অর্থনীতির গতি প্রকৃতি

ফয়জুল লতিফ চৌধুরী
ফয়জুল লতিফ চৌধুরী
প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৩ | ২২:৩৩ | আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৩ | ১৫:৪৯
দেশের অর্থনীতির অবস্থাটা হঠাৎ করেই খারাপ হয়ে গেল। দু’বছর আগেও মনে হচ্ছিল সব ঠিকঠাক চলছে। বাজেটের আকার বৃদ্ধি পাচ্ছিল, জাতীয় আয় ক্রমান্বয়ে বেড়েছিল, উন্নয়ন খাতের ব্যয় অনেক বৃদ্ধি করা হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল বাংলাদেশ একটি সুষ্ঠু ও আদর্শস্থানীয় অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে।
১৯৮২ সালে ক্লাসে বাংলাদেশের অর্থনীতি পড়াতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোশাররফ হোসেন প্রশ্ন করেছিলেন: বাংলাদেশের অর্থনীতির সমস্যাটি কোথায়? আজ এ প্রশ্নটি আবার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেছে। কিছুদিন আগেও মনে গভীর প্রশান্তি নিয়ে আমরা লক্ষ্য করেছিলাম যে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় ৪৩ বিলিয়ন ডলারের ঘরে পৌঁছে গেছে। আজ যখন আমরা আমাদের ৫৩তম বিজয় দিবস উদযাপন করতে যাচ্ছি তখন আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার তহবিল কার্যত ১৯ বিলিয়ন ডলার বা আরও নিচে নেমে গেছে।
রপ্তানির অবস্থা ভালো যাচ্ছে না। রপ্তানি থেকে আমদানি বাদ দিলে নেট রপ্তানির পরিমাণ ঋণাত্মক। তবে বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশিদের পাঠানো রেমিট্যান্স আমাদের নির্ভরতার বড় জায়গা। সেই রেমিট্যান্সের সুখকর জোয়ারে ভাটার টান পড়েছে। ২০২০ সালের জুলাই মাসে রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ২.৬ বিলিয়ন ডলার। আর চলতি বছর সেপ্টেম্বর মাসে রেমিট্যান্সের পরিমাণ কমতে কমতে ১.৩৩ বিলিয়ন ডলারে এসে ঠেকে গেছে। ডলারের বিনিময় হার ঠিক করতে গিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দেড় বছর যাবৎ হিমশিম খেতে হচ্ছে। ৮৫ টাকার ডলার এখন প্রায় ১৩৩ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। উপরন্তু প্রয়োজন অনুযায়ী ডলার তৎক্ষণাৎ পাওয়া যাচ্ছে না। ডলারের বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক নানা ধরনের কৃৎকৌশল প্রয়োগ করে চলেছে। কিন্তু কোনো ওষুধেই কাজ হচ্ছে না। ডলারের মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।
অন্যদিকে মুদ্রাস্ফীতির চাপ মানুষকে বিপর্যস্ত করে ফেলেছে। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার ঠিক কী ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে জনগণের কাছে তা স্পষ্ট নয়। গ্রামীণ এলাকায় অবস্থিত ব্যাংকগুলোতে রাখা সাধারণ মানুষের আমানত গত জুন মাসের তুলনায় সেপ্টেম্বর মাসে অর্থাৎ মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা হ্রাস পেয়েছে। সন্দেহ নেই সঞ্চয় ভেঙে মানুষকে বাজারের দৈনন্দিন খরচ মেটাতে হচ্ছে। এক সাক্ষাৎকারে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ডক্টর বদিউর রহমান বলেছেন যে সঞ্চয়পত্র ভাঙিয়ে তিনি এ বছর ইনকাম ট্যাক্সের টাকা পরিশোধ করেছেন। কয়েক বছর আগেও এ ধরনের অবস্থা কল্পনা করা যেত না। তাহলে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু বার্ষিক আয় ২৬শ ডলার এবং জাতীয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার বার্ষিক ৬ শতাংশের ওপর– এসব পরিসংখ্যান কি প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলেছে?
