ঢাকা বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫

বিজয়ের হাসি নিয়ে বাড়ি ফিরি

বিজয়ের হাসি নিয়ে বাড়ি ফিরি

গোলাম হোসেন চৌধুরী

গোলাম হোসেন চৌধুরী

প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:০৫ | আপডেট: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১৫:১৪

কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার বাতিসা ইউনিয়নের বসন্তপুর গ্রামে আমার জন্ম। এলাকার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করার পর আর্থিক সংকটে লেখাপড়া এগিয়ে নিতে পারিনি। বাবা মোশাররফ হোসেন চৌধুরী এলাকায় টেইলারিং কাজ করে সংসার চালাতেন। ছয় ভাই ও দুই বোনের মধ্যে বড় ভাই অহিদুর রহমান তখন চট্টগ্রামে আমিন জুট মিলে চাকরি করতেন।

১৯৭১ সালে মার্চ মাসের শেষদিকে এলাকার তরুণ-যুবক-বৃদ্ধ সবাই বাজারের দোকানে রেডিওতে বিবিসির খবর শুনতে ভিড় করতাম। যুদ্ধ আসন্ন, এমন কথা এলাকার বড়দের মুখে মুখে শুনছিলাম। আমার বয়স তখন ১৪ কি ১৫। মুক্তিযুদ্ধ কী, কোথায় করতে হবে, কোথায় প্রশিক্ষণ নেব– এমন ধারণা ধীরে ধীরে বড়দের কাছ থেকে পাচ্ছিলাম। এলাকায় আতঙ্ক বিরাজ করছিল। বাড়িতে গিয়ে ‘মুক্তিযুদ্ধে যাব’– এমন কথা উচ্চারণ করার শুরুতেই বাবা-মা প্রথমে আপত্তি জানান। পরে মুক্তিযুদ্ধের জন্য ট্রেনিংয়ে ভারতে যাওয়ার জন্য এলাকার স্টুডেন্ট গ্রুপ একত্রিত হওয়ায় মা-বাবাকে রাজি করাতে পারি। চৌদ্দগ্রামের আনসার কমান্ডার মফিজুর রহমান এলাকার বিভিন্ন বয়সের লোকদের নিয়ে কয়েকটি গ্রুপ তৈরি করেন ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য। 

দেশের জন্য যুদ্ধ করব, প্রশিক্ষণ নেব– এ নিয়ে কখনও আনন্দ, কখনও আবার টেনশন ছিল মনে। গ্রামের যারা যুদ্ধে যেতে নিষেধ করতেন, তারাও বিভিন্নভাবে ভয় দেখান। কিন্তু আমরা তাতে পাত্তা না দিয়ে ভারতে যাওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করি। ঘরে থাকা কিছু জামাকাপড় ব্যাগে নিয়ে যাত্রার প্রস্তুতির সময় মা-বাবা থেকে যেদিন বিদায় নিতে যাই, সেদিন মায়ের চোখে পানি দেখতে পাই। মাকে বুকে জড়িয়ে বলি, দোয়া করো মা– আমি ইনশাল্লাহ ফিরে আসব। 

আমাদের পুরো দলটি চৌদ্দগ্রামের পূর্বদিক দিয়ে সীমান্ত পার হয়ে ১ এপ্রিল ভারতের কাঁঠালিয়া এলাকায় পৌঁছাই। আমাদের সঙ্গে অন্যতম ছিলেন সফিউল আহমেদ বাবুল ভাই; যিনি তখন আমাদের সাহস জোগাতেন। কাঁঠালিয়ায় গিয়ে দেখি সেখানে আগে থেকেই থাকার জন্য বাঙ্কার তৈরি করা আছে। ভারতের বিএসএফ এ বিষয়ে সব সময় সহায়তা করত। ট্রেনিংও দিত। বাঙ্কারে প্রতিটি গ্রুপের সঙ্গে বিডিআর থাকত। সাহস ও সহায়তা করত। নিজেরা রান্না করতাম। রাতে ভয়ে ঘুম আসত না। একটি গ্রুপ ঘুমাতে গেলে অপর একটি গ্রুপ পাহারা দিত। সেখানে ১৫-২০ দিন থাকার পর ভারতের মতিনগরে গিয়ে ২ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফের নির্দেশনায় আমরা আবার ট্রেনিং গ্রহণ করি। সেখান থেকে বুড়িচং ব্রাহ্মণপাড়া সীমান্তবর্তী রাজাপুর চড়ানলসহ বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। বর্তমানে সদর দক্ষিণ উপজেলার ধনপুর এলাকায় সংঘটিত যুদ্ধে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। একবার গৌরীপুর-হোমনা সড়কের ব্রিজ ভেঙে ফেলতে গিয়েও সফল হতে পারিনি। আমরা কয়েকজন পাটের জমিতে বসে ভাত খেতে গিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর সামনে পড়লে ফায়ার হয়। তবে ভাগ্যক্রমে বেঁচে আসি। 

২ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ ও ক্যাপ্টেন রেজাউল আহম্মেদের (রেজা ভাই) নেতৃত্বে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, মুজাহিদ, ছাত্র, আনসার ও কুমিল্লা জেলার মুক্তিযোদ্ধারা মিলে তৈরি করি এক বিরাট প্রতিরক্ষা বলয়। কিন্তু ৩১ পাঞ্জাব এবং ৩৯ বেলুচ রেজিমেন্ট মিলে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে এত সুপরিকল্পিতভাবে আমাদের আক্রমণ করবে প্রতিরক্ষা বলয় ভাঙার জন্য, তা আমাদের কল্পনার বাইরে ছিল। কিন্তু আমরাই সফল হতে পারি। 

