মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণআকাঙ্ক্ষা

সুলতানা কামাল
সুলতানা কামাল
প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৩ | ২২:৩১ | আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০২৩ | ১৫:৪৪
প্রতিবার ডিসেম্বর মাসের এই সময়টায় ‘বিজয় দিবস’ পালনের একটা দায় সামনে এসে পড়ে। তা হলো মুক্তিযুদ্ধের সেই দিনগুলোর দিকে ফিরে তাকানো। ভেবে দেখা– সেখান থেকে আমরা কতদূর অগ্রসর হলাম। ৭ মার্চের ভাষণে সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়।... এ দেশের মানুষ অর্থনীতি, রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে…’ তার কতটুকু আমাদের জীবনে সত্য হলো? দুঃস্বপ্নের মতো মনে পড়ে এর পরের চিত্র।
সেই ভয়াবহ গণহত্যার পরিপ্রেক্ষিতে কোটি মানুষের অসহায় দেশত্যাগ, ত্রিশ লাখ লোকের হত্যা, লাখো নারীর ওপর পৈশাচিক নির্যাতন এবং একটা গোটা জাতির ‘চেহারা বদলে দেওয়ার’ মানবিকতাবোধহীন উন্মত্ততায় দেশের প্রতিটি মানুষকে নিদারুণ শঙ্কা আর অবমাননায় অবরুদ্ধ করে রাখা। এ দেশের জনসাধারণকে মেধাশূন্য, সংস্কৃতি বিবর্জিত এক জনগোষ্ঠীতে পরিণত করার উদ্দেশে বুদ্ধিজীবীদের নারকীয়ভাবে বধ করা। তাই তো আমরা বিজয়ের গৌরব আর আনন্দের সঙ্গে বুকের গভীরে কষ্ট নিয়ে উচ্চারণ করি, ‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা, কারো দানে পাওয়া নয়।’ যে দামের কোনো সীমা টানা যায় না– সে দাম দিয়ে কেনা বাংলায় আজ কেমন আছি আমরা?
সেদিন আমাকে এক মা একরাশ কান্না নিয়ে ফোন করলেন। এ দেশের একজন সাধারণ মধ্যবিত্ত গৃহবধূ। তাঁর বক্তব্য– তিনি একটি শিশুসন্তানের মা। ঢাকা শহরেই তাঁর বাস। বাড়ির সামনে দিয়ে যে সড়ক চলে গেছে, সেই সড়কে রাত-দিন গাড়ি চলে। সেই গাড়ির চালকরা কারণে-অকারণে উচ্চস্বরে হর্ন বাজাতে থাকেন। তাঁর সঙ্গে আছে অন্যান্য যানবাহন এবং লোকজনের চিৎকার-চেঁচামেচি। তাঁর বাড়ির দু’পাশে দুটি মসজিদ। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সময় এলে শুধু লাউড স্পিকার নয়, এমপ্লিফায়ার লাগিয়ে সেই মসজিদ দুটিতে আজান দেওয়া হয়। মহিলার শিশুটি কী দিন, কী রাত– দুই চোখের পাতা এক করতে পারে না। ঘুমাতে পারে না বলে শিশুটির মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেছে। অনবরত কাঁদতে থাকে। ঠিকমতো খেতে পারে না। ব্যাহত হচ্ছে তার বেড়ে ওঠা, সুস্থ থাকা, আনন্দে থাকা। এক কথায় শিশুটিকে নিয়ে তার মা মহাসংকটে পতিত হয়েছেন। নানাভাবে এসব থামানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে আমাকে ফোন করেছেন তাঁর বাচ্চাটাকে একটু স্বস্তি দিতে আমি কিছু করতে পারি কিনা। এর সহজ অবধারিত উত্তর– আমার পক্ষে কিছুই করা সম্ভব নয়।
এসব সমস্যার সমাধান দেশের সামগ্রিক আইনের শাসন, সুশাসন, মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, রাষ্ট্র ও সরকারের জনগণের প্রতি দায়িত্ববোধ এবং জবাবদিহিবোধের মাত্রার ওপর নির্ভর করে। নির্ভর করে দুর্নীতিবাজদের প্রতি রাষ্ট্রের মনোভাব কী তার ওপর। যারা মানুষের অধিকার হরণ করে, রাষ্ট্র নির্মোহভাবে তাকে নিরস্ত করতে ব্যবস্থা গ্রহণ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে কিনা। না কি এসব অনাচারের প্রতি দৃষ্টিপাত না করে বরং ভুক্তভোগীকে আরও বিপন্ন করে অভিযুক্তদেরই আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে থাকে? আবার কখনও কখনও নিজেরাই এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় পরিণতির আশঙ্কা না করে? সব প্রশ্নের উত্তর মোটামুটি সবারই জানা আছে। সরকার ও রাষ্ট্রের অন্যান্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোরও একই অবস্থা। এই শিশুটির নির্বিঘ্ন বেড়ে ওঠায় কেউ কি কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার দায় নেবে? সহজ উত্তর ‘না’। তাই মায়ের সঙ্গে শিশুটির জন্য সহানুভূতি জানানো আর কিছু করতে না পারার বুকভাঙা অসহায়ত্ব নিয়ে এসব সমস্যা থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকা ছাড়া আমাদের সাধারণ নাগরিকদের আজকের বাংলাদেশে আর কী বা করার আছে? এ শিশুটির জীবনে যা ঘটছে তেমন ঘটনা কিন্তু বিরল নয়। বরং বলা চলে সব মানুষের জীবন ধারণ ও যাপনে যে বিঘ্ন, যে বাধা, যে নিরাপত্তাহীনতা বিরাজমান, শিশুটির কাহিনি তার একটি প্রতীকী চিত্র।
