর্ম বদলে খ্রিষ্টান হয়ে অন্যত্র চলে গেছিল। খোকার মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে যখন সে ছুটে আসে নিজ লোকালয়ে তখনতো আসলে ঢের দেরি হয়ে গেছে। উদ্ধৃত করছি সেই মর্মন্তুদ বর্ণনাটি :''মেজ-বৌর মূর্ছাতুর কণ্ঠে আর একবার শুধু অস্পষ্ট অনুনয় ধ্বনিত হল, 'খোকা, আমার খোকা কই?"
''বড়বৌ চিৎকার করে কেঁদে উঠল, 'রাক্ষুসী, এতদিনে এলি! খোকা নেই! কাল সকালে সে চলে গেছে!"
এই ব্যক্তিগত বিশাল শোকবোধ কিন্তু সমষ্টিগত কল্যাণের মধ্য দিয়ে প্রশান্তিতে পরিণত হতে দেরি হয় না। মেজবৌ আবার নিজের ধর্মে ফিরে এসে এলাকার ক্ষুধাতুর শিশুদের খাওয়ানোর আয়োজন করলেন। তখন নজরুল বর্ণনা করছেন- 'কি যেন এক নিবিড় প্রশান্তিতে আজ মেজ-বৌর বুক ভরে উঠেছে। ঐ সব ক্ষুধাতুর শিশুদের খাওয়াতে খাওয়াতে, তাদের প্রত্যেককে আদর করতে কোলে করতে করতে তার মনে হচ্ছিল, তার খোকা হারায়নি! সে এই ক্ষুধাতুর শিশুদের মাঝেই শত শিশুর রূপ ধরে এসেছে! তাদের আদর করে চুমু খেয়ে বুকে চেপে ধরে তার সাধ যেন আর মিটতে চায় না। যে খোকাকে দেখে, তার মুখে সে তার খোকার মুখ দেখতে পায়! আজ যেন সে জগজ্জননী!'
'মৃত্যুক্ষুধা' উপন্যাস থেকে বিশদ উদ্ধৃতি এ জন্য দিলাম যে ব্যক্তিগত শোককে কীভাবে সমষ্টির কল্যাণে মিলিয়ে দিয়ে আমরা মহত্তর একটি বোধে পৌঁছাতে পারি তার সবক'টি নজরুলের কাছ থেকে নিতে। করোনাকালের এই দুঃসহ সময়ে শোককে শক্তিতে পরিণত করার এটি একটি উপায়।
করোনার থাবায় প্রিয়জনকে হারানোর শোক সহ্য করার চেয়েও বেশি প্রয়োজন হচ্ছে, এই মহাআতঙ্কিত সময়ে বেঁচে থাকা। বেঁচে থাকা শুধু প্রতিবাদ নয়, রীতিমতো বিদ্রোহের সামিল। নজরুল তো 'আমি মানি না কো কোন আইন,/আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন' বলে সে ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে 'বিদ্রোহী' কবিতায় বিপ্লবের ঝড় তুলেছিলেন। কিন্তু করোনার সময় যেখানে যত একলা থাকা যায়, ততই মঙ্গল বলা হচ্ছে, সেখানে নজরুল যদি এ-সময়ে বেঁচে থাকতেন, এবং সুস্থ থাকতেন, তা হলে তার বিপ্লবী চেতনায় করোনার আক্রমণ প্রতিরোধকল্পে তিনি কী করতে পারতেন!
