হালদায় অশনিসংকেত
প্রাণ হারিয়েছে বিপন্ন প্রজাতির ৩৯ ডলফিন

মাছ
সারোয়ার সুমন, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ০৩ জুলাই ২০২৪ | ০১:২২ | আপডেট: ০৩ জুলাই ২০২৪ | ০৯:৪২
হালদা নদী হলেও এটি দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র। এখানে আছে গাঙ্গেয় ডলফিন, রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালিবাউশ জাতীয় মাছ। বছরের একটি নির্ধারিত সময়ে এই নদীতে ডিম ছাড়তে আসে মা মাছ। যে ডিম থেকে ফোটা রেণু দেশের অন্য যে কোনো প্রান্তের মাছের তুলনায় হয় বড় ও সুস্বাদু। দেশে মাছের চাহিদার একটি বড় অংশ পূরণ করা এই নদীও এখন ভালো নেই। গতকাল মঙ্গলবার রাতে হালদায় আরও একটি মা মাছ ও ডলফিন মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। এ নিয়ে গত ১২ দিনে ছয়টি মা মাছ ও দুটি ডলফিনের মৃতদেহ পাওয়া গেল। এর আগে ২০২২ সালের জুলাইয়ে এক সপ্তাহের ব্যবধানে এ নদীতে তিনটি ডলফিনের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল। এ নিয়ে গত সাত বছরে ৪২টি ডলফিন মারা গেল হালদায়। নদীতে এভাবে ডলফিন ও মা মাছের মৃত্যুকে অশনিসংকেত বলছেন গবেষকরা।
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) গাঙ্গেয় ডলফিনকে ‘বিপন্নে’র লাল তালিকায় রেখেছে। ‘জরুরি ভিত্তিতে’ এই প্রাণীকে সংরক্ষণ করতে বলেছেন উচ্চ আদালতও। হালদা নদীর জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে হয়েছে রিসার্চ ল্যাবরেটরি। ডলফিনের মৃত্যুর কারণ বের করতে সাত বিশ্ববিদ্যালয় মিলে গবেষণা করেছে। হয়েছে জরিপও। তবু রক্ষা করা যাচ্ছে না। উল্টো অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় এখন বেশি মরছে ডলফিন ও মা মাছ।
মা মাছ কিংবা ডলফিনের এমন মৃত্যুর মিছিল থামাতে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। মা মাছ ও ডলফিনের মৃতদেহ উদ্ধারের পর কারণ অনুসন্ধানে এবারও দুটি আলাদা কমিটি গঠন করেছে জেলা মৎস্য বিভাগ ও পরিবেশ অধিদপ্তর। তাদের দ্রুত তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
২০২৩ সালের সর্বশেষ জরিপে হালদায় ১৪৭টি ডলফিন আছে বলে ধারণা করা হয়। দুইটা মারা যাওয়ায় এখন আর অবশিষ্ট থাকার কথা ১৪৫টি ডলফিন।
যাচ্ছে একের পর এক মা মাছের প্রাণ গত ৩০ জুন হালদার রাউজান উপজেলা অংশের পশ্চিম গুজরা ইউনিয়নের আজিমের ঘাট এলাকায় একটি মরা কাতলা মাছ ভেসে আসে। কাতলা মাছটির ওজন প্রায় ১৯ কেজি ৩০০ গ্রাম; দৈর্ঘ্য প্রায় ১১৮ সেন্টিমিটার। গত ২৮ জুনও হালদা নদীর হাটহাজারী উপজেলা অংশের উত্তর মাদার্শা ইউনিয়নের কুমারখালী এলাকায় দুটি মৃত কাতলা উদ্ধার করা হয়। মৃত্যুর কারণ জানতে একটি মাছ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে সংরক্ষণের জন্য নেওয়া হয়েছে।
হালদা নদীর গবেষক ও চবির হালদা রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, নদীতে মাত্রাতিরিক্ত ইঞ্জিনচালিত নৌযান, মাছ ধরার জাল ও ড্রেজার থাকলে বিপন্ন হয় ডলফিনের প্রাণ। হালদা নদীতে গত সাড়ে ছয় বছরে যেসব ডলফিন মারা গেছে, তার ৯০ শতাংশেরই শরীরে আঘাতের চিহ্ন ছিল। জালে আটকা পড়া ডলফিন আধাঘণ্টার মধ্যে মুক্ত করা না হলে সেটির মৃত্যু হয়।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, হালদা দূষণের সব উৎস আমরা বন্ধ করে দিয়েছি। ইতোমধ্যে হালদা নদীসংলগ্ন ১৭টি শিল্পকারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ইঞ্জিনচালিত নৌকা চলাচলও সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তবুও কী কারণে হালদায় মা মাছ ও ডলফিনের মৃত্যু হচ্ছে, সেটি শনাক্তের চেষ্টা চলছে।
আইইউসিএনের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ শেখ মোহাম্মদ মেহেদী আহসান বলেন, সারাবিশ্বেই লাল তালিকায় আছে ডলফিন। প্রতিকূল নানা পরিবেশ হুমকিতে ফেলছে ডলফিনের জীবন। হালদা নদীতে ডলফিন ও মা মাছের এত মৃত্যু আমাদের জন্য অশনিসংকেত। বিশ্বের বিভিন্ন নদীতে এই গাঙ্গেয় ডলফিন আছে ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ২০০। সর্বাধিক ডলফিন থাকা হালদাকেই এতদিন সবচেয়ে নিরাপদ আবাসস্থল বলে ধারণা করা হয়েছিল। কিন্তু এ বিশ্বাসও ভেঙে যাচ্ছে।