ঢাকা বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫

বড় ভাইয়ের লাশ খুঁজে পাইনি

বড় ভাইয়ের লাশ খুঁজে পাইনি

মো. হাবিবুর রহমান

মো. হাবিবুর রহমান

প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:১১ | আপডেট: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১৫:১৩

আমি মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের যুদ্ধাহত একজন মুক্তিযোদ্ধা। ১১ নম্বর সেক্টরের অধীনে মুক্তিযুদ্ধ করেছি। প্রথমে আমার সেক্টর কমান্ডার ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু তাহের, পরে তিনি আহত হওয়ার পর সেক্টর কমান্ডার হন উইং কমান্ডার হামিদুল্লাহ খান। তাঁর নেতৃত্বে আমরা যুদ্ধ শুরু করি। ১৯৭১ সালে আমি তখন পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে কর্মরত ছিলাম। দেশে ব্যাপক অস্থিরতা চলছে। যে কোনো সময় যে কোনো কিছু হতে পারে। এমন অবস্থায় আমার হৃদয় জবাই করা কবুতরের মতো ছটফট করতে থাকে, তখন আমার মাথায় কেবল চিন্তা– কীভাবে আমি দেশে ফিরে যাব।

মায়ের অসুস্থতার কথা বলে তিন মাসের ছুটির আবেদন করি, আবেদন মঞ্জুর হয়। এর পর ফেব্রুয়ারি মাসের ৬ তারিখ সকাল সোয়া ৬টায় বিমানের ফ্লাইটে উঠি, ঠিক দুপুর ১টা ৩৫ মিনিটে ঢাকা এয়ারপোর্টে এসে নামি। স্বাধীনতার ঘোষণার পর থেকেই প্রস্তুত হতে থাকি আমরা। আমিসহ সেনাবাহিনী থেকে চলে আসা আরও কয়েকজন বন্ধুবান্ধব মিলে পাঁচ-ছয়জনের একটি গ্রুপ মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। আমাদের সঙ্গে সেই সময় যোগ দেয় আমাদের এলাকা মানে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার তেলিগ্রামসহ আশপাশের এলাকার কলেজে পড়া বেশ কিছু ছাত্র। ভারতের ডালু স্কুল ঘরে ছিল আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প। সেখান থেকে আমরা মাঝেমধ্যেই পাকিস্তানিদের বিভিন্ন ক্যাম্পের আশপাশে বেশ কয়েকটি ফাঁকা গুলি ছুড়ে পালিয়ে যেতাম। আর পাকিস্তানি সেনারা ভাবত, আমরা আশপাশেই আছি, তারা অনবরত গুলি করত আর এভাবেই তাদের রসদ কমে আসত। জুন মাসের ৬ তারিখ বাবু মান্নানের নেতৃত্বে আমরা বাংলাদেশে প্রবেশ করি। 

মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় ১৫ থেকে ১৬টি যুদ্ধের সম্মুখভাগে আমি অংশ নিয়েছি। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য মুক্তাগাছা, ভিটিবাড়ি, বটতলী, রাঙ্গামাটিয়া, ধুরধুরিয়া, আছিম এবং লক্ষ্মীপুরের যুদ্ধের মতো কয়েকটি লড়াই। যতগুলো যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি, তার মধ্যে সবচেয়ে স্মরণীয় হলো ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার লক্ষ্মীপুরের যুদ্ধ। তার অন্যতম কারণ ছিল, আমরা ছিলাম মাত্র ১৭ জন মুক্তিযোদ্ধা, ১৭ জন যোদ্ধাই অ্যামবুশ পজিশনে যুদ্ধ করি। তবে এই লড়াইয়ের পেছনে কাহিনি আছে। পাকিস্তানি বাহিনীর কানে খবর যায়, আমরা গ্রাম থেকে যুদ্ধে গিয়েছি। তখন পাকিস্তানি সেনারা আমিসহ সঙ্গের কয়েকজনের বাড়িতে খোঁজ করতে যায়, না পেয়ে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়ে আসে, কয়েকজনকে ধরে নিয়ে গিয়ে মারধর করে। সেই প্রতিশোধটাই আমরা নিতে চেয়েছিলাম। যেহেতু সারারাত ওরা যুদ্ধ করেছে, তাই ক্লান্ত ছিল। সকালের পর ঠিক দুপুরের আগে ফুলবাড়িয়া থেকে একটি বেবিট্যাক্সি ময়মনসিংহের দিকে আসছিল। লক্ষ্মীপুর বাজারে এলেই তা আমরা দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করি ওদের অবস্থান। ওই সময় ড্রাইভার বলল, ‘আমি দেখলাম তারা গাড়িতে উঠতাছে এই রাস্তা ধইরা যাবে।’ পার্শ্ববর্তী কাটাখালী বাজারে আমাদের কিছু মুক্তিযোদ্ধা ছিল। তাদের খবর পাঠাই চলে আসার জন্য। তার পর দ্রুত সময়ের মধ্যে একটি ফাঁদ পাতার পরিকল্পনা গ্রহণ করি। 

