স্বজনের মাঝে ২৩ নাবিক
‘মনে হচ্ছে, এখনও কেউ তাক করে আছে অস্ত্র’

সোমালিয়ার জলদস্যুদের জিম্মিদশা থেকে ৬২ দিন পর মায়ের বুকে ফিরেছেন নাড়ি ছেঁড়া ধন। প্রিয়জনকে কাছে পেয়ে মুক্তির আনন্দে কাঁদছেন এক নাবিক। মঙ্গলবার বিকেলে চট্টগ্রাম বন্দরে স্বজনের সঙ্গে এমন মহামিলন ঘটে ২৩ নাবিকের - মো. রাশেদ
চট্টগ্রাম ব্যুরো
প্রকাশ: ১৫ মে ২০২৪ | ০৫:২৩
জান্নাতুল ফেরদৌসের দুই হাতে মেহেদির নকশা কবজি পর্যন্ত। পরেছেন নতুন জামা। চুলের খোঁপায় ফুল। চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি জেটিতে তিনি এসেছেন ঈদের সাজে। স্বামী নুরউদ্দিনকে বরণ করতে এমন সেজেছেন জান্নাতুল। নুরউদ্দিন সেই ২৩ নাবিকের একজন; যারা জিম্মিদশা থেকে মুক্ত হওয়ার পর গতকাল প্রথম দেখা পেয়েছেন স্বজনের।
বিকেল ৪টা ২০ মিনিটে জাহাজ থেকে নামলেন নুরউদ্দিন। জড়িয়ে ধরলেন স্ত্রীকে। বুকে নিলেন তাঁর আড়াই বছর বয়সী সন্তান আইমানকেও। কিন্তু কোনো কথা বলতে পারছিলেন না তিনি। শুধু কাঁদছেন হু হু করে।
কেমন লাগছে– এ প্রশ্ন করতেই নুরউদ্দিন বললেন, ‘কেমন লাগছে বোঝাতে পারব না। মনে হচ্ছে, নতুন জন্ম হয়েছে। পরিবারের সবাইকে দেখে খুব খুশি লাগছে। কিন্তু হাসতে পারছি না। বারবার সেই দিনগুলোর কথা মনে আসছে। মনে হচ্ছে, মাথার ওপর এখনও কেউ তাক করে আছে অস্ত্র। স্বাভাবিক হতে পারছি না একদমই।’
জান্নাতুল ফেরদৌস বললেন, ‘মানসিকভাবে খুব বিপর্যস্ত হয়ে গেছে আমার স্বামী। দুবাই গিয়ে বিমানে করে দেশে ফিরে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু শরীর কিছুটা ভালো হওয়ায় জাহাজে করে ফিরেছে।’
জান্নাতুলের কথা শেষ না হতেই আবার কাঁদতে শুরু করেন নুরউদ্দিন। শুধু নুরউদ্দিন নন; জিম্মিদশার ৩২ দিনের কথা ভুলতে পারছেন না ২৩ নাবিকের কেউই।
এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের ক্যাপ্টেন আব্দুর রশিদ বললেন, ‘শারীরিকভাবে আমরা সবাই সুস্থ আছি। কিন্তু মনের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে বিরাট এক ঝড়। বেশ কিছুদিন বিশ্রামে থাকব। চেষ্টা করব দুঃসহ সেই স্মৃতি ভুলে নতুন করে শুরু করার।’
বন্দরের এনসিটি জেটিতে ক্যাপ্টেন আব্দুর রশিদ যখন এসব কথা বলছিলেন, তখন তাঁর পাশেই ছিলেন জাহাজের প্রধান কর্মকর্তা আতিকুল্লাহ খান। তাঁকে বরণ করতে একই রঙের পোশাক পরে এসেছে তাঁর দুই মেয়ে ইয়াশা ফাতিমা ও উমাইজা মাহাবিন। এখানে এসেছো কেন– জিজ্ঞেস করতেই ছোট্ট উমাইজা বলল, ‘আমাদের আব্বু এসেছে আজ।’ ফাতিমা বলল, ‘আজ অনেক মজা করব। আব্বুর সাথে গল্প করব।’
ফাতিমা ও উমাইজার কথা শেষ না হতেই দুই মেয়েকে বুকে টেনে নিলেন আতিকুল্লাহ খান। দুই মেয়ের মুখে দুটি চুমো দিয়ে ছাড়লেন এক দীর্ঘশ্বাস। বললেন, ‘আহা! কী এক সময় গেছে আমাদের! খাবারের ঠিক নেই, গোসলের ঠিক নেই, খাওয়ার মতো পর্যাপ্ত পানি নেই। মনে হলে গা-শিউরে ওঠে এখনও। একে৪৭, এসএমজির মতো ভারী অস্ত্র নিয়ে ঘুরঘুর করত জলদস্যুরা। এখনও যেন চোখে ভাসছে সব।’
দুপুর থেকেই অপেক্ষায় ছিলেন স্বজন
জ্যোৎস্না বেগম। বয়স ৬০ ছুঁই ছুঁই। শরীরে বাসা বেঁধেছে নানা রোগ। ফুলের তোড়া নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এনসিটি জেটিতে। দুপুরে রোদের জন্য তাকানো যাচ্ছিল না কর্ণফুলী নদীর দিকে। এক হাত কপালে নিয়ে ছেলে তানভীর আহমেদের জাহাজ খুঁজছেন জ্যোৎস্না বেগম। তানভীর এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের চতুর্থ প্রকৌশলী। তিনি জাহাজ থেকে নেমে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলেন মাকে। ফুল দিয়ে মা জ্যোৎস্না বেগম যখন ছেলেকে বরণ করছিলেন, তখন ছলছল করছিল তানভীরের স্ত্রীর চোখ।
সংবর্ধনার জন্য ছোট্ট একটি ছাউনি তৈরি করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। কিন্তু নাবিকদের চোখ ছিল সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের ৪০ হাত দূরে অবস্থান করা স্বজনের দিকে। এখানেই দেখা হয় নাবিক সাজ্জাদের বাবা গাজু মিয়ার সঙ্গে। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে রেখে তিনি বলেন, ‘আজ যেন ঈদের দিন আমাদের। ছেলেকে এভাবে ফিরে পাব তা একদমই ভাবিনি। বারবার মনে হতো, সে হয়তো সুস্থ ফিরবে না আর।’ পাশে দাঁড়ানো নাবিক আইনুল হকের মা বললেন, ‘গত দুই মাস যে আমাদের কেমন গেছে, তা বলে বোঝাতে পারব না। আজই যেন আমাদের ঈদের দিন।’
নাবিকদের অভিনন্দন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর
এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের নাবিকদের সংবর্ধনা দিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষও। এ সময় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে নাবিকদের অভিনন্দন জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘নাবিকরা সুস্থ দেহে দেশে ফিরেছেন, এটা আমাদের অনেক স্বস্তির খবর। জলদস্যুদের ওপর হামলা চালাতে আন্তর্জাতিক চাপ ছিল। কিন্তু নাবিকদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে সেটি আমরা নাকচ করেছি। আজকের এই আনন্দময় দিন বলছে, আমাদের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল।’
সশরীরে এসে নাবিকদের সাহস দিয়েছেন সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী, বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল ও কেএসআরএম গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার জাহান রাহাত।
- বিষয় :
- এমভি আবদুল্লাহ
- জাহাজ
- নাবিক
- জিম্মি