অধিকাংশ মানুষ আজ একটি স্বাধীন, শান্তিপূর্ণ এবং ন্যায়বিচারের প্রত্যাশা করা যায়– এমন জীবনের আশা ছেড়ে দিয়েছেন। আমার কর্মের পরিধির কারণে দেখতে পাই– সমাজের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই মানুষ কোনো না কোনো অধিকারহীনতা আর বঞ্চনার মধ্যে পড়ে অসহায় জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। বায়ান্ন বছর পরেও এত কষ্টে অর্জিত স্বাধীন দেশে মানুষের ভাগ্যের এই চিত্র দেখতে হবে কেন?
অনস্বীকার্য বিগত কয়েক বছরে দেশের গড় আয় বেড়েছে, বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য অবকাঠামো নির্মিত হয়েছে। প্রযুক্তিগত উন্নয়নও দৃশ্যমান। কিন্তু ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে কতজন এর সুফল ভোগ করতে পারছেন–
সেই সমীক্ষা না হয়ে থাকলেও ধরে নেওয়া যায় যোগাযোগ ও যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতি হওয়ায় মানুষ খুশি। তবে প্রকৃত অর্থে জনসাধারণের জীবনে এসব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড কোনো গুণগত পরিবর্তন আনতে পেরেছে কি? আমাদের অভিজ্ঞতা বলে সরকারের ভ্রান্ত অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণের ফলে সমাজের ওপরতলার কিছু মানুষ অতিদ্রুত হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। দেশের টাকা-পয়সা বিদেশে পাচার করে বিদেশেও এরা নিজেদের জন্য অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে নিয়েছেন। বারবার ‘বেগমপাড়া’ নামে একটা অনাচারের নাম সামনে এলেও কারা এটার সঙ্গে যুক্ত তাদের নাম ও উচ্চারণ করা হয় না, এদের শাস্তির আওতাতেও নিয়ে আসা হয় না। এতটাই আইনের ঊর্ধ্বে উঠে গেছে এই পরিবারগুলো। এরা দেশের সব সম্পদ সম্ভোগের অধিকার নিজেদের জন্য একচ্ছত্র করে নিয়েছে। এরাই দেশের আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করে উন্নয়ন প্রকল্প বা যে কোনো অজুহাতে নদ-নদী-খালসহ সব ধরনের জলাশয়, পাহাড়, খোলা জায়গা আর কৃষিজমি, দরিদ্র আর সংখ্যাগত দিক থেকে দুর্বল জনগোষ্ঠীর ভূমি, বন-জঙ্গল গ্রাস করে চলেছে।
অবাক হতে হয় এদেরই অনেকে নির্বাচনের মনোনয়ন পেয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের দল থেকে। দিনের পর দিন সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ করে, প্রতিকার চেয়ে হতাশ হতেও ভুলে যাচ্ছেন। বিশিষ্টজনের ভাষায় দেশ দুটি সমাজে বিভক্ত হয়ে পড়েছে, যাদের মধ্যে ফারাক বিস্তর। অন্যদিকে যারা নানা ঝুঁকি মাথায় নিয়ে এসব অন্যায় আর অধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কথা বলার চেষ্টা করে তাদের ভাগ্যে জোটে সরকারের উপেক্ষা, উপহাস আর হুমকি। মানুষের অধিকার রক্ষা করতে না পারার ব্যর্থতা ঢাকতে তারা অধিকারের দাবিকেই অন্যায্য ও অবৈধ বানাতে বদ্ধপরিকর। আইনি হোক বা বেআইনি পন্থায় হোক তাদের মুখ বন্ধ করে দিতে তৎপর।
স্মরণ করি, একাত্তরের পর এই অর্ধশতাব্দীকালে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে কত জল গড়িয়ে গেল। পঁচাত্তরের মতো ভয়ংকর হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে গেল। দেশ চলে গেল মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন সামরিক শাসকদের অধীনে। দেশ উল্টা পথে হাঁটল। ১৫ বছর ধারাবাহিকভাবে এই ধারা অব্যাহত থাকল। মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠায় স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন হলো। আবারও দেশের মানুষ রক্ত দিল। স্বৈরাচারী শাসক বিদায় নিতে বাধ্য হলো। আন্দোলনকারী তিন জোট দেশরক্ষায় ঐতিহাসিক যৌথ ঘোষণা প্রণয়ন করল। মানুষ আশাবাদী হলো। আজকের আলোচনায় স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বা সংবিধানের কথা আনতে চাই না। কারণ সেগুলো প্রণয়ন করেছিলেন আমাদের পূর্বসূরিরা। কিন্তু তিন জোটের যৌথ ঘোষণার প্রণেতা হলেন বর্তমানে রাজনীতির মাঠের খেলোয়াড়রা। দেখি তারা দেশের মানুষের কাছে কী অঙ্গীকার করেছিলেন।