সম্ভবত না। কারণ দেশে মিলিয়নেয়ারের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে এ কথা ভুলে গেলে চলে না। মিলিয়নেয়ার অর্থাৎ ব্যাংকে কমপক্ষে ১০ লাখ টাকা আমানত আছে এরকম মানুষের সংখ্যা বর্তমানে আড়াই লাখ। ২০০৯ সালে মিলিয়নেয়ারের সংখ্যা ছিল মাত্র ৪৪ হাজার ৩৬৯ জন। ২০২৩ সালে এই সংখ্যা ২ লাখ ৪৯ হাজার ৬৮৮ জনে উন্নীত হয়েছে। সন্দেহ কী যে দেশের অর্থনীতির চাকা জোরে ঘুরছে এবং সামষ্টিক জাতীয় আয়ের দ্রুত বৃদ্ধি ঘটছে বলেই মানুষ ধনী ও সম্পদশালী হতে পারছে। ১০০ বছর আগেও কারও হাতে এক লাখ টাকা সঞ্চিত হলে নিজ বাড়িতে বাঁশের আগায় কুপি জ্বালিয়ে সারা গ্রামে জানান দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। একে বলা হতো ‘লাখের বাতি’। আজ যাদের কোটি টাকা আছে তাদের প্রত্যেককে বাতি জ্বালাতে হলে প্রায় দেড় লাখ ‘কোটির বাতি’ জ্বালাতে হবে। লাখ, মিলিয়ন বা কোটিতে হবে না; কতজনের কাছে কমপক্ষে ১০০ কোটি টাকা রয়েছে তা হিসাব করার দিন এখন এসে গেছে।
এ তো গেল দেশের ব্যাংকে গচ্ছিত টাকার হিসাবের কথা। প্রবল জনশ্রুতি এই যে বাংলাদেশের হাজার হাজার মানুষ বিদেশের মাটিতে বড় ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছে। এ প্রসঙ্গে সিঙ্গাপুর এবং দুবাইয়ের কথা প্রায়শ উচ্চারিত হয়ে থাকে। এসব শহরে কতজন বাংলাদেশি কত টাকা জমিয়েছেন তার কোনো হিসাব নেই। তবে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ এক বছরে ৫৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ২০০১ সালে ৮ হাজার ২৬৬ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছিল। এসব টাকার মালিকদের নাম-পরিচয় জানা সম্ভব হয় না। শোনা যাচ্ছে, অনেকে সুইজারল্যান্ড থেকে টাকা সরিয়ে পানামা, লুক্সেমবুর্গ, বেলজিয়াম ইত্যাদি দেশের ব্যাংকগুলোতে গচ্ছিত রেখেছেন।
প্রশ্নযোগ্য বিষয় হলো: যারা টাকা কামাচ্ছেন তারা দেশের ব্যাংকে টাকা রাখা নিরাপদ মনে করছেন না কেন। ‘দেশে টাকা রাখা নিরাপদ নয়’– এরকম বিশ্বাস থেকেই তারা দেশে অর্জিত টাকা বিদেশে সরিয়ে ফেলছেন। এমনকি রপ্তানিকারকরাও তাদের পণ্যের মূল্য দেশে না-এনে বিদেশে গ্রহণ করছেন। গত এক বছরে বিদেশে রপ্তানীকৃত যে সকল পণ্য চালানের দাম দেশে আসেনি সেগুলোর সামগ্রিক মূল্যমান ১২ বিলিয়ন ডলার, যা আমাদের অন্তত দুই মাসের আমদানি-সক্ষমতার সমান। রপ্তানি আয়ের টাকা কোনোক্রমেই ‘কালো টাকা’ নয়, তবু তা দেশে আনতে সাহস করছেন না ব্যবসায়ীরা। এই বিষয়টি গভীরভাবে ভেবে দেখা দরকার। যে বিষয়গুলো আলোচকদের বিশ্লেষকদের নিকট যথাযথ মনোযোগ পাচ্ছে না, তার মধ্যে রয়েছে জিনি কো-ইফিশিয়েন্ট। দেশে একদিকে মাথাপিছু আয় বেড়েছে, অন্যদিকে জিনি কো-ইফিশিয়েন্টের মান বাড়তে বাড়তে দশমিক ৪৯৯ গিয়ে ঠেকেছে। অর্থাৎ আয়বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এই বৃদ্ধি চলমান রয়েছে।
বাংলাদেশের সংবিধানে দেশের উন্নয়নের কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখিত নেই কিন্তু আয় বণ্টনে সমতা আনয়নের কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখিত আছে। অর্থাৎ আয়বণ্টনে সমতা নিশ্চিত ও বৈষম্য দূর করা উন্নয়নের চেয়ে প্রাগ্রাধিকার পাবে।
দ্বিতীয় যে বিষয়টির প্রতি আমাদের মনোযোগের অভাব রয়েছে তা হলো, দেশে যে বিনিয়োগ হচ্ছে, সে অর্থের উৎস কী? জাতীয় রাজস্ব বোর্ড শুল্ক-কর হিসাবে যে রাজস্বের জোগান দিচ্ছে তা অপ্রতুল। গত কয়েক বছর যাবৎ ট্যাক্স-জিডিপির অনুপাত বৃদ্ধির পরিবর্তে হ্রাস পেয়েছে। কার্যত আমরা ঋণ করে বিনিয়োগ করার নীতি জোরেশোরে অবলম্বন করেছি। বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ গ্রহণ করছি আমরা। কিন্তু এ ঋণের টাকা আমাদের পরিশোধ করতে হবে। কেবল ঋণের টাকা তো নয়, ঋণের ওপর প্রদেয় সুদও যথাসময়ে পরিশোধ করতে হবে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রাক্কলন অনুযায়ী সমাগত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের ডেট সার্ভিসিং লায়াবিলিটি (ডিএসএল) ১ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে যাবে। দুই বছর আগেও দেশের ডেট সার্ভিসিং লায়াবিলিটির পরিমাণ ছিল মাত্র ৪৯৬ মিলিয়ন ডলার। অদূর ভবিষ্যতে সুদ-আসল পরিশোধের বোঝা আরও বৃদ্ধি পাবে। প্রাক্কলন অনুযায়ী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের সুদ-আসল পরিশোধের দায় ৪ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে। এই দায়ভার আমরা কী করে মেটাব?
