ঢাকা বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫

হানাদার প্রতিরোধের সংগ্রাম

হানাদার প্রতিরোধের সংগ্রাম

নূরুল আলম ফরিদ

নূরুল আলম ফরিদ

প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:১৩ | আপডেট: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১৫:১২

১৯৪৭ সালে ভারত থেকে আলাদা হওয়ার পরই পশ্চিম পাকিস্তান আমাদের ওপর বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু করে, যার প্রথম ধাপ ছিল আমাদের মাতৃভাষা ‘বাংলা’র পরিবর্তে ‘উর্দু’ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। কিন্তু বীর বাঙালির আন্দোলনে তা ব্যর্থ হয়। পরবর্তী সময়ে এর ধারাবাহিকতা চলমান ছিল। ১৯৭০ সালে নির্বাচনে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে আমরা নিরঙ্কুশ জয়লাভ করার পরও আমাদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা দিতে টালবাহানা শুরু করে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে নিরীহ বাঙালির ওপর ‘অপারেশন সার্চলাইট’ ছিল বাঙালি নিধনে পশ্চিম পাকিস্তানের চূড়ান্ত মিশন। ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স, পিলখানা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। 

রাজপথে আন্দোলনের পাশাপাশি হামলা প্রতিরোধে সশস্ত্র প্রস্তুতিও চলছিল বাঙালিদের। বরিশালের মুক্তিকামী জনতাও এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ২৫ মার্চ রাতে বরিশাল পুলিশ লাইন্স থেকে বরিশাল সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নূরুল ইসলাম মঞ্জুরের নেতৃত্বে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করা হয়। আন্দোলন-সংগ্রামে আমি আগে থেকেই প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলাম। ২৬ মার্চ থেকে হানাদার প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু করি। এ থেকেই আমার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ শুরু। ৯ মাসের সশস্ত্র সংগ্রামে বরিশাল ও ভারতে আমার অসংখ্য স্মৃতি। তার মধ্যে কয়েকটি তুলে ধরলাম। 

১. ২৬ মার্চ রাতে আমি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা এনায়েত হোসেন চৌধুরী শহরের নথুল্লাবাদ মাদ্রাসা সেতু ভাঙতে যাই। এখনকার নথুল্লাবাদ কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল থেকে বিএম কলেজমুখী সড়কে হোসাইনিয়া মাদ্রাসাসংলগ্ন কালভার্টটি তখন উঁচু সেতু ছিল। সেতুর নিচে ছিল খরস্রোতা জেলখাল। 

আমাদের বিশ্বাস ছিল, সেতুটি ভেঙে দিলে পাকিস্তানি বাহিনী ট্যাঙ্ক ও যানবাহন নিয়ে শহরে প্রবেশ করতে পারবে না। আমাদের দু’জনের হাতে ছিল দুটি শাবল। কিন্তু শাবল দিয়ে তো আর ব্রিজ ভাঙা যায় না। সেতুর ওপর শাবল দিয়ে যতবার আঘাত করি, আগুন জ্বলে ওঠে। কয়েক ঘণ্টা নিষ্ফল চেষ্টার পর আমরা হতাশ হয়ে ফিরে আসি। তখনকার তরুণ বয়সের অবুঝ বুদ্ধির কথা মনে পড়লে এখনও মনে মনে হেসে উঠি। 

২. ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে শহর থেকে আনুমানিক ২০ কিলোমিটার দূরে বর্তমানে বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর (দোয়ারিকা) ও মেজর এম এ জলিল (শিকারপুর) সেতু। একাত্তরে এ দুটি পয়েন্টে দড়িটানা ফেরি ছিল। মোটা দড়ি (কাছি) টেনে কাঠবডির ফেরিতে যানবাহন পার করা হতো। ফেরি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিলে পাকিস্তানি বাহিনী আর বরিশালে ঢুকতে পারবে না– এমন বুদ্ধি আমাদের মাথায় ঘুরপাক খায়। দোয়ারিকা ও শিকারপুরের সব ফেরিতে আগুন দেওয়ার জন্য ২৭ মার্চ আমরা সেখানে যাই। আমিসহ ওই দলে ছিলেন আমির হোসেন আমু (আওয়ামী লীগ নেতা), এম এ বারেক (প্রয়াত সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান) এবং শহরের প্যারারা রোডের বাসিন্দা এনায়েত হোসেন চৌধুরী। আমরা একটি ফেরিতে পেট্রোল ঢেলে অগ্নিসংযোগ করি। কিন্তু ফেরির চারদিকে আগুন লাগিয়ে দেওয়ায় আমরা ফেরির মাঝখানে আটকে পড়ে যাই। জীবন বাঁচাতে দিগ্বিদিক হয়ে নদীতে ঝাঁপ দিই। আল্লাহর রহমতে সবাই সাঁতরে তীরে উঠতে সক্ষম হই।

