সম্মুখ সমরের দিনগুলো

স ম বাবর আলী
স ম বাবর আলী
প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:১৫ | আপডেট: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১৫:১২
শাহজাহান মাস্টার দেবহাট থানার টাউনশ্রীপুর গ্রামের শিক্ষক ছিলেন। টাউনশ্রীপুরের অন্য পাড়ে মাস্টারের নেতৃত্বে একটা বড় অপারেশন ক্যাম্প গড়ে উঠেছিল। হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী প্রায়ই টাউনশ্রীপুর গ্রামে এসে নানা রকম অত্যাচার করত। তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে স্থানীয়রা নবম সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিল ও মেজর মুজাহিদ ক্যাপ্টেন শাহজাহান সাহেবের কাছে এসে অভিযোগ করেন। তাই সিদ্ধান্ত হয়, হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে এক রাতে আক্রমণ চালানো হবে।
যেহেতু এ অঞ্চলে তাঁর বাড়ি এবং রাস্তাঘাট পরিচিত, এ জন্য শাহজাহান মাস্টারই হন ওই অভিযানের অধিনায়ক। তা ছাড়া স্বল্পভাষী লোকটি দুর্দান্ত সাহসী ও কৌশলী যোদ্ধা ছিলেন। আমি ছিলাম ওই অভিযানের সহকারী দলনেতা। সিদ্ধান্ত হলো পাকিস্তানি সেনাদের বাঙ্কারে রাতে গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হবে এবং স্টেনগান এবং এলএমজির কিছু ব্রাশফায়ার করে ভয় দেখিয়ে সবাই চলে আসবে।
১৯৭১ সালের ৬ জুন রাতে মুক্তিবাহিনীর তিনটি দল পৃথক পৃথক দায়িত্ব নিয়ে একসঙ্গে নদী পার হয়। সিদ্ধান্ত ছিল একটি দল পারুলিয়া ব্রিজ উড়িয়ে দিবে, আরেক দল বাংলাদেশের ভেতরে ঢুকে কোনো এক থানা এলাকায় প্রবেশ করবে এবং তৃতীয় দলটি হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে ঝটিকা আক্রমণ চালাবে।
ইছামতী পার হয়ে নৌকা থেকে নেমেই সবাই বাংলাদেশের পবিত্র মাটি বুকে ও কপালে লাগাই। তারপর তিন দল তিন দিকে রওনা হয়। আমরা প্রায় ৩৫ ছিলাম অভিযানে। আমাদের কাছে ১টি এলএমজি, এসএলআর, এসএমজি এবং ডজন দুয়েক গ্রেনেড ছিল। কমান্ডার শাহজাহান সাহেব ও আমি পরামর্শ করে দু’জনে রেকি করতে বের হলাম। অন্য সবাই একটা নিরাপদ স্থানে বসে থাকল।
আমরা দু’জন নিঃশ্বাস এক রকম বন্ধ করে ধীরে ধীরে পাকসেনাদের বাঙ্কারের দিকে অগ্রসর হলাম। ওদের কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। ঘটনা কি? একটু একটু করে আরও বেশ কিছুদূর অগ্রসর হলাম এবং এক সময় তাদের বাঙ্কারের ভেতর চলে গেলাম। না কেউ নেই সব খালি। প্রথম দিকে আমরা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। পরে স্যারের সঙ্গে পরামর্শ করলাম কী করা যায়। মাস্টার শাহজাহান সাহেব দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন, তাই অনেকেই তাঁকে ‘স্যার’ বলে ডাকেন, আমিও তাঁকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করি। আমরা এক বাড়িতে ঢুকে বাসিন্দাদের ঘুম থেকে ডেকে মিলিটারিদের অবস্থানের কথা জানতে চাইলাম। স্থানীয়রা জানান, পাকিস্তানি বাহিনী সন্ধ্যার আগেই এই এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। রাতে তারা দূরে একটি দোতলা বাড়িতে থাকে, না হলে সাতক্ষীরা চলে যায়। দলে ফিরে পুরো ঘটনা জানানোর পর পরিত্যক্ত বাড়িতে সবাই আশ্রয় নিই এবং রাতে স্যার সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিলের কাছে রওনা হন তাঁর নির্দেশের জন্য। তিনি রাত প্রায় ২টার দিকে ফিরে আসেন। সিদ্ধান্ত হয় পরদিন মিলিটারির ওপর আক্রমণ চালাতে হবে।
