সংস্কৃতির অবনমন

মামুনুর রশীদ
মামুনুর রশীদ
প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৩ | ২২:৩৪ | আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৩ | ১১:৫৯
একটা কথা বললে সবাই হয়তো হাসবে। ষাটের দশকে আমাদের টাকার প্রয়োজন ছিল না। এ দেশে তখন অনেক বড়লোক ছিল না। আমরা যারা মধ্যবিত্ত সামান্য টাকাতেই আমাদের চলত। কখনও কখনও টাকা না থাকলেও চলত। কিন্তু ছিল জ্ঞানচর্চা। গ্রাম ও শহরে পড়ালেখাটা ঠিকমতো চলত। শিক্ষকরা খুব কম টাকা পেতেন। কোনো কোনো স্কুলে শিক্ষকদের বেতনই হতো না। তাদের পরনে দুটির বেশি জামা থাকত না। তবুও খেলাধুলা, বিনোদন ছিল। স্কুল-কলেজে বড় বড় মাঠ ছিল। মানুষের মনে গান যেমন ছিল, তেমনি আগুনও ছিল। আর ছিল বুক ভরা বিক্ষোভ এবং রাস্তায় রাস্তায় মিছিল, সংগ্রাম। চাঁদা ছিল আট আনা, এক টাকা, সর্বোচ্চ পাঁচ টাকা। কিন্তু চাঁদাবাজি একেবারেই ছিল না। তিনরঙা, চাররঙা পোস্টার কল্পনাই করা যেত না। বড় বড় আন্দোলনের পোস্টার হাতে লেখা হতো। সবচেয়ে জনপ্রিয় পোস্টারটি ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন’ অথবা ‘ছয় দফার’ পোস্টারটিও একরঙা নিউজপ্রিন্টের ওপর ছাপা হতো। যারা রাজনীতি করতেন তারা বাইসাইকেল চালাতেন, মোটরসাইকেল নয়। মধ্যবিত্তদের ঘরে ঘরে হারমোনিয়াম, তবলা ছিল; একটা সস্তা রেডিও ছিল। মেয়েদের কাপড়ের ওপর এমব্রয়ডারিতে ছবি আঁকা শোভা পেত ঘরের দেয়ালে দেয়ালে। মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত ব্যক্তিদের বাড়িতে অতিথি আগমন ছিল অবারিত। এ সময়ে বোরকা, হিজাব খুব একটা দেখা যেত না। খুব রক্ষনশীল পরিবারের নারীরা ঘরের বাইরে বের হলে গায়ে চাদর ব্যবহার করতেন, তাও সেটা মুষ্টিমেয়। মাদ্রাসা ছিল জেলা বা মহকুমা শহরে একটি বা দুটি। মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এবং শিক্ষকরা সাধারণত খুবই শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। রাজনীতিতে তারা দৃশত তেমন অংশগ্রহণ করতেন না। একটা সাংস্কৃতিক উদ্দীপনা যেমন– পহেলা বৈশাখ, পঁচিশে বৈশাখ, বসন্ত উৎসব, নবান্ন উৎসব খুব অনাড়ম্বর হলেও তা প্রাণবন্ত ছিল। বেশ কয়েকটি সাহিত্য পত্রিকা নিয়মিত বের হতো। তার মধ্যে রাজশাহী থেকে পূর্বমেঘ, ঢাকা থেকে সমকাল এবং আধুনিক লেখকদের জন্য স্বাক্ষর, কণ্ঠস্বর– এগুলো বের হতো। চট্টগ্রাম থেকে বইঘরের প্রকাশনা খুবই নান্দনিক ছিল। এ ছাড়াও লিটল ম্যাগাজিনের চর্চা ছিল সারাদেশে; সেগুলো লেটার প্রেসে ছাপা হলেও তার মধ্যে শিল্পের ছাপ থাকত। এর মধ্যেই ছিল বড় ধরনের সব আন্দোলন। কৃষক আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন, ছাত্র রাজনীতি– এসব কিছু একাকার হয়ে একটা বড় আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিল। এর মধ্যেই উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান চলে এলো। যথারীতি ছাত্ররা সামনের সারিতে আর কৃষক-শ্রমিক জনতা চারদিকে। যে সংস্কৃতির কথা বললাম তাদের মধ্য থেকেই কারফিউ ভাঙার স্পর্ধার জন্ম নিল। যার ফলে স্বৈরাচারী সামরিক শাসক আইয়ুব খানের পতন হয়ে গেল। তবুও পাকিস্তান তার সামরিক শাসন বজায় রাখল। কিন্তু সত্তরের নির্বাচন প্রমাণ করল যে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ। প্রচুর শিল্প-সাহিত্যিকের জন্ম হলো। কবি শামসুর রাহমান মওলানা ভাসানীকে নিয়ে লিখলেন, মওলানার সফেদ পাঞ্জাবির মতো অসাধারণ কবিতা। তরুণ কবিদের মধ্যে নির্মলেন্দু গুণ হুলিয়া লিখলেন। তখন মঞ্চ নাটক ছিল না; টেলিভিশনে সব স্বৈরাচারবিরোধী নাটক দেখতাম আমরা। একাত্তর সালের মার্চ মাসে পাকিস্তান টেলিভিশন পুরোপুরি বাঙালিদের দখলে চলে এলো। ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ এক অবিস্মরণীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি করল। ২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তানিদের হঠাৎ আক্রমণ জাতিকে মুহূর্তের জন্য বিচলিত করলেও, হৃদয়ে এক আগ্নেয়াস্ত্রের জন্ম নিল। সত্যিই ঘরে ঘরে তখন দুর্গ গড়ে উঠল। জাতি যুদ্ধে চলে গেল। রক্তাক্ত নয় মাস বাংলাদেশকে স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেল। এই সময়েও একদিকে সশস্ত্র সংগ্রাম আর অন্যদিকে মুক্তিকামী মানুষের নিরস্ত্র অংশগ্রহণ মিলিয়ে একটি সামষ্টিক মুক্তিযুদ্ধের জন্ম দিয়েছে।
এদিকে কিছু রাজনৈতিক ব্যর্থতাও ছিল। যে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল ১৯৪৭ সাল থেকে স্বাধীনতার বিষয়টি বুঝতে পেরেছিল তারাও সক্রিয় হয়ে উঠল। যার ফলাফল পঁচাত্তরের মধ্য আগস্টের বর্বর নিষ্ঠুরতা! পাকিস্তান ফেরত সেনাবাহিনীর সদস্য এবং কিছু মুক্তিযুদ্ধের বিভ্রান্ত কিছু সেনা অফিসার মিলে পাকিস্তানি কায়দায় একটা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে। এই শক্তি ১৫টি বছর মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তিকে রাজনৈতিক ক্ষমতার অংশীদারিত্ব দিয়ে একটা নতুন সংস্কৃতির জন্ম দেয়। এরা শিল্প-সাহিত্যকে দখল করতে পারেনি। কিন্তু ধর্মভীরু জনগণকে মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতি গ্রহণ করতে বাধ্য করে। দরিদ্র মানুষের তখন অভিবাসনের আকাঙ্ক্ষাকে তীব্র করে তোলে। জাতীয় শিক্ষানীতিকে পরিবর্তন করে একটি মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে। কিন্তু অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে শুভসংস্কৃতির একটা লড়াই চলে অবিরত।
এদিকে শ্রেণি সংগ্রামের রাজনীতি ও সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর কিছুটা ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ে। এটাই হয়েছে সবচেয়ে বড় সর্বনাশ। সারা পৃথিবীব্যপী সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতির মার্কেট ইকোনমি এবং গ্লোবালাইজেশনের একটা প্রবাহ শুরু হয়েছে। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে জনতার জয় হওয়া সত্ত্বেও গোপনে ধর্মীয় সংস্কৃতি এবং দোকান সংস্কৃতির জয় হয়েছে। দেশের সর্বত্র দোকান সংস্কৃতির একটা বিজয় সূচিত হয়েছে। যেখানে সেখানে দোকান এবং দুর্নীতিলব্ধ অর্থের ছড়াছড়ি। সেই সঙ্গে আরবি এবং ইংরেজি শিক্ষার এক ধরনের অপসংস্কৃতির শুরু হয়ে গেছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একটা বড় ধরনের ব্যাপার হচ্ছে ভোটের সংস্কৃতি। কোনো রাজনৈতিক দলই এই জায়গা থেকে মুক্ত নয়। তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহী দলগুলো এই ফাঁদে পা দিতে শুরু করল। যার পরিণতি হলো ভয়াবহ। যে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির জন্য বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে জন্মলাভ করল, সেখান থেকেও তারা সরে গেল। এর একটি ভয়ংকর প্রভাব পড়ল সমাজে। একদিকে দোকান সংস্কৃতি, অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি। দোকান সংস্কৃতিতে প্রচুর অর্থের চলাচল হলো কিন্তু অনেক অনর্থও ডেকে নিয়ে এলো। মানুষের লোভ-লালসা এমনভাবে বেড়ে গেল যে দুর্নীতি ছাড়া এই লোভ-লালসা সম্ভব নয়। এক ধরনের তদবির বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য এবং প্রশাসনিক ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে নানা ধরনের বাণিজ্যের পথ উন্মুক্ত করল। যার ফলে আস্তে আস্তে সমাজটা কলুষিত হতে লাগল। কলুষমুক্ত মানুষটিও এই সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেল, না হলে তার জীবনটাই বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। এই পরিস্থিতি চলছে গত ত্রিশ বছর ধরে; এর মধ্যে আকাশ উন্মুক্ত করা হলো বেসরকারি খাতে টেলিভিশন। প্রাইভেট টেলিভিশনগুলো তাদের বাণিজ্য ও অস্তিত্বের কারণে ভোগ্যপণ্যের বিজ্ঞাপনের একটা বড় অস্ত্র হয়ে গেল। বেসরকারি টেলিভিশনের লাইসেন্স বিতরণ একেবারেই রাজনৈতিক কারণে। কাজেই এখানে মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়াল ব্যবসা। পরবর্তীকালে প্রযুক্তির উন্নয়নের কারণে ইউটিউবের মতো দায়িত্বহীন প্রচারণা সমাজকে নানাভাবে প্রভাবিত করতে থাকল। উত্থান হলো নানা ধরনের হিরোর। এই হিরোরা কুৎসিত অপসংস্কৃতির নায়ক। যে নায়করা পঞ্চাশ-ষাটের দশকে জন্মলাভ করতে পারেনি, তারা আশির দশকেও চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে প্রযুক্তির কারণে তারা আর ব্যর্থ হয়নি। এখন চারিদিকে মিডিয়ার দৌরাত্ম্যে তাদের জয়জয়কার। সেই সঙ্গে আছে নিবেদিত প্রাণ সংস্কৃতিকর্মীদের ব্যস্ততা। তারা ভেবেছিল, দেশ স্বাধীন হলে যেহেতু সংবিধানে স্বীকৃত ধর্ম নিরপেক্ষতা আছে তাই তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। কিন্তু লড়াই যে অনিবার্য হলো সেটা তারা করতে পারেনি। ষাটের দশকের যে ঘটনাগুলোর বর্ণনা দিয়েছি, চিন্তার প্রবাহ যেদিকে গেছে তা নব্বইয়ের দশকে এসে অন্য একটা রূপ পেতে শুরু করল। একবিংশ শতাব্দীতে স্বজাতি শাসকরা এসব নতুন সাংস্কৃতিক উপাদানকে তেমন একটা গ্রাহ্য করল না। এমনকি একটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের দাবি-দাওয়াকেও তারা গ্রহণ করতে বাধ্য হলো। যার কারণে পাঠ্যপুস্তক পাল্টে গেল। এই পরিস্থিতি রাজনৈতিকভাবে খুব ভয়াবহ হলেও সংস্কৃতিকর্মীরা সেটা মেনে নেয়নি। সংস্কৃতি সব সময়ই গণতান্ত্রিক। যে কোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সংস্কৃতিকর্মীরা উঠে দাঁড়ায়। বিভক্ত জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করে। কিন্তু পরিস্থিতি চলে গেছে এখন টাকার হাতে। বাঙালি জাতির এক ধরনের মানুষের মধ্যে এমন লোভ-লালসা তৈরি হয়েছে যে তারা কোনো কিছুর পরোয়া করে না। এই রাষ্ট্র তাদের এমন সুবিধা দিয়েছে, দেশ ছেড়ে প্রবাসেও তারা তাদের বিপুল অর্থ পাচার করছে এবং এই দেশকে বাসযোগ্য মনে করছে না। আমরা যখন গত শতাব্দীর ষাটের কথা ভাবি, তখন এই সংস্কৃতির অবনমনকে আমরা কি মেনে নিতে পারি?
লেখক: সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব