মুমূর্ষু ‘বুড়ি’র প্রাণ রক্ষায় উদ্যোগ নেই

দখল দূষণে প্রমত্তা বুড়ি নদী অস্তিত্ব হারিয়ে খালে পরিণত হয়েছে। ওসমানীনগরের তাজপুর বাজার সংলগ্ন এলাকা
ওসমানীনগর (সিলেট) প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০১ অক্টোবর ২০২৪ | ২০:০৪
মানুষের সর্বগ্রাসী ক্ষুধার আগ্রাসনে মরতে বসেছে ওসমানীনগরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত বুড়ি নদী। এক সময়ের প্রমত্তা এই নদী এখন অস্তিত্ব হারিয়ে খালে পরিণত হয়েছে। বিলীন হয়ে যাওয়া নদীর অংশে নিজেদের মতো স্থাপনা নির্মাণ করেছেন দখলদাররা। তবে এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের।
বিভিন্ন সময় অস্তিত্বহীন বুড়ি নদীর জায়গা উদ্ধারের দাবি উঠলেও কার্যত কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এতে করে মরা নদীর প্রায় সব জায়গা দখল ও ভরাট হয়ে গেছে। দখলের কারণে বর্তমানে নদীটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
জানা যায়, এক সময় অবিভক্ত বালাগঞ্জ উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত ছিল প্রমত্তা বুড়ি নদী। উপজেলার মানচিত্রে নদীটির অবস্থান সুস্পষ্ট থাকলেও এখন এর কোনো চিহ্ন নেই। প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও মানুষের সর্বগ্রাসী ক্ষুধার কবলে পড়ে নদীটির অস্তিত্ব একেবারে বিলীন হয়ে গেছে।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়েও মরে গিয়ে খালে রূপান্তরিত নদীর বুকে বড় বড় নৌকা চললেও এখন পানি নিষ্কাশনের নালাও নেই। কারণ মরে যাওয়া এই নদীর জায়গা দখল করে যে যার মতো ভোগদখল করছে। কৃষিজমিসহ বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে সেখানে। নতুন প্রজন্মের কাছে এই নদীর ইতিহাস একেবারেই অজানা রয়ে গেছে।
সিলেটের পূর্বাঞ্চলের হাওর এলাকা থেকে অবিভক্ত বালাগঞ্জ উপজেলার দয়ামীর ইউনিয়নের চিন্তামনি দিয়ে প্রবেশ করে উসমানপুর, বোয়ালজুড়, তাজপুর, গোয়ালাবাজার, বুরুঙ্গা, পশ্চিম পৈলনপুর ও সাদীপুর ইউনিয়নের ওপর দিয়ে প্রবাহিত ছিল। বর্তমান বালাগঞ্জ ও ওসমানীনগরে নদীটির দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ৩০ কিলোমিটার।
শতাধিক বছর আগেও প্রমত্তা বুড়ির বুকে জাহাজ ও বড় বড় নৌকা চলাচল করত। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে নদীটি ভরাট হয়ে যেতে শুরু করে। এদিকে স্থানীয়দের দখল আর ভোগের মুখে বিপর্যস্ত হতে থাকে বুড়ি নদী। ১৯৯০ সালের মধ্যে খালে পরিণত হওয়া নদীর বুকে নৌকা চলাচল অব্যাহত ছিল। তবে ভরাট ও দখলের কবলে পড়ে খালে পরিণত হওয়া নদীটি গোয়ালাবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। বর্তমানে বুরুঙ্গা ইউনিয়নে এর শেষ চিহ্ন থাকলেও আর কোথাও নদীটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়।
তাজপুর এলাকায় নদীর ভরাট হয়ে যাওয়া জায়গাগুলো বেদখল হয়ে গেছে। তাজপুর বাজার এলাকায় নদীর শেষ স্মৃতি চিহ্নটুকু গত ৮ থেকে ১০ বছরে দখল করে বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে তুলেছেন প্রভাবশালীরা।
নদী-সংলগ্ন বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ওসমানীনগরের তাজপুর, উসমানপুর এলাকায় নদীর কোনো চিহ্ন নেই। কিছু কিছু জায়গায় নদীর শেষ চিহ্ন হিসেবে ছোট খাল থাকলেও জায়গাগুলো ভরাট করা হয়েছে।
তাজপুর মাছ বাজার লাগোয়া নদীর শেষ চিহ্ন হিসেবে থাকা ছোট খালটি ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। অনেক জায়গা দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে স্থাপনা।
শুধু বুড়ি নদী নয়। রত্না নদীর অস্তিত্বও বিলীনের মুখে। সুরমা নদীর একটি শাখা নাজির বাজার এলাকায় এসে রত্না নাম ধারণ করে দয়ামীর, তাজপুর, গোয়ালাবাজার, উমরপুর হয়ে বানাইয়া হাওরে পতিত হয়েছে। ব্রিটিশ শাসনামলে এই রত্না নদীর তীরে অবস্থিত তৎকালীন যুগলগঞ্জ বাজারে ব্রিটিশবিরোধী কৃষক সম্মেলন হয়েছিল। তবে এই নদীরও কোনো অস্তিত্ব অবশিষ্ট নেই। এ ছাড়া নারকিলাসহ অসংখ্য খালের অস্তিত্ব বিলীনের পথে।
এলাকাবাসীর দাবি বিলীন হয়ে যাওয়া নদী ও খাল-বিলের জায়গা উদ্ধার করে তা খনন করা হলে একদিকে কৃষির ফলন ভালো হবে, অন্যদিকে অনাকাঙ্ক্ষিত বন্যার হাত থেকে রক্ষা পাবে এলাকার মানুষ।
মজলিসপুর গ্রামের চাঁন মিয়া জানান, পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে বুড়ি নদীর গল্প শুনেছেন। তিনি নিজেও দেখেছেন এই নদীর শেষ সময়ের অস্তিত্ব। বর্তমানে নৌকা চলা দূরের কথা, নদীর কোনো অস্তিত্বই নেই।
ওসমানীনগর পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি চয়ন পাল জানান, প্রায় ৩ যুগ আগেও বুড়ি খাল দিয়ে বড় বড় নৌকা চলাচল করতে দেখেছেন। তবে এখন এর অস্তিত্ব অবশিষ্ট নেই। নদীর জায়গা দখল করে তৈরি করা হয়েছে অনেক স্থাপনা।
সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী আবদুল লতিফ বলেন, নদীর জায়গা অবৈধ দখলের একটি তালিকা তৈরি করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। অস্তিত্ব দৃশ্যমান এমন নদীগুলোর ভূমি অবৈধ দখলমুক্ত করতে উচ্ছেদের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন এবং অস্তিত্বহীন নদীর জায়গা দখলমুক্ত করতে পর্যায়ক্রমে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী দিপক রঞ্জন দাশ জানান, খাল-নদীর জায়গা হচ্ছে এক নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত। সেগুলো উদ্ধারে তৎপরতা বাড়ানো হবে।
সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ জানান, বিষয়টি সম্পর্কে তিনি অবগত নন। তবে এ ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।