তিন জোটের ঘোষণার প্রথম অনুচ্ছেদে লেখা হলো– ‘স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের দুঃশাসনের কবল থেকে মুক্তিকামী জনগণ এরশাদ সরকার অপসারণের দাবিতে এবং দেশে একটি স্থায়ী গণতান্ত্রিক ধারা ও জীবনপদ্ধতি কায়েম এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ও মূল্যবোধের পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে চলমান গণআন্দোলনে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ এক বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছে।’ এর পরের অনুচ্ছেদের উদ্ধৃতিতে যাচ্ছি না। তবে চতুর্থ ও পঞ্চম অনুচ্ছেদ দুটি আজকের প্রেক্ষাপটে অনুধাবনযোগ্য। সেখানে বলা হচ্ছে, ‘এ জন্য আমাদের দাবির কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু হলো একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সার্বভৌম সংসদ প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু অসাংবিধানিক ধারায় অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী এরশাদ সরকার প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে ছলেবলে কৌশলে তার ক্ষমতাকে স্থায়ীভাবে কুক্ষিগত রাখার নিরন্তর প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে।’
এই ঘোষণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে জনগণ মনপ্রাণ ঢেলে মুক্ত নির্বাচন আন্দোলনের সূচনা করল। দেশ পরিচালনার জন্য নিজের পছন্দমতো প্রতিনিধি বেছে নিতে পারার অধিকার ফিরে পাওয়ার আনন্দে দেশব্যাপী এই আন্দোলন গড়ে তোলে সাধারণ মানুষ।
সময়মতো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। জোটের এক অংশী নির্বাচনে জয়ী হলো। জোটের ঘোষণানুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পদ্ধতি প্রবর্তিত হলো। পালাক্রমে জোটের দুই দল দেশ শাসনের দায়িত্ব পেল। তারপর তাদের একজন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বিতর্কিত করল, অন্যদল সেটা বাতিলের ব্যবস্থা সম্পন্ন করল। নির্বাচন নিয়ে তারপর কী তেলেসমাতি চলছে সেটা এতটাই দৃশ্যমান যে, সে নিয়ে মন্তব্য করার কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে বলে মনে করি না।
দুঃখজনক হলেও সত্য, জোটের দুই শক্তশালী অংশীদার পালাক্রমে ক্ষমতায় থেকেও জোটের পূর্ণ বাস্তবায়নের কোনো কার্যকর পদক্ষেপ তো নেয়ইনি, বরং তা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য নানা অজুহাত ব্যবহার করেছে। বাস্তবায়ন না করা অঙ্গীকারগুলোর অন্য গুরুত্বপূর্ণ ধারাগুলোয় বলা হচ্ছে, ‘গণপ্রচারমাধ্যমকে পরিপূর্ণভাবে নিরপেক্ষ রাখার উদ্দেশ্যে রেডিও-টেলিভিশনসহ সকল প্রচারমাধ্যমকে স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় পরিণত করতে হবে এবং নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী সকল রাজনৈতিক দলকে প্রচার-প্রচারণার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।’ আরেকটি হলো, ‘জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা এবং আইনের শাসন নিশ্চিত করা হবে।’ সব শেষে, ‘মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী সকল আইন বাতিল করা হবে।’
আমি পাঠকের বোধবুদ্ধির ওপরই ছেড়ে দিতে চাই এই বিচারের ভার, তারা কী মনে করেন– তিন জোটের ঘোষণার কতটুকু বাস্তবায়িত করা হয়েছে! আমি শুধু পাবলো নেরুদার কবিতার একটা লাইন মনে করি– এমত পরিস্থিতিতে যে ‘my country has been betrayed again.’ আমরাও কি এভাবে শুধু প্রতারিতই হতে থাকব? এর কি শেষ দেখে যেত পারব না?
লেখক: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা; প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট, মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন