ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

সমাজ বদলের একজন এমদাদুল

সমাজ বদলের একজন এমদাদুল

ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর শহরের বাসিন্দা এমদাদুল হক, কিন্তু সততায় সারাদেশের দৃষ্টান্ত। ছবি: সমকাল

আবদুন নূর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

প্রকাশ: ০১ ডিসেম্বর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০২২ | ০১:১৪

কয়েক মাস আগেও তেমন পরিচিত ছিলেন না তিনি। অথচ একটি ঘটনায় সারাদেশে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছেন। এখন এলাকার মানুষ অন্য রকম শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখেন; বেশ সম্মানও করেন। তাঁর নাম এমদাদুল হক। তিনি দুদকের সাবেক কর্মচারী এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর শহরের বাসিন্দা।

সম্প্রতি তাঁর খোঁজ নিতে পৌর শহরের দক্ষিণ মৌড়াইল এলাকায় যান এ প্রতিবেদক। এমদাদুল হকের কথা জানতে চাইলে অনেকেই জানান, তাঁরা ঘটনাটি শুনেছেন। এর পর থেকে তাঁকে অন্যভাবে সম্মান করেন।

দিনটি ছিল ২০২২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। দুপুর সাড়ে ১২টা। লম্বা দাড়িওয়ালা, টুপি পরিহিত এক ব্যক্তি এলেন রেলস্টেশনে। স্টেশনের বুকিং ক্লার্কের মাধ্যমে ১৫টি আসনবিহীন টিকিট কিনলেন। ভাড়া হিসেবে পরিশোধ করলেন ২ হাজার ৫৩০ টাকা। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই সবার সামনে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে সব কয়টি টিকিট ছিঁড়ে ফেলে দিলেন। এমন 'কাণ্ড' দেখে সবাই বিস্মিত। যিনি এ ঘটনার নায়ক, তিনিই এমদাদুল হক। বয়স ৬৫। ২০২১ সালে দুদকের চাকরি থেকে অবসরে যান তিনি। কনস্টেবল পদে ১৯৮১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত চাকরি করেন।

আত্মপ্রচার নয়, আত্মোপলব্ধি থেকেই কাজটি করেছেন বলে জানিয়েছেন এমদাদুল হক। টিকিট ছাড়া ট্রেন ভ্রমণের সব হিসাব রেখেছিলেন। শুধু ভ্রমণই নয়; কোথা থেকে কোন দিন কোন ট্রেনে গিয়েছেন, তাও হিসাব করে রেখেছিলেন। এবার রেলওয়ের সেই পাওনা পরিশোধ করে নির্ভার হলেন। সততার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে বিনা টিকিটে ভ্রমণকারীদের অন্তর্চোখও যেন খুলে দিলেন।

জেলার নবীনগর উপজেলার কনিকাড়া গ্রামের শামসুল হকের ছেলে এমদাদুল হক। কনস্টেবল হিসেবে কর্মরত ছিলেন দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে তিনি অবসরে যান। তাঁর দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। পরিবার নিয়ে বসবাস করেছেন জেলা শহরের দক্ষিণ মৌড়াইলে।

অবসরের পর তাঁর মধ্যে পরকালের চিন্তা আসে। বিনা টিকিটে ট্রেন ভ্রমণের অনুশোচনায় ভুগছিলেন। বিষয়টি নিয়ে তাঁর সহধর্মিণীর সঙ্গে প্রথম পরামর্শ করেন। সহধর্মিণী প্রস্তাবে সায় দেন। পরে চার ছেলেমেয়ের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন। তাঁরাও বাবার সঙ্গে সহমত পোষণ করে তাঁকে উৎসাহিত করেন।

এমদাদুল হক বলেন, 'রেল টিকিটের টাকা রাষ্ট্রীয় সম্পদ। এ টাকা জনগণের। কারও কাছে ব্যক্তিগত দেনা-পাওনা থাকলে মাফ-মুক্তি নেওয়া যায়। আমার এ কাজের জন্য দেশের ১৮ কোটি মানুষের কাছ থেকে মাফ নিতে পারব না। এই ভেবে টিকিট কেটে রেলের টাকা পরিশোধের চেষ্টা করেছি। বিষয়টি নানা মহলে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। কেউ কেউ ব্যক্তিগত সাক্ষাতে আবার কেউ ফোনে অভিনন্দন জানিয়েছেন।'

আড়াই হাজার টাকা কীভাবে নির্ধারণ করলেন- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বিনা টিকিটে ভ্রমণের টাকার অঙ্কে দুই হাজারের বেশি হওয়ার কথা নয়। তাই আমি আরও ৫০০ টাকা বেশি অর্থাৎ আড়াই হাজার টাকার আসনবিহীন টিকিট কেটেছি।' তিনি আরও বলেন, রেল জাতীয় সম্পদ। দেশের নাগরিক হিসেবে প্রত্যেকের উচিত টিকিট কেটে ট্রেনে ভ্রমণ করা।

এভাবে টাকা পরিশোধের কথা শুনে একাধিক ব্যক্তি অনুরূপভাবে টাকা পরিশোধ করেছেন। এর মধ্যে জেলার নবীনগর উপজেলার মেরকুটা গ্রামের মাওলানা আবুল হাসেম নামের এক ব্যক্তি এক হাজার, নাটোরের এক ব্যক্তিও এভাবে টাকা পরিশোধ করেন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ বিভূতিভূষণ দেবনাথ বলেন, বিষয়টি সমাজ ও তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

দুর্নীতিবিরোধী সংগঠন সচেতন নাগরিক কমিটির জেলা সভাপতি প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বলেন, এটি নিঃসন্দেহে বিরল এবং অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। প্রশংসনীয়ও।

আরও পড়ুন

×