এখানে আমার আন্দাজটা হচ্ছে, নজরুল দারিদ্র্যপীড়িত মানুষদের পক্ষ নিয়ে একটি সামাজিক আন্দোলনের মতো করতে চাইতেন। কারণ 'মৃত্যুক্ষুধা'র মূল শাসটা হচ্ছে দারিদ্র্যক পরাজিত করে নয়, দারিদ্রের মধ্যে যে মানবতার মূল সুরটা নিহিত আছে সেটি অনুধাবন করা। নজরুল বাস্তব জীবনে সারা সময় দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে গেছেন, এবং 'দারিদ্র্য' শীর্ষক কবিতায় লিখেছিলেন, 'হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান!' আবার 'দরিদ্র মোর পরমাত্মীয়' শীর্ষক কবিতাটির প্রথম চরণ হচ্ছে, 'দরিদ্র মোর ব্যথার সঙ্গী, দরিদ্র মোর ভাই'।
নজরুলের দারিদ্র্য-সংশ্নেষ একদিকে পুষ্ট করেছিল তার বিদ্রোহী সত্তাকে, অন্যদিকে তাকে উজ্জীবিত করেছিল সত্যের বাণীতে পৌঁছানোর। নজরুলের কাছে প্রতীয়মান ছিল যে দারিদ্র্য আর সত্য একে অপরের পরিপূরক। নজরুল অবশ্য সম্যক অবহিত থাকতেন যে মানব স্বাস্থ্যের প্রতিরোধ ক্ষমতার সঙ্গে কভিড-১৯-এর এক রহস্যময় সমীকরণের কারণে দেখা গেছে দরিদ্র জনগোষ্ঠী এর ছোবল থেকে অনেকটা রক্ষা পেয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের নিচের কাতারের মানুষেরা তাদের ঘাম দিয়ে জীবিকা অর্জন করে বিধায় তাদের প্রচণ্ড সূর্যালোকের মধ্যে পরিশ্রমে নিয়োজিত থাকতে হয়। সে জন্য তাদের শরীরে ভিটামিন ডি'র অভাব হয় না। আর কভিড-১৯-এর পরম শত্রু হলো ভিটামিন ডি, যা প্রকারান্তরে মানবশরীরে অ্যান্টিবডি তৈরির কারখানা।
আমরা এখন হরদম হ্যান্ড স্যানিটাইজারে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। হাতে ওই স্প্রেটা মেখে আমরা হাতকে জীবাণুমুক্ত করার প্রয়াস নিচ্ছি। ঠিক সেরকম, নজরুল সমাজের পচনশীল অংশ থেকে জাতিকে উদ্ধারের জন্য একটি স্যানিটাইজারের কথা চিন্তা করেছিলেন। ১৩৩৪ বঙ্গাব্দের পৌষ সংখ্যার 'সওগাত' পত্রিকায় প্রিন্সিপ্যাল ইব্রাহীম খানকে লেখা নজরুলের একটি দীর্ঘ চিঠি ছাপা হয়। ওই চিঠির সর্বত্র ছড়িয়ে আছে বাঙালি জাতিকে স্যানিটাইজ করার নজরুল উদ্ভাবিত চিন্তা। নজরুল বাঙালি জাতির পচনশীল মানসিকতার ওপর সরাসরি অস্ত্রোপচার চেয়েছিলেন।
লিখছেন- ''আমার কি মনে হয় জানেন? স্নেহের হাত বুলিয়ে এ পচা সমাজের কিছু ভালো করা যাবে না। যদি সেরকম 'সাইকিক-কিউর'-এর শক্তি কারুর থাকে, তিনি হাত বুলিয়ে দেখতে পারেন। ফোড়া যখন পেকে পচে ওঠে তখন রোগী সবচেয়ে ভয় করে অস্ত্র-চিকিৎসককে। হাতুড়ে ডাক্তার হয়ত তখনও আশ্বাস দিতে পারে যে, সে হাত বুলিয়ে ঐ গলিত ঘা সারিয়ে দেবে এবং তা শুনে রোগীরও খুশি হয়ে উঠবার কথা। কিন্তু বেচারি 'অবিশ্বাসী' অস্ত্রচিকিৎসক তা বিশ্বাস করে না। সে বেশ করে তার ধারালো ছুরি চালায় সে-ঘায়ে; রোগী চেঁচায়, হাত পা ছোড়ে, গালি দেয়। সার্জন তার কর্তব্য করে যায়। কারণ সে জানে, আজ রোগী গালি দিচ্ছে, দু'দিন পরে ঘা সেরে গেলে সে নিজে গিয়ে তার বন্দনা করে আসবে।"
তারপর লিখেছেন, 'আমি কিন্তু অস্ত্রচিকিৎসার পক্ষপাতী।'
আমাদের সমাজে করোনার দুঃসহ সময়ে কোন কোন ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার করতে হবে সেগুলো আমরা নির্দিষ্ট করতে পারি। স্বাস্থ্যখাতে সবার আগে অস্ত্রোপচার দরকার। তা শুরুও হয়েছে। খাদ্য বিতরণে অস্ত্রোপচার দরকার। সেটা তেমন মজবুতভাবে শুরু হয়নি। এখনও প্রণোদনা হিসেবে বিতরণকৃত চালসহ খাদ্যসামগ্রী খোলাবাজারে বিক্রির জন্য আসছে। নজরুলের বিরাট বিদ্রোহ ছিল সব ধরনের মজুতদারের বিরুদ্ধে। এখন সে বিদ্রোহকে বাস্তবে রূপদান করার পাকা সময়।
লেখক, শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক
- বিষয় :
- মোহীত উল আলম
- প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আয়োজন