সরেজমিন
'আবার ফিরল সেই পুরোনো রোগ'

আজু শিকদার, গোয়ালন্দ (রাজবাড়ী)
প্রকাশ: ২১ জুলাই ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ২১ জুলাই ২০২২ | ১৩:৫৫
'একটা সময় বিদ্যুৎ মাঝেমধ্যে আসত, তখন নিজেরা সতর্ক থাকতাম। যতটুকু সময় বিদ্যুৎ থাকত, প্রয়োজনীয় কাজ সেরে নিতাম। অনেক দিন হলো বিদ্যুতের সেই আসা-যাওয়া ছিল না। জীবনযাত্রায়ও ফিরেছিল ছন্দ। কয়েক দিন ধরে বিদ্যুতের সেই পুরোনো রোগ আবার ফিরেছে।' গত বুধবার বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে কথাগুলো বলছিলেন রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ শহরের কলেজপাড়ার গৃহবধূ সামিয়া ফারহানা। তিনি বলেন, 'সংসারের নানা কাজ শেষে যখন গোসল করতে গেলাম, তখন দেখি ট্যাঙ্কের পানি শেষ; এদিকে বিদ্যুৎও নেই। ধোয়ার জন্য বেশ কিছু কাপড় ভিজিয়েও রেখেছিলাম। বিদ্যুৎ না আসা পর্যন্ত সেগুলো ধোয়া বা নিজের গোসল- কোনোটাই করা গেল না। এমন হলে তো অসুস্থ হয়ে পড়ব।'
গৃহবধূ সামিয়ার মতো অনেকের ঘরেই একই হাল। তীব্র তাপদাহে টানা কয়েক দিনের অসহ্য গরমের মধ্যে হঠাৎ বৃষ্টি নামলেও ভ্যাপসা গরমে স্বস্তি ফিরছে না কারও। আর সেই অস্বস্তি কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে লোডশেডিং। কয়েক দিন ধরে লোডশেডিংয়ের যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা সাম্প্র্রতিককালে দেখা যায়নি। লোডশেডিং শুধু জীবনযাত্রাতে প্রভাব ফেলেনি, লাটে উঠছে এই অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য। পোলট্রি জোন হিসেবে পরিচিত রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ। মুরগির বাচ্চা উৎপাদনের জন্য গোয়ালন্দে রয়েছে অর্ধশত হ্যাচারি। একদিকে পোলট্রি ফিডের দাম চড়া, তার ওপর মুরগির বাচ্চার দামও কম- এসব কারণে পোলট্রি হ্যাচারি চলছে অনেকটা খুঁড়িয়ে। এর মধ্যে লোডশেডিং নতুন করে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে ব্যবসায়ীদের।
এ ব্যাপারে গোয়ালন্দ হ্যাচারিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু সায়েম খান জানান, প্রতি মাসে তিনি সাড়ে ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করেন। বিদ্যুৎ যদি না থাকে, তাহলে জেনারেটরের মাধ্যমে আলো জ্বালাতে গিয়ে তাঁর কোম্পানিকে গুনতে হয় অন্তত ২৫ লাখ টাকা। প্রতি এক ঘণ্টা লোডশেডিং থাকলে অতিরিক্ত খরচ হয় দুই হাজার টাকা। এমনিতেই নানা প্রতিকূলতার কারণে পোলট্রি শিল্প খাদের কিনারায়। এ পরিস্থিতিতে বাচ্চা উৎপাদনে আরও বেশি খরচ হলে এ শিল্প আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না।
তিনি বলেন, 'আমার কাছে মনে হয়, বর্তমান যে সংকট, তা লোডশেডিং দিয়ে মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না। কারণ, আমার প্রতিষ্ঠান ১ মিনিটের জন্য বিদ্যুৎহীন রাখা সম্ভব নয়। ১ মিনিট বিদ্যুৎ বন্ধ থাকলে মেশিনে থাকা লাখ লাখ বাচ্চা মারা যাবে। ফলে আমাকে জেনারেটরে জ্বালানি খরচ করে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হয়। এ জন্য আমাকে জ্বালানি তেল কিনতেই হচ্ছে।'
গোয়ালন্দের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা প্রণব ঘোষ জানান, তাঁর এলাকায় দিনে ৫-৬ বার লোডশেডিং হচ্ছে। প্রতিবার এক থেকে দেড় ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। তিনি বলেন, 'এক যুগ আগে দিনে ১০ থেকে ১৫ ঘণ্টা লোডশেডিং দেখেছি। তবে এরপর ধীরে ধীরে লোডশেডিং বিদায় নিয়েছিল। কয়েক দিন ধরে যা হচ্ছে, তা গত সাত-আট বছরে দেখা যায়নি। তবে সরকার যেহেতু ঘোষণা করে লোডশেডিং দিচ্ছে, এটা কার্যকর হলে সবাই লোডশেডিংয়ের জন্য প্রস্তুত থাকতে পারবে। এতে ভোগান্তি অনেকাংশে কমবে।'
সরকারি গোয়ালন্দ কামরুল ইসলাম কলেজের প্রভাষক মো. জাকির হোসেন বলেন, 'বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার যথাযথ সিদ্ধান্তই নিয়েছে। জ্বালানি তেল-গ্যাসের ওপর চাপ কমাতে আমাদের বিদ্যুৎ ব্যবহারে আরও মিতব্যয়ী হতে হবে।'
গোয়ালন্দ বাজারের ইলেকট্রনিকস সামগ্রী বিক্রেতা শহিদুল ইসলাম জানান, বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের ঘোষণায় আগের চেয়ে চার্জার লাইট, ফ্যানের বিক্রি বেড়েছে।
ওয়েস্টার্ন জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের গোয়ালন্দ কার্যালয়ের আবাসিক প্রকৌশলী (আরই) শাহ নেওয়াজ শাহিন বলেন, 'দিনক্ষণ নির্দিষ্ট করে লোডশেডিং করা অনেকটা অসম্ভব। কারণ, সরবরাহের চেয়ে চাহিদা বেশি থাকলে বাধ্য হয়ে বেশি লোডশেডিং দেওয়া হয়। আর কখন এ রকম পরিস্থিতি হবে, তা আগে থেকে জানা যায় না।' গত ১৯ জুলাই ৬ ঘণ্টা লোডশেডিংসহ তার আগের দিনগুলোতে এত বেশি লোডশেডিং প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'তখন ফরিদপুরের মূল গ্রিড থেকে সরবরাহ কম ছিল। আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে যতদূর সম্ভব সরবরাহ বাড়ানোর চেষ্টা করছি।'
- বিষয় :
- সরেজমিন