সিদ্ধান্তটা আমাদের মনঃপুত হলো না, কারণ আমরা গেরিলা যুদ্ধ করছি। শত্রুবেষ্টিত এলাকায় নানা সমস্যা। সেই সঙ্গে অস্ত্র ও প্রয়োজনীয় সামরিক সরঞ্জাম আমাদের নেই। তবুও কমান্ডারের নির্দেশে অভিযানের প্রস্তুতি নিই।
আমরা ইছামতী নদী তীরবর্তী আহমেদ মিস্ত্রির বাড়িতে ৩৫ জন ৩টি দলে ভাগ হয়ে আছি। একজন ইঞ্জিনিয়ারসহ এলএমজি নিয়ে ১০-১১ জনের একটি দল পূর্ব দিকের একটি ঘরে। শাহজাহান স্যার ১০-১২ জনের একটি দল নিয়ে একটি ঘরে অবস্থান নেন। বাকিদের নিয়ে আমি মধ্যবর্তী একটি ঘরে অবস্থান নিই। সিদ্ধান্ত হয়, আমরা রাতে সবাই বিশ্রাম করব। সকালে নাশতার পর সময়-সুযোগ বুঝে সেনাদের ওপর আক্রমণ চালানো হবে। কিন্তু স্যারের মুজাহিদ বাহিনীর নূর মোহাম্মদ নামে একটা ছেলে ওই রাতেই নিকটবর্তী তাঁর বাড়ি যায় এবং যে কোনো কারণেই হোক মুক্তিবাহিনীর আগমন ও পরিকল্পনার কথা মিলিটারির কাছে ফাঁস করে দেয়। পাকিস্তানি বাহিনী এ সুযোগ পুরোপুরি গ্রহণ করে।
ভোরবেলা, মাত্র সূর্য উঠেছে। সবাই ঘুমে। আমি ও স্যার জেগে আছি। মুক্তিযোদ্ধারা যে ঘরে ছিলেন, ঘরগুলো ছিল গোলপাতার ছাউনি এবং কঞ্চির বেড়ার পর আধা ইঞ্চি মাটির প্রলেপ। আমরা নিচু গলায় কথা বলছিলাম। এমন সময় দেখতে পাই, পূর্ব দিকের বাগানের ভেতর দিয়ে দু’জন সেনা সদস্য ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছে।
হঠাৎ ভূত দেখার মতো চমকে উঠলাম। স্যারও দেখে বললেন, পাকিস্তানি বাহিনী আমাদের ঘেরাও করে ফেলেছে। এখন যুদ্ধ করা ছাড়া উপায় নেই। সবাইকে দ্রুত জাগাও। সবাইকে ঘুম থেকে জাগিয়ে সেনাদের কথা বলা হলো। সবাই দ্রুত অস্ত্র হাতে নিয়ে প্রস্তুতি নিতেই দেখি, এক সেনাসদস্য উঠানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। সম্ভবত পাকিস্তানি সেনারাও বুঝতে পারছিল না এই ঘরে কেউ আছে। কারণ আশপাশে এমন অনেক ঘর ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। হঠাৎ করে ইঞ্জিনিয়ারদের ঘর থেকে একটি গুলি উঠানে দাঁড়ানো মিলিটারির গায়ে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে সে লাফ দিয়ে অস্ত্রসহ লুটিয়ে পড়ল। দ্রুত সিদ্ধান্ত হলো যে যার মতো বের হয়ে যুদ্ধ করতে হবে। মরতে হলে আগে পাকিস্তানি সেনাদের মারতে হবে, এরপর নিজেরা মরব।
এভাবে সবাই একে একে বের হয়ে গেল। আমি ঢেঁকি ঘরের দেয়ালে রাইফেল নিয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছি। বৃষ্টির মতো গুলি হচ্ছে, এক মিনিটও দেরি করা সম্ভব নয়। পাশেই ঝোপঝাড়ের মধ্যে একটি নালা দেখতে পেলাম। সম্ভবত ওইটা পানি তোলার ড্রেন। দীর্ঘদিন ব্যবহার না হওয়ায় লতাপাতায় ঢেকে ছিল। দ্রুত ওই ড্রেনের মধ্যে নেমে পড়লাম। পিঠটা কাঁটায় ছিঁড়ে গেল। সেদিকে তাকানোর উপায় নেই। ড্রেন দিয়ে কিছুদূর এগিয়ে দেখি গাছের আড়ালে এক শত্রু সেনা অস্ত্র হাতে পজিশন নিয়ে আছে। পিঠ আমার দিকে। দেরি না করে রাইফেল তাক করে ট্রিগার টেনে ধরলাম। এক গুলিতে সে গাছের সঙ্গে লেপ্টে গেল। এত কাছ থেকে পাকিস্তানি সেনাকে গুলি করে মারার অভিজ্ঞতা সেটাই ছিল প্রথম। মনোবল ফিরে পেলাম। মনে হচ্ছিল, এবার মরলেও দুঃখ থাকবে না।
