ঢাকা বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫

সেই স্মৃতি আজও শিহরিত করে

সেই স্মৃতি আজও শিহরিত করে

মতিলাল বণিক

মতিলাল বণিক

প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:০৭ | আপডেট: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১৫:১১

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ২৯ বছর। তখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতাম। শোষণহীন স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর নির্দেশে এবং ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে বন্ধুদের সঙ্গে মিলে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। রণাঙ্গনে চোখের সামনেই হারিয়েছি শতাধিক সহযোদ্ধাকে। বেঁচে যে আছি, ভাবলে এখন অবিশ্বাস্য মনে হয়। 

তখন ন্যাপের জেলা কমিটির সদস্য হিসেবে পার্টির প্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর কাছ থেকে দলীয় মারফত নিয়মিত খবরাখবর পেতাম। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে মওলানা ভাসানী দলীয় নেতাকর্মীকে স্পষ্ট বলে দিয়েছিলেন যুদ্ধ অত্যাসন্ন। পরবর্তী সময়ে ৭ মার্চ বিকেলে কসবা বাজারে মতিন সরকার, আবদুল কাদিরসহ কয়েকজন বন্ধু একসঙ্গে রেডিওতে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শুনে আমাদের মাঝে উপলব্ধি হয় যুদ্ধ করতে হবে। এরই ধারাবাহিকতায় ৮ মার্চ মতিন সরকার, আবদুল কাদির, ফিরোজ, আব্দুল কাইয়ুম, শহীদ মাস্টারসহ আমরা কয়েকজন যুবক কসবা সাহাপাড়ায় সভা করি। পরে কসবা গার্লস স্কুলে আরও একটি সভা করি। ওই সভায় কীভাবে কী করতে হবে, তা নিয়ে পরিকল্পনা করা হয়। সে অনুযায়ী আমাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হয়।

কসবা চন্ডিদ্বার উচ্চ বিদ্যালয়, বাড়াই ও গোপীনাথপুর খেলার মাঠে আমাদের পৃথক প্রশিক্ষণ চলে। চন্ডিদ্বার উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে প্রশিক্ষণে অংশ নিই। প্রশিক্ষণে বাঁশের লাঠি দিয়ে দেখানো হতো কীভাবে অস্ত্র চালাতে হবে। প্রশিক্ষণ করাতেন সাবেক সেনাসদস্য আবদুল আলীম। একসময় প্রশিক্ষণ ক্যাম্প খোলা জায়গা থেকে লতুয়ামোড়া টিলার ওপর চানামোড়া খেলার মাঠে স্থানান্তর করা হয়। 

এদিকে প্রশিক্ষণের ফাঁকেই একদিন আমরা কয়েকজন কসবার পানিয়ারূপ গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা করি মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক অ্যাডভোকেট সিরাজুল হক বাচ্চুর সঙ্গে। তিনিও আমাদের পরামর্শ দেন প্রশিক্ষণ চালিয়ে যেতে এবং যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এসে দেখা করি আওয়ামী লীগ নেতা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক অ্যাডভোকেট লুৎফুল হাই সাচ্চু, মাহবুবুল হুদা ভূঞা এবং জেলা ন্যাপ নেতা ফয়জুর রহমান মিনুর সঙ্গে। তাদের কাছ থেকেও একই পরামর্শ পাই। মার্চের ২৫ তারিখ পর্যন্ত দেশেই প্রশিক্ষণ নিয়েছি আমরা। পরিস্থিতি বদলে গেলে ২৬ ও ২৭ মার্চ আমরা যুদ্ধ নিয়ে নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করি। এদিকে ১৪ এপ্রিল হঠাৎ করে কসবা আক্রমণ করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। কসবা সদরের বেশ কয়েকটি বাড়িতে তারা আগুন ধরিয়ে দেয়। কসবা থানায় যে অস্ত্র ছিল, তা দিয়ে পুলিশসহ আমরা মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর মোকাবিলা করে এক পর্যায়ে পিছু হটতে বাধ্য হই। এ সময় মাক্কু মিয়া, গেদু মিয়াসহ আমরা বেশ কয়েকজন আগরতলার দেবীপুরে চলে যাই। পরিচিত অনেককেই সেখানে দেখতে পাই। ক্যাপ্টেন গাফফারকে ‘মর্টার প্লাটুন’ নিয়ে বসে থাকতে দেখেছি। আমি শিক্ষক, এটা জেনে ক্যাপ্টেন গাফফার আমাকে তাঁর কাছে থাকতে বলেন। এ সময় তিনি আমার কাছ থেকে এলাকা সম্পর্কে ধারণা নেন। আমাদের মধ্য থেকে ১৩ জনকে দেবীপুর পাহাড়ি এলাকায় তাঁবু গেড়ে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প বানিয়ে মাত্র সাত দিন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণের ফাঁকে আমাদের দেশের ভেতরও পাঠানো হতো রেকি করার জন্য। আমাদের প্রশিক্ষক ছিলেন হাবিলদার শামছুল হক। ভারতে সাত দিনের প্রশিক্ষণের পর নির্দেশমতো বাংলাদেশে ঢুকে প্রথমে হামলা করা হয় কসবা রেলস্টেশনের পশ্চিম পাশে বাঙ্কারে। উদ্দেশ্য, রাতে অতর্কিতে হামলা চালিয়ে ব্যতিব্যস্ত রাখা। যাতে পাকিস্তানি বাহিনীর পাল্টা হামলায় অস্ত্রের মজুত কমে আসে।