অনেকে বলেন, আমাদের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ জিডিপির অনুপাতে খুব বেশি নয়। এই কথা বাংলাদেশের জন্য খাটে না। আমাদের দেখা উচিত ছিল ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা অর্থনীতির আছে কি নেই। আরও দেখা দরকার, ডলারে ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা থাকবে কিনা। দেশে শুল্ক-কর আদায়ের পরিমাণ কম হলে টাকা ছাপিয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন ও ভাতা পরিশোধ করা সম্ভব। কিন্তু টাকা ছাপিয়ে তো বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করা যায় না। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ৪.৭ বিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা হিসেবে দিতে সম্মত হয়েছে। এই সাহায্য যথেষ্ট নয়। শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে– আমরা কবে ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হব?
উন্নয়নের বিনিময়ে দেশে আমরা আয়বৈষম্য বাড়িয়েছি। আয়বৈষম্য এতটাই বেড়েছে যে আজ দাবি উঠেছে কোটিপতিদের সামগ্রিক আয় বাদ দিয়ে মাথাপিছু আয় পরিমাপ করা হোক। এই হিসাব কোনো কঠিন কাজ নয়। সাধারণ মানুষের মাথাপিছু আয় ঠিক কত এবং তা বছর বছর কতটা বাড়ছে– এরকম হিসাব নীতিনির্ধারকদের সঠিক পথে পরিচালিত করবে। বড় কথা, আমাদের হাতে যতটুকু কাপড় রয়েছে তার সমানুপাতেই শার্ট বানাতে হবে। উন্নয়ন পরিকল্পনাকে বাস্তবোচিত করার সময় অতিক্রান্ত হয়ে যায়নি। গুচ্ছ গুচ্ছ উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ না করে জাতীয় প্রাগ্রাধিকারের ভিত্তিতে উন্নয়ন পরিকল্পনা দরকার। আমাদের দরকার দৈনিক ১ হাজার ৪৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা– আমরা ইতোমধ্যে প্রায় তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা পরিগঠন করেছি। যেসব বড় বড় উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে তার পরিবর্তে অধিকতর উপযোগিতা সমৃদ্ধি উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করার সুযোগ ছিল। এসব বিষয় ভেবে দেখা দরকার। অর্থনীতিকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার জন্য কেবল ডলারের বিনিময় হার স্থিতিশীল করা যথেষ্ট নয়– অনেক কঠিন কঠিন পদক্ষেপ গ্রহণ করার দরকার থাকতে পারে। যথোচিৎ পদক্ষেপ চিহ্নিতকরণে বিলম্ব হলে সমস্যা দুরারোগ্য ব্যাধিতে পরিণত হতে পারে।
সর্বপ্রথমে ঋণ করে দেশের উন্নয়ন করার যে আপ্ত তত্ত্ব, তা পুনর্বিবেচনা করতে হবে। এই নীতি পরিত্যাগ করে দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা অনুযায়ী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের উচ্চাঙ্ক্ষার যৌক্তিকীকরণ এখন সময়ের দাবি। যেসব প্রকল্প থেকে সাধারণ মানুষের উপকার পাবে না বা অনেক দেরিতে পাবে সেগুলো পরিত্যাজ্য।
কেউ কেউ বলেন, ‘চার্বাক’ কোন ব্যক্তির নাম নয়; ‘চার্বাক’ হলো জড়বাদীদের সাধারণ নাম। চার্বাক বলতে তাদেরকেই বোঝায় যারা বলেন, ‘খাও, দাও, আনন্দ করো।’ চার্বাক দর্শনে রয়েছে, “ঋণং কৃত্যং ঘৃতং পিবেত। – ঋণ ক’রে হলেও ঘি ঘাও– সুখে থাকো, আনন্দে থাকো।” চার্বাক চ্যালারা বলেন, ‘চর্বন্তে পুণ্য পাপাদিকম্ বস্তু বীজম্ ইতি চার্বাকা।’ ঋণ করে উন্নয়ন করতে গিয়ে আমরাও নিজেদের চিবিয়ে নিঃশেষ করে ফেলছি না তো?
লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক