ঢাকা বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫

অস্ত্র প্রশিক্ষকের দায়িত্ব ছিল আমার কাঁধে

অস্ত্র প্রশিক্ষকের দায়িত্ব ছিল আমার কাঁধে

আব্দুর রহমান মিঞা

আব্দুর রহমান মিঞা

প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:০১ | আপডেট: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১৫:১০

প্রত্যন্ত চলনবিলের আর দশজনের মতো আমিও সাধারণ একজন মানুষ। ১৯৭১ সালের রণাঙ্গনে আমি ছিলাম একজন বয়স্ক মুক্তিযোদ্ধা। তখন আমার বয়স ছিল ৫০ বছর। আমার জন্ম মা-বাবার রেখে যাওয়া জন্ম কুষ্ঠি অনুযায়ী ১৯২১ সালের ১৩ মার্চ, তাড়াশ উপজেলার ভাদাস গ্রামে। আমার বাবার নাম রায়হান উদ্দিন আকন্দ ও মায়ের নাম মরহুম ওমর জান বেগম। আমি ১৯৪২ সালে তাড়াশ এলাকার প্রথম মাধ্যমিক বিদ্যালয় বারুহাঁস ইউনিয়নের বস্তল ইসহাক হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করি। পরে এইচএসসি পাসও করি। ছাত্র অবস্থায় তারুণ্য শেষে যৌবনের প্রারম্ভে যখন ভারত বর্ষে বিট্রিশবিরোধী আন্দোলন চলমান ছিল, তখন এ অঞ্চলের আরেক কৃতিমান লেখক, অনলবর্ষী বক্তা ও কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘লাঙল’ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ব্রিটিশ শোষণ, নিপীড়ন, নির্যাতন ও জমিদারি বন্দোবস্ত প্রথা উচ্ছেদ আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা মাওলানা সেরাজুল হকের সান্নিধ্যে আসি। পাশাপাশি তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ, নীতির দীক্ষায় রাজনীতির হাতেখড়ি হয় আমার। 

১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারত-পাকিস্তান আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তী সময়ে পূর্ব পাকিস্তান আনসার বাহিনী নামে একটি বাহিনী প্রতিষ্ঠা করে। সেই আনসার বাহিনীতে আমি যোগ দিয়ে প্রশিক্ষণ পর্ব শেষ করি। পরে ধাপে ধাপে আনসার কমান্ডার হিসেবে দায়িত্বও পাই। পরে অবশ্য দক্ষতার পুরস্কার হিসেবে আনসার বাহিনীর সিরাজগঞ্জ মহকুমায় জ্যেষ্ঠ প্রশিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাই। এরপর ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলন, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর নানা ঘটনার পরিক্রমা পেরিয়ে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। সে যুদ্ধের একজন সম্মুখ যোদ্ধা ও অস্ত্র প্রশিক্ষক ছিলাম আমি।

উল্লেখ্য, চলনবিলাঞ্চলের যুদ্ধকালীন সংগঠন ছিল ‘পলাশডাঙ্গা যুব শিবির’। প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক আরেক বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল লতিফ মির্জা, অধিনায়ক সোরহাব আলী সরকার ও সহ-অধিনায়ক ম ম আমজাদ হোসেন মিলনের নেতৃত্বে সংগঠনটির যোদ্ধা ছিলাম আমরা প্রায় ৫৫০ জনের মতো। সেই সঙ্গে যুদ্ধকালীন এ সংগঠনের প্রধান অস্ত্র প্রশিক্ষকের দায়িত্ব আমার কাঁধেই চাপে। কেননা, আনসার বাহিনীতে কাজ করার সময় আমার নানা ধরনের অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা ছিল। দায়িত্ব কাঁধে নিয়েই ওই সংগঠনের  মুক্তিযোদ্ধাদের যথাসাধ্য প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করি। ঐতিহাসিক তাড়াশের নওগাঁর যুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত আমাদের যোদ্ধাদের কয়েক মাস তাড়াশ সদর, প্রতাপ, নওগাঁ এলাকায় প্রশিক্ষণ দিতে থাকি। এরই মধ্যে যুদ্ধকালীন ১৯৭১ সালের ১১ নভেম্বর উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে বড় ধরনের যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল চলনবিল অধ্যুষিত তাড়াশ উপজেলার নওগাঁ গ্রামের শাহ শরিফ জিন্দানী (রহ.) মাজার এলাকায়।

মনে পড়ে, ১১ নভেম্বরের আগে থেকেই প্রত্যন্ত চলনবিলের নওগাঁ গ্রামকে নিরাপদ স্থান মনে করে আমি ‘পলাশডাঙ্গা যুব শিবির’-এর ৪নং কোম্পানি কমান্ডার এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র প্রশিক্ষক হিসেবে অস্ত্র চালনা শেখানোর কাজ করছিলাম। কিন্তু তা বেশি সময় আর গোপন থাকেনি। বিষয়টি স্থানীয় রাজাকার-আলবদর সদস্যদের মাধ্যমে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কাছে পৌঁছে যায়। পাকিস্তানি বাহিনী আমাদের শায়েস্তা করতে ১০ নভেম্বর রাতে ৬০০-৭০০ পাকিস্তানি সেনাসদস্য অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নওগাঁ গ্রামের শাহ শরিফ জিন্দানী (রহ.) মাজার এলাকায় অবস্থান নেয়। সে সময় উল্লাপাড়া উপজেলার ফলিয়া গ্রামের হাজী মো. আব্দুস সাত্তার মাজার মসজিদে তাহাজ্জুতের নামাজ পড়ছিলেন, তখন পাকিস্তানি বাহিনী আব্দুস সাত্তারকে আটক করে। আটকের পর আব্দুস সাত্তার আটক অবস্থায় লোক মারফত পাকিস্তানি বাহিনীর উপস্থিতির বিষয়টি ‘পলাশডাঙ্গা যুব শিবির’-এর যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ কাম্পে পাঠান। সে সময় আমি নওগাঁ এলাকার রংমহল নামক স্থানে এলএমজি ও চায়নিজ রাইফেল নিয়ে রণ পাহারায় ছিলাম। এর আগে আমাদের যোদ্ধাদের মধ্যে কথা হয়েছিল, যে কোনো একটি চায়নিজ রাইফেলের গুলির আওয়াজ হলেই বুঝব আমরা পাকিস্তানি বাহিনী দ্বারা আক্রান্ত। সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার ও রমজান মাস।

আমরা সেহরি খেয়ে ফজরের নামাজের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, ঠিক ভোর ৪টার দিকে আমরা নওগাঁর মাজার এলাকা থেকে এলএমজির গুলির আওয়াজ শুনতে পাই। এরই মধ্যে আমাদের যোদ্ধারা চায়নিজ রাইফেলের গুলি করে জানান দেন আমরা আক্রান্ত। তখন উভয় পক্ষ তুমুল গোলা বর্ষণ করতে থাকে। আমরা নওগাঁ হাট এলাকা থেকে আর পাকিস্তানি বাহিনী মাজার এলাকা থেকে এলএমজি রাইফেলসহ নানা অস্ত্র ব্যবহার করে আমাদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এভাবে ওই দিন বেলা পৌনে ৩টা পর্যন্ত বিরামহীন যুদ্ধ চলে। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর ১১ সৈনিক ‘পলাশডাঙ্গা যুব শিবির’-এর যোদ্ধাদের গুলিতে নিহত হয়। পাশাপাশি বেলুচ রেজিমেন্টের সৈনিক নিয়াজ শাহ আমাদের যোদ্ধাদের হাতে আটক হয়। পরে নওগাঁর যুদ্ধে আমাদের যোদ্ধাদের নানা কৌশলের যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে ঐতিহাসিক নওগাঁর যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী তেমন সুবিধা করতে না পেরে রায়গঞ্জ হয়ে বগুড়ার শেরপুর এলাকার দিকে চলে যায়। আর আমরা পাকিস্তানি বাহিনীর ফেলে যাওয়া বিপুল অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পাবনার হান্ডিয়াল এলাকার দিকে চলে আসি। নওগাঁর যুদ্ধে ‘পলাশডাঙ্গা যুব শিবির’-এর কোনো যোদ্ধা শহীদ হননি।