ড্রেন দিয়ে ২০-২৫ হাত এগিয়ে যেতে দেখি দু’জন পাকিস্তানি সৈনিক দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে মুখ করে রাইফেল উঁচু করে শুয়ে আছে। যে কোনো সময় আমাকে দেখে ফেলতে পারে। গুলি ছুড়লেই আমি শেষ। আবার আমি যদি গুলি করি, সেই গুলি যদি মিস হয়, তাহলেও আমি শেষ। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে আল্লাহর ওপর ভরসা করে খুব কাছ থেকে গুলি করলাম। একজন গুলি খেয়ে ছিটকে পড়ল, অন্যজন আন্দাজে গড়াতে গড়াতে আড়ালে চলে গেল। আমি দ্রুত সেখান থেকে সরে পড়ি। পাকিস্তানি সেনাদের গোলা এবং আমাদের এলএমজি রাইফেল আর গ্রেনেডের শব্দে পুরো এলাকা প্রকম্পিত। ভারতের পারে ইছামতী নদীর তীরে হাজার হাজার লোক এ দৃশ্য দেখছে। উভয়পক্ষে অবিরাম যুদ্ধ চলছে। টাকি এলাকা থেকে মুক্তিবাহিনী ভারী কামানের গোলা নিক্ষেপ করছে আমাদের সাহায্যের জন্য। কিন্তু শত্রুমিত্র একসঙ্গে থাকায় কামানের গোলা শব্দ তৈরি ছাড়া কোনো কাজে লাগল না। গোলাগুলির শেষ নেই। কে কোন দিকে, তাও বোঝা যাচ্ছে না। আমি ড্রেন দিয়ে চলতে চলতে একটা খালে এসে পড়লাম। ১০০ গজ দূরে ওয়াপদার স্লুইসগেট। নিচু হয়ে দৌড়ে স্লুইসগেটের মধ্যে আশ্রয় নিলাম। এটাকে নিরাপদ আশ্রয় মনে হলো। গোলাগুলি তখনও চলছে। আমার রাইফেলে তখন দুটি গুলি। ইতোমধ্যে দুই ঘণ্টা হয়ে গেছে। সাঁতরে ইছামতী নদী পার হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। নদীতে ঝাঁপ দিয়ে কিছুদূরে যেতেই নৌকায় আমাকে তুলে নিল। ভারত সীমান্তে যেতেই তীরে থাকা হাজার হাজার লোক একসঙ্গে প্রশ্ন করতে লাগল, কী হয়েছে?
ওই সময় উত্তর দেওয়ার মানসিক অবস্থা ছিল না। শুধু বললাম গুলি দেও, গুলি দেও, আমি ওপারে যাব। গফুর ভাই, ডা. আসিফুর রহমানসহ অন্যদের দেখলাম। দীর্ঘক্ষণ পানিতে থাকায় আমি কাঁপছিলাম। আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে ভেবে আমাকে একটা ঘরে কাথা পেঁচিয়ে আটকে রাখা হলো। কিন্তু আমার মন পড়ে ছিল ওপারে। জানালায় হাত দিয়ে দেখি, জানালা দুর্বল, সজোরে লাথি দিলে জানালা ভেঙে যায়। বেশকিছু দূরে গিয়ে সাতক্ষীরার কামরুজ্জামান ও বিলুকে পেলাম। ওরা দু’জন তিনটি রাইফেল নিয়ে এলে পুনরায় ইছামতী পার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করি। ওপার গিয়ে দেখি হাবলু গুলি খেয়ে নদীতে এসে পড়েছে। তাঁকে নৌকায় তুললে নৌকার পানি রক্তে লাল হয়ে গেল। তাঁর গায়ে মোট ৩০টি গুলি লেগেছিল।
ওপরে উঠে সবার নাম ধরে ডাকতে থাকি। যুদ্ধ তখন থেমে গেছে। একটি ঘরে গিয়ে দেখি, নারায়ণ ঘরেই মৃত পড়ে আছে। অন্যদের খোঁজার সময় চোখে পড়ে শুধু পাকিস্তানি সেনাদের লাশ। নারায়ণের লাশসহ হাবলু, স্যার, রশীদ, শেখ জলিল ও অন্যদের নিয়ে টাকিতে যাই। কাজল, নাজমুলের লাশ পাওয়া গেল না। ওই যুদ্ধে মোট সাতজন শহীদ হন। কয়েকজন নিখোঁজ ছিলেন। এভাবেই শেষ হয় টাউনশ্রীপুর যুদ্ধ।
অনুলিখন
হাসান হিমালয়
স্টাফ রিপোর্টার, খুলনা ব্যুরো
- বিষয় :
- হানাদার বাহিনী
- বিজয় দিবস