তবে বিজয় না আসা পর্যন্ত যত সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি না কেন, কুমিল্লা সদর উপজেলার জগন্নাথপুর ইউনিয়নের কটকবাজার সীমান্তের যুদ্ধ ছিল বেশি স্মরণীয়। ১৯৭১ সালের ৯ মে, ২ নম্বর সেক্টরের অধীন ক্যাপ্টেন রেজাউল আহমেদের নেতৃত্বে কটকবাজারে এক সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এ দিন পাঁচ-ছয় ঘণ্টা থেমে থেমে যুদ্ধ হচ্ছিল। সেখানে কমান্ডার বাবুল ভাই, ভিপি শাহ আলম ভাই, কমান্ডার সিরাজ ভাই, সুবেদার মান্নান মিলে আমরা অসীম সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করি শত্রুর বিরুদ্ধে। কিন্তু এক পর্যায়ে আমাদের গোলাগুলি শেষ হয়ে গেলে পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হই। অবশ্য এর মধ্যে মতিনগর থেকে ক্যাপ্টেন দিদারুল আলম আর নির্ভয়পুর থেকে ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমান তাদের বাহিনী নিয়ে এগিয়ে এলে আমরা আবার কাউন্টার অ্যাটাকে যাই। কিন্তু ঘণ্টাখানেক যুদ্ধ করার পর সুবিধা করতে না পেরে পুরোপুরি পশ্চাদপসরণ করে ভারতের ধনবাড়ী ক্যাম্পে চলে যায় আমাদের একটা বড় গ্রুপ। এ যুদ্ধে শত্রু বাহিনীর ১০০ থেকে ১৫০ জন নিহত হয়।

আর মুক্তিবাহিনীর হাবিলদার জুম্মা খান, ল্যান্স নায়েক আব্দুল কাদের মোল্লা, ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র ইমতিয়াজ উদ্দিনসহ সাতজন শহীদ হন। যুদ্ধের পর তিনজন বীর শহীদের লাশ শনাক্ত করা গেলেও বাকি চারজন শহীদের মরদেহ পাওয়া যায়নি। এ দিন আমি মনে করেছিলাম হয়তো আর মায়ের বুকে ফেরা হবে না। চোখের সামনে অনেক রক্তাক্ত লাশ দেখে ভয় পেয়ে গেলেও একটা সময় মনে হতে থাকে, আর পেছানোর সময় নেই। সঙ্গে থাকা বড় ভাইদের অনেককে ক্লান্ত দেখালেও মনোবল দেখিয়ে তারা বললেন, তোমরা তরুণরা ভয় পেলে চলবে না। সেই অনুপ্রেরণার কারণে আমরা হয়তো সফল হতে পারি। ২০২০ সালের ১৭ ডিসেম্বর সেই আলোচিত যুদ্ধক্ষেত্র কটকবাজারে শহীদদের স্মরণে জেলা প্রশাসন ও মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্যোগে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। 

পরবর্তী সময়ে ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর যৌথ বাহিনী (মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী) সম্মিলিতভাবে পরিকল্পনা অনুযায়ী ঝাঁপিয়ে পড়ে দেশব্যাপী চারদিক থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ওপর। স্থল, নৌ, বিমান ও গেরিলা আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী দিশেহারা হয়ে পশ্চাদপসরণ করতে থাকে। আর আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত বিজয়ের দিকে এগিয়ে যেতে থাকি। ৬ ডিসেম্বর আমাদের ২০০ জনের মুক্তিযোদ্ধার দল তিন ভাগ হয়ে এক ভাগ ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে চলে যায় ভারতীয় গুর্খা ব্যাটালিয়নের সঙ্গে চৌদ্দগ্রাম, মিয়ার বাজার, সুয়াগাজী হয়ে লাকসামের দিকে শত্রুমুক্ত করতে। আর আমাদের গ্রুপটি ৭ ডিসেম্বর শেষ রাতে ভারতের সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন শর্মার বাহিনীর সঙ্গে নির্ভরপুর থেকে সোনামুড়া হয়ে রওনা হলো কুমিল্লা শহরের উদ্দেশে। নিশ্চিত পরাজয় জেনে নভেম্বরের শেষদিকে কুমিল্লার বিভিন্ন এলাকা থেকে বাড়িঘরে আগুন দেওয়ার খবর আসত লোকজনের মাধ্যমে। চৌদ্দগ্রামে আমাদের এলাকার অনেক ঘরবাড়ি পুড়িয়ে ফেলা হয়। ৮ ডিসেম্বর কুমিল্লা হানাদারমুক্ত হয়। এদিন সহযোদ্ধাদের অনেকেই কুমিল্লা শহরগামী হয়। কিন্তু আমরা চৌদ্দগ্রামের অনেকেই শহরে না এসে কখন মায়ের কাছে ফিরব, এমন চিন্তায় অস্থির লাগছিল। বিজয়ের হাসি নিয়ে যখন বাড়ি ফিরি, তখন বাবা-মা আমাকে কাছে পেয়ে বুকে টেনে নেন। এলাকার বিভিন্ন লোকজনও বাড়িতে ছুটে আসেন। 

অনুলিখন
মো. কামাল উদ্দিন
কুমিল্লা জেলা প্রতিনিধি

আরও পড়ুন

×