একদিন দেখলাম, কসবার চরনালে বাড়িঘরে আগুন দিয়েছে হানাদার বাহিনী। খবর পেয়ে ক্যাপ্টেন গাফফার তখন শামছুল হককে নির্দেশ দেন মর্টার হামলা করতে। অপি হাবিলদারকে বলা হলো ওয়্যারলেস নিয়ে পাহাড়ে ওঠে নিশানা জানাতে। আবদুল কাদির ও আমাকে দেওয়া হয় অপির সাথে। অপি গাছে উঠে নিশানা ঠিক করার নির্দেশনা দেন ওয়্যারলেসে। নিশানামতো মর্টার ফায়ার হলে শত্রুশিবির বাঙ্কারের ভেতর ঢুকে যায়। তবে কেউ মারা গেছে কিনা, তা দূর থেকে আমরা বুঝতে পারিনি। ফায়ার শেষে তখন আমরা বিকট শব্দ শুনতে পাই। এ সময় হাবিলদার অপি ও হাবিলদার আজহার আমাদের মাটিতে শুয়ে পড়তে বলেন। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আমরা দেখতে পাই, আগুনের কুণ্ডলীর মতো কিছু একটা আমাদের মাথার ওপর দিয়ে গেছে। এভাবে আরও কয়েকটি কুণ্ডলী কিছুক্ষণের ব্যবধানে আমাদের মাথার ওপর দিয়ে যায়। কিছুদূর পাহাড়ে গিয়ে এসব কুণ্ডলী আঘাত করে। বুঝতে কষ্ট হয় না যে তারা শেল ছুড়েছে। এ সময় আমাদের দিক থেকে পাল্টা কোনো জবাব না পাওয়ায় এক পর্যায়ে হামলা বন্ধ করে শত্রুপক্ষ।

’৭১-এর ২২ নভেম্বর কসবার লতুয়ামোড়া ও চন্দ্রপুরের মাঝামাঝি চরনালের একটি ঘটনা মনে হলে এখনও খুব কষ্ট হয়। চোখের পানি ধরে রাখতে পারি না। কসবার চানমোড়ায় হানাদার বাহিনীর একটি বাঙ্কার ছিল। বাংলাদেশ ও ভারতের মিত্র বাহিনী মিলে এতে আক্রমণের পরিকল্পনা নেয়। আমিসহ আরও অনেক মুক্তিযোদ্ধা তাদের সঙ্গে ছিলাম। আমরা এগিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে লতুয়ামোড়া ও চন্দ্রপুর এলাকায় দু’দিক থেকে আমাদের ঘিরে ফেলে পাকিস্তানি বাহিনী। ওই হামলায় আমাদের পক্ষে মিত্র বাহিনীর শতাধিক সেনাসদস্য এবং ১৭-১৮ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন বলে পরে জানতে পারি। আমরা যারা পেছনে ছিলাম, ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাই। পরদিন গিয়ে যাদের লাশ পাওয়া যায়, গ্রামবাসীর সহায়তায় তাদের লক্ষ্মীমোড়ায় সমাহিত করা হয়। যেখানে পরে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। এ যুদ্ধে আমাদের পরিকল্পনায় ভুল হওয়ার চরম মূল্য দিতে হয়েছিল। এ ঘটনার পর আমরা মিত্র বাহিনীর সহায়তায় তীব্র পাল্টা আক্রমণ করলে পাকিস্তানি বাহিনী বাঙ্কার ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।

এরই ধারাবাহিকতায় ২৬ নভেম্বর কসবা মুক্ত ঘোষণা করা হয়। চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। পরিবারের আরেক সদস্য ছোট ভাই মোহনলাল বণিক ভারতে পালিয়ে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়। আমার বাবা মনমোহন বণিক পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে ত্রিপুরার আগরতলা শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়। অষ্টম শ্রেণিপড়ুয়া ছোট ভাই মোহনলাল বণিক হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে পড়ে। তাকে খুঁজে না পেয়ে একদিন বাবা আমার ক্যাম্পে এসে তার কথা বলে হাউমাউ করে কান্নাকাটি শুরু করেন। বাবার কাছ থেকে শুনে আমি আগরতলা কংগ্রেস ভবনে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় ছোট ভাই মোহনের নাম দেখে বাবাকে জানাই। এতে বাবা কিছুটা সান্ত্বনা পেলেও দুশ্চিন্তামুক্ত হতে পারেননি। শরণার্থী শিবিরে মোহন ফিরে পকেট থেকে এক সহযোদ্ধা বন্ধুর ছবি বের করে জানায়, তিনি যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। এ ঘটনা শুনে বাবা-মা তাকে যুদ্ধে যেতে বারণ করলে কিছুটা চুপ থেকে আবার দু’দিন পরে ঠিকই কাউকে না জানিয়ে শিবির থেকে বেরিয়ে যুদ্ধে চলে যায়।  

অনুলিখন
আবদুন নূর
নিজস্ব প্রতিবেদক, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

আরও পড়ুন

×