লক্ষ্মীপুর এবং তেলিগ্রাম রাস্তার মাথায় একটি শেওড়া গাছের ঝোপ ছিল। সেই ঝোপে একটি এলএমজিসহ একজনকে প্রস্তুত রাখি, টেলিগ্রামের রাস্তার পাশে অনেক বড় আমগাছ ছিল। সেই গাছের আড়ালে আড়ালে একেকজন পজিশনে চলে যাই। বাজারের পাশেই রামেশ্বর মুচিট বাড়ির প্রস্রাবখানার সামনে অবস্থান একজনের। 

এদিকে লক্ষ্মীপুর বাজারে ওঠার আগেই একটি ছোট ব্রিজ পার হতে হয়, আর সেখানে গাড়িটা স্লো করবে তারা। লক্ষ্মীপুর বাজারের মধ্যে একটি বড় রেইনট্রি গাছ, গাছের আড়ালে আমিসহ আরও দু’জন পজিশনে থাকি। প্রথম ধাপে আমাদের মূলত তিনটি টার্গেট। একজন গাড়ির ওপরে মেশিন গান নিয়ে যে সৈনিকটি দাঁড়িয়ে থাকবে তাকে গুলি করা, একজন গাড়ির সামনের চাকায় গুলি করবে, আরেকজন ড্রাইভারের মাথায় গুলি করবে। আর এই তিনটি গুলি বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হবে আমাদের সবার আক্রমণ। এটা ছিল আমাদের প্রথম প্ল্যান। তবে দ্বিতীয় প্ল্যানটি আরও রোমাঞ্চকর। কেননা, পাকিস্তানি সেনারা যে পাশে নামবে, তার পাশেই ছোট একটা ডোবা আছে, ছোট ছোট সবুজ কচুরিপানায় ভরা, দেখলে মনে হবে শুকনো মাটিতে কচুরিপানা পড়ে আছে। যদি একবার সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তাহলে অন্তত কোমরসমান কাদায় ডুবে যাবে।