এদিকে ঐতিহাসিক নওগাঁর যুদ্ধের পর আমরা ‘পলাশডাঙ্গা যুব শিবির’-এর যোদ্ধারা পাবনার তৎকালীন চাটমোহর থানার হান্ডিয়াল এলাকা ও শীতলাই গ্রামে অবস্থানের কয়েক দিন পর নৌকাযোগে তাড়াশের তালম ও দেশিগ্রাম এলাকায় ফিরে আসি। এ সময় এলাকার লোকজন আমাদের যোদ্ধাদের সাধ্যমতো খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করেন। পাশাপাশি তারা আমাদের সাহস জোগাতে নানা উৎসাহমূলক উপদেশ দিতেন। পরে তাড়াশ এলাকা থেকে ১৬টি ছোট-বড় ঠেলা নৌকায় ঠাসাঠাসি করে প্রায় ৫৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা কুড়িগ্রামের রৌমারী এলাকার উদ্দেশে যমুনা নদী ধরে রওনা হই। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল– সেখানে আরও মুক্তিকামী মানুষকে প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং যুদ্ধে অংশ নেওয়া। সেই সঙ্গে আমাদের ‘পলাশডাঙ্গা যুব শিবির’-এর নেতারা কলকাতা গিয়ে আরও অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করবেন। অবশ্য নৌকাযোগে কুড়িগ্রামের রৌমারী যাওয়ার পথে সিরাজগঞ্জের কাজীপুর এলাকার চেংগানীর চরে আমাদের নৌবহর পাকিস্তানি বাহিনীর বিমান হামলার কবলে পড়ে।

আমাদের নৌবহরের কোনো ক্ষতি না হলেও, পাশে চলাচল করা তিনটি পাটবোঝাই বড় বজরা নৌকায় বিমান থেকে গোলা বর্ষণে আগুন লেগে ভস্মীভূত হয়। এভাবে জীবন বাজি রেখে এক দিন এক রাত পর আমরা নৌকাসহ রৌমারী এলাকায় পৌঁছাই। সেখান থেকে ‘পলাশডাঙ্গা যুব শিবির’-এর নেতারা অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করতে কলকাতা চলে যান। আর আমরা প্রশিক্ষণ কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি ও পাকিস্তানি বাহিনীর গতিবিধি লক্ষ রাখি। এভাবে চলে কয়েক দিন। পরে তারা ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর কলকাতা থেকে রৌমারী ফিরে আসেন। পরদিন ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। তখন দেশের আপামর জনতা এবং মুক্তিযোদ্ধারা বিজয়োল্লাসে মেতে ওঠেন। ‘পলাশডাঙ্গা যুব শিবির’-এর সিরাজগঞ্জ, পাবনা, নাটোর এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধারা ১৮ ডিসেম্বর নিজ এলাকায় ফিরে আসেন। ব্যক্তিজীবনে আমার এক মেয়ে ও এক ছেলে, নাতি-নাতনি আছে। এখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ। তারপরও ১০৩ বছর বয়সেও হাঁটাচলা কিছুটা হলেও করতে পারি। আমার শেষ ইচ্ছা ১৯৭১ সালে এ দেশ স্বাধীন করতে যুদ্ধ করেছিলাম। এ দেশের মাটিতেই যেন আমার শেষ শয্যা হয়। যেন যুদ্ধে জয় করা দেশ মাতৃকার মাটিতেই অনন্তকাল ঘুমিয়ে থাকতে পারি। 

অনুলিখন
আতিকুল ইসলাম বুলবুল

তাড়াশ (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি

আরও পড়ুন

×