৩. ২৫ এপ্রিল যুদ্ধবিমানে বোমা হামলা করে প্যারাসুটে নেমে বরিশাল দখলে নেয় পাকিস্তানি বাহিনী। প্রতিরোধ যুদ্ধে টিকতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধারা পালিয়ে গ্রামের দিকে চলে যান। পরে বিভিন্ন পথে প্রায় সবাই পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি পেয়ারাবাগানে মিলিত হন। এর পরে একে একে বেশির ভাগ মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে চলে যান। পহেলা মে ভারতে পশ্চিমবঙ্গের হাসনাবাদের ইছা নদীর তীরে ৯ নম্বর সেক্টরের ট্রেনিং ক্যাম্প গঠন করা হয়। ট্রেনিং নিতে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের অভ্যর্থনার দায়িত্ব দেওয়া হয় আমাকে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে আসা তরুণদের প্রশিক্ষণের জন্য বিভিন্ন ক্যাম্পে হস্তান্তরের বিষয়টি দেখভাল করতে হতো। আমাদের অভ্যর্থনা ক্যাম্পটি ছিল ছোট একটি টিনের ঘর। সেখানে আমিসহ ১০-১২ জন অবস্থান করতাম। দেখা যেত রাতে যে ২০-২৫ জন যুবক আসত প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে যাওয়ার জন্য, তাদের অভ্যর্থনা কক্ষে থাকতে দিয়ে আমরা সামনের খাটিয়ায় ঘুমাতাম। ক্যাম্পের সামনে যে খাটিয়াগুলো থাকত সেখানে দিনের বেলা বাজারে দোকানিরা পণ্য নিয়ে বসত এবং রাতের বেলা খাটিয়াগুলো ফাঁকাই থাকত। প্রায়ই সেখানে যখন ঘুমাতাম সকালে উঠে দেখতাম, আমার পাশে কুকুর ঘুমিয়ে আছে।

৪. আমি ২৫ মে রাতে শপথ নিয়েছিলাম, দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত দাড়ি-চুল কাটব না। জুলাই মাসের প্রথম দিকে রাত ১২টায় আমাকে ভারতীয় বিএসএফের ক্যাপ্টেন শিপা ডেকে বলেন, ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি ট্রাকে করে তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার জন্য। ওখান থেকে ৯০ যুবককে কল্যাণী স্কুলে জেড ফোর্সের প্রধান জিয়াউর রহমানের কাছে নিয়ে যাওয়া হবে। আমি প্রথম যে ট্রাকে উঠতে চেয়েছিলাম, তার চালক ছিলেন বিহারি এবং সামনের ট্রাকটির চালক ছিলেন শিখ। বিহারি চালকের ট্রাকে উঠতে গেলে আমার দাড়ি-চুল বড় দেখে শিখ চালক ডেকে তাঁর ট্রাকে উঠতে বলেন। যেহেতু শিখদেরও চুল-দাড়ি বড় থাকে, তাই আমাকে পছন্দ হয়েছে বলে আমার ধারণা। আমাদের ট্রাকটি দ্রুত টার্কি ক্যাম্পের সামনে পৌঁছাই। কিন্তু তখনও পেছনের ট্রাকের দেখা নেই। পরে খবর পাই, ট্রাকটি খাদে পড়ে ১০-১২ জন ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা নিহত হয়েছেন। আমরা গিয়ে নিহতদের দাফন ও আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করি। সেদিনকার দাড়ি-চুলের জন্যই আজও আমি বেঁচে আছি– আমার বিশ্বাস। 

৫. মুক্তিযুদ্ধের সময় শত্রুর বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই এবং শত্রুকবলিত এলাকার জনগণকে স্বাধীনতার পক্ষে উজ্জীবিত করার জন্য ‘বিপ্লবী বাংলাদেশ’ নামে একটি পত্রিকা বের করি। সপ্তাহে পাঁচ দিন সংবাদ প্রকাশের জন্য তথ্য সংগ্রহ করতাম। প্রকাশিত পত্রিকা মুক্তিযোদ্ধারা দেশের অভ্যন্তরে বিতরণ করতেন। ১৯৭১ সালের ২৯ আগস্ট তৃতীয় সংখ্যায় ‘তিন মাসের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ শেষ হবে’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশ করা হয়। সংবাদটি দেখে মুক্তিবাহিনীর প্রধান কর্নেল এমএজি ওসমানী আমাকে ডেকে পাঠান। আমি তাঁর সঙ্গে কলকাতায় দেখা করি ভয়ে ভয়ে। আমার কাছে জানতে চান, ‘তিন মাসের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ শেষ হবে’– কোথা থেকে এমন তথ্য পেলাম। আমি তাঁকে এ তথ্য দিতে অপারগতা জানালাম। আমি না বলায় তিনি আমাকে জানিয়ে দেন, এখন থেকে সপ্তাহের প্রতি শনিবার আমাদের দপ্তর থেকে ‘প্রেস বিজ্ঞপ্তি’ দেওয়া হবে। তা ছাড়া তুমি সংবাদ প্রকাশ করতে পারবে না। ভারতীয় ক্যানভাস সার্কেল কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও শিল্পীর অধিকাংশই ছিলেন বামপন্থি। সংবাদটি তারাই দিয়েছিল। শর্ত ছিল, তাদের নাম কোনোভাবে প্রকাশ করা যাবে না।

৬. তখন একটি নিষেধাজ্ঞা ছিল, বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার ও ভারত সরকারের অনুমতি ছাড়া কোনো সাংবাদিক বা শিল্পী মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধক্ষেত্র পরিদর্শন করতে পারবেন না। ক্যানভাস সার্কেল আমাকে জানালেন, চিত্রনাট্যকার মিহির সেন ও ধীরেন্দ্র দাশগুপ্তের প্রযোজনায় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ‘জয় বাংলা’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে চান। বিষয়টি ৯ নম্বর সেক্টরের সংগঠক নূরুল ইসলাম মঞ্জুর ও সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিলকে জানাই। তারা আমাকে ৯ নম্বর সেক্টরের গাড়ি দিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাতাদের নিয়ে যেতে বলেন। ওই চলচ্চিত্রে আমি এবং মেজর জলিল অভিনয় করেছি। 

অনুলিখন
সুমন চৌধুরী
স্টাফ রিপোর্টার, বরিশাল ব্যুরো

আরও পড়ুন

×