যা-ই হোক, দূর থেকে গাড়ি আসার শব্দ পেলাম। আমরা সবাই প্রস্তুত হই, প্রথমে তিনটি গুলি। ঠিকঠাকভাবেই আমরা অ্যামবুশ সাজিয়েছি। গাড়িটি ব্রিজের কাছে এসে যখনই স্লো করে, রামেশ্বর মুচিট বাড়ির প্রস্রাবখানার সামনে যে মুক্তিযোদ্ধা ছিল, সে মেশিনগান তাক করা পাকিস্তানি সৈনিককে গুলি করে, আর এখান থেকে যথারীতি আমরা ড্রাইভার এবং গাড়ির চাকায় গুলি করতে সক্ষম হই। বলতে না বলতেই গাড়িতে থাকা সব পাকিস্তানি সেনা লাফিয়ে পড়ে সেই পাশের ছোট্ট ডোবায় আর সঙ্গে সঙ্গে দেবে যায় কাদায়। আর ওদিকে এলএমজি নিয়ে ঝোপে লুকিয়ে থাকা তৎকালীন ইপিআরের সৈনিক ইদ্রিস আলী কথামতো এলএমজি দিয়ে ব্রাশফায়ার করতে থাকে। চারপাশ থেকে অনবরত গুলি, মুহূর্তের মধ্যেই ঝাঁঝরা হয়ে যায় প্রত্যেক পাকিস্তানি সেনার বুক। ওই অপারেশনে ৩০ থেকে ৩৫ পাকিস্তানি সেনাকে খতম করতে পেরেছিলাম; যাদের মধ্যে পাঁচ থেকে ছয়জন জাঁদরেল সেনা অফিসার ছিলেন। আর আমরা ছিলাম মাত্র ১৭  মুক্তিযোদ্ধা। তবে একজন সৈনিক আহত অবস্থায় দৌড়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়, তাই সেখানে খুব বেশি সময় থাকা সম্ভব ছিল না। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিই, একটা গ্রেনেড দিয়ে মিলিটারির গাড়িটাকে উড়িয়ে দেওয়ার। বলতে না বলতেই মুহূর্তে গ্রেনেড খুলে ছুড়ে মারি। বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে পুরো লক্ষ্মীপুর গ্রাম। 
সেই সঙ্গে আরেকটি শব্দ আমাদের প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধার কানে এসে লাগে– ‘ও-বাবা, ও-মাগো, মইরা গেলাম গো …’ সেই মুহূর্তে কয়েকজন মিলে দৌড়ে গাড়ির পেছনে গিয়ে দেখি গ্রেনেডের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে হাত-পা বাঁধা পড়ে আছে এক কিশোরী মেয়ে। মুহূর্তে আমরা বাক্‌রুদ্ধ হয়ে গেলাম। একবারও যদি বলত, আমাকে বাঁচান, কে আছেন? আমরা গ্রেনেড ছুড়ে মারতাম না, মেয়েটিকে অক্ষত বাঁচাতে পারতাম। কিন্তু আমাদের অ্যামবুশের নিয়ম হলো, অপারেশন হবে চার থেকে পাঁচ মিনিট, কিন্তু সেখানে আমরা ৪০ মিনিট যুদ্ধ করেছি। তাই এখন আর থাকা যাবে না। দ্রুত সরে যাই সেখান থেকে। মেয়েটার এমন করুণ পরিণতি দেখে সবাই অশ্রুসিক্ত হয়ে ফিরেছিলাম। পরে জানতে পারি, দক্ষিণাঞ্চল থেকে মেয়েটিকে তুলে আনা হয়।

বিজয়ের মুহূর্তের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। মনে হচ্ছিল, পৃথিবীর সবচেয়ে সাহসী বীর আমরা, সুখী মানুষ আমরা। বুকভরা আশা ও একরাশ আনন্দ নিয়ে বাড়ি ফিরি। মা আমাকে দেখে দূর থেকে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘বাবা, তুই বেঁচে আছিস? তোর ভাইটা তো নেই, ওরা ধরে নিয়ে গেছে ... আর তো এলো না ...।’ সব আনন্দ যেন ম্লান হয়ে গেল আমার। আমার বড় ভাইকে বাড়িতে রেখে গিয়েছিলাম বাবা-মাকে দেখাশোনার জন্য। আমি যুদ্ধে যাওয়ার খবরে প্রায় সময় রাজাকার, আলবদররা আমার খোঁজ করতে বাড়িতে আসে। সেই দিনের অপারেশনের পর আমাকে বাড়িতে না পেয়ে বড় ভাইকে ধরে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাঁর লাশ অনেক খুঁজেও পাইনি। বিজয়ের দিন আমার বুক ছিল ভারাক্রান্ত। সেই দিন বুঝেছি, কিছু পেতে হলে কিছু হারাতে হয়, আর তা যতই মূল্যবান হোক না কেন। আমি আর বড় ভাই একই স্কুলে পড়তাম একই ক্লাসে। একসঙ্গে খেলতাম। খুব আদরের বড় ভাই। মনে হলো, তাঁকে হারিয়ে বাংলাদেশের একটা স্বাধীন লাল-সবুজের পতাকা পেয়েছি। বুড়ো হয়েছি। বাঁচব আর কতদিন, নানান রোগব্যাধি বাসা বেঁধেছে শরীরে। এই জীবনে অনেক কিছু দেখেছি। অনেক মুক্তিযোদ্ধা অসহায় জীবনযাপন করেছেন। সঠিক চিকিৎসা পাননি। জীবনের শেষ সময়ে একটি মাত্র চাওয়া, লক্ষ্মীপুরের সেই যুদ্ধে আমি প্লাটুন কমান্ডার ছিলাম। এই যুদ্ধটিকে কেন্দ্র করে এখানে, মানে লক্ষ্মীপুর বাজারে যেন একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি হয়। এই যুদ্ধের স্বীকৃতিটুকু যেন আমি পাই। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এর থেকে বেশি কিছু চাওয়া আমার নেই। 

অনুলিখন
ইমতিয়াজ আহমেদ
সংবাদকর্মী

আরও পড়ুন

×