সুদখোরদের খপ্পরে সর্বস্বান্ত, মুক্তি খোঁজে আত্মহত্যায়

পঙ্কজ দে, সুনামগঞ্জ
প্রকাশ: ০৬ জুলাই ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ০৭ জুলাই ২০২৩ | ০৬:৫২
জেলার বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সুদখোররা অপেক্ষাকৃত নিরীহ ও সম্ভ্রান্ত বংশীয় মানুষদের টার্গেট করেই সুদের জাল তৈরি করে। কৃষক, জলমহাল ব্যবসায়ী, মাছের ব্যবসায়ী, বিদেশে যেতে ইচ্ছুক যুবক, সাধারণ ঠিকাদার, বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ী, সরকারি চাকরিজীবী ও প্রবাসীদের কাছ থেকে ব্যাংক চেক এবং সাদা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নিয়ে টাকা দেয় তারা। সুদের এই মহাজনদের দালাল আছে জেলা শহর থেকে প্রতিটি মহল্লা পর্যায়ে। এরা সুদখোর মহাজনদের হয়ে সুদে ঋণ দেওয়ার জন্য এলাকায় এলাকায় কাজ করে। বিনিময়ে তারা কিছু কমিশন পায়।
জেলার অনেক এলাকায় এমনও উদাহরণ আছে, ৫ লাখ টাকা সুদে ধার দিয়ে ২৮ লাখ, ৩০ লাখ টাকার পাওনা দাবি করে আদালতে চেক ডিজঅনার মামলা দায়ের করে টাকা আদায় করেছে।
সুদখোরদের মানসিক অত্যাচারের শিকার হয়ে গত ৩ জুন আত্মহত্যা করেন দিরাই উপজেলার রাজানগর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সৌম্য চৌধুরী। মৃত্যুর একদিন আগে সৌম্য চৌধুরী তার ফেসবুক আইডিতে স্ট্যাটাস দেন– ‘আমার এমন পরিণতির জন্য দায়ী দিরাইয়ের হবিবুর (হাবিবুর) রহমান এবং জসিম উদ্দিন। হবিবুরের কাছ থেকে আমি টাকা এনেছিলাম। তা শোধ করেছি দিরাই পৌরসভার সাবেক মেয়র মোশারফ মিয়াকে সঙ্গে নিয়ে। এর পর আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি, সুস্থ হয়ে জানতে পারি, ওদের টাকার জন্য আমার ওপর মামলা হয়ে গেছে। ওদের টাকার জন্য আমি পথে বসেছি। হবিবুর একজন নিচু সুদখোর। সুদের টাকায় দিরাইয়ে তিনটি বাড়ি করেছে সে।’ এ ছাড়া এলাকার কয়েকজন চিহ্নিত সুদখোরের নাম উল্লেখ করে তাদের বিপুল টাকার উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন রাখেন তিনি। লিখেছেন, ওরা সুদের ব্যবসা করে। মানুষ বিপদে পড়লে শতকরা ১০ টাকা হারে সুদে টাকা লাগায়। সুদখোরদের বিচার দাবি করেন তিনি।
এই ঘটনার পর সৌম্য চৌধুরীর স্ত্রী ইলা চৌধুরী বাদী হয়ে গত ১৭ জুলাই দিরাই পৌর এলাকার ধল পয়েন্টের বাসিন্দা হাবিবুর রহমান হবু, জসিম উদ্দিন এবং রাজনাগরের সুজন দাস, পুতুল দাস এবং অমিত দেবনাথের ওপর আত্মহত্যার প্ররোচনার মামলা দায়ের করেন। এই মামলার আসামি হাবিবুর রহমান হবু ও জসিম উদ্দিন উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে বীরদর্পে ঘুরছেন। অন্য তিন আসামি এখনও পলাতক রয়েছেন।
এর আগে গত ১৮ আগস্ট নিজের ফেসবুক আইডিতে স্ট্যাটাস দিয়ে আত্মহত্যা করেন ফয়সাল আহমদ সৌরভ (৩০) নামের এক যুবক। তিনি তাহিরপুরের পাতারি গ্রামের আজিজুর রহমানের ছেলে। মৃত্যুর আগে ফেসবুক স্ট্যাটাসে তিনি লিখেন, ‘আমি গলায় দড়ি দিলাম তুই রফিকের লাগি, তুই আমারে কাবু করি লাশ বানাইলি, সফিকের কাছ থেকে এক লক্ষ টাকা আনছিলাম সুদে, তিন লক্ষ টাকা সুদ দিয়ে সাড়ে তিন লক্ষ টাকা এখনও পায়, এই রফিক আর সফিকের লাগি আত্মহত্যা করলাম।’
এই ঘটনার পরও আত্মহত্যার প্ররোচনায় মামলা হয়। এই মামলার আসামিরাও জামিনে রয়েছে।
সুদখোরদের জাল বিস্তৃত জেলার গ্রামে-গঞ্জেও । পাঁচ মাস আগেও তাহিরপুরের টেকাটুকিয়া গ্রামের ধীরাজ রায় চৌধুরীর সঙ্গে সূর্যেরগাঁওয়ের নুরুল ইসলামের সুদের টাকা নিয়ে দ্বন্দ্বের জের ধরে এলাকায় সালিশ বসে। তাহিরপুর প্রেস ক্লাবের সভাপতি আমিনুল ইসলাম জানান, ওই সালিশে ধীরাজ সালিশকারীদের জানান, তিনি দুই লাখ টাকা নিয়ে ৫ লাখ টাকা দেওয়ার পরও নুরুল ইসলামের কাছে তাঁর স্বাক্ষরিত ব্যাংক চেক থাকায় ৭ লাখ টাকা পাওনার মামলা করেছেন। জবাবে নুরুল ইসলাম সালিশকারীদের কাছে দাবি করেন, তিনি শুধু সুদের টাকা পেয়েছেন। শেষ পর্যন্ত তার সুদে-আসলে ৭ লাখ হয়েছে, সেই টাকা ধীরাজকে দিতে হবে। বিষয়টি পরে সালিশে সমাধান হয়নি।
দিরাই থানার ওসি মুক্তাদীর আহমদ বললেন, দিরাইয়ে বিট পুলিশের মাধ্যমে সুদের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা তৈরির চেষ্টা করছেন তারা। মসজিদের ইমাম ও মন্দিরের পুরোহিত সুদের কুফল নিয়ে আলোচনা করেছেন।
সুনামগঞ্জ সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সভাপতি আইনুল ইসলাম বাবলু বললেন, আদালতে এখন চেক ডিজঅনার মামলা বেড়েছে। সুদখোররা ব্যাংক চেকে বেশি টাকা লিখে রেখে এসব মামলা করছে। এ বিষয়ে সচেতনতা প্রয়োজন।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী বলেন, জেলায় যোগদান করার পর থেকেই অপ্রাতিষ্ঠানিক সুদের ব্যবসা নিয়ে কথা শুনে আসছেন তিনি। হঠাৎ এক ব্যক্তি কীভাবে প্রকাশ্য কোনো ব্যবসা ছাড়াই অথবা আয়কর দেওয়া ছাড়াই অন্যকে এত টাকা ঋণ দেয়? তারা টাকা পায় কোথায়? পরে আবার আদালতে মামলাও করে, এ বিষয়গুলো আইনানুগ প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট বিভাগকে খতিয়ে দেখতে চিঠি দেওয়ার চিন্তা করছেন তিনি।
- বিষয় :
- সুদখোর
- দাদন ব্যবসায়ী
- কৃষক
- ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী
- আত্মহত্যা