বেকারি পণ্যে অ্যামোনিয়াম সালফেট
প্রশাসন-বিএসটিআইর অভিযান

গ্রামের কারখানায় অ্যামোনিয়াম সালফেট ব্যবহারের প্রমাণও মিলেছে। এটি ব্যবহার নিষিদ্ধ এবং ক্ষতিকর
সনি আজাদ, চারঘাট (রাজশাহী)
প্রকাশ: ০২ নভেম্বর ২০২৪ | ২৩:২০
গ্রামাঞ্চলে এক সময় বেকারি পণ্যের চাহিদার সিংহভাগ পূরণ করত স্থানীয় বেকারিগুলো। তবে এখন গ্রামের অনেক দোকানের পাউরুটি-কেকও বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর দখলে। এ পরিস্থিতিতে রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার বেকারিগুলো প্রতিযোগিতায় টিকতে অসদুপায় অবলম্বন করছে বলে প্রমাণ পেয়েছে কর্তৃপক্ষ। কম খরচে আকর্ষণীয় পণ্য তৈরি করতে নিষিদ্ধ দ্রব্য ব্যবহার করছে তারা। এতে গ্রামের সাধারণ মানুষ প্রতারিত হওয়ার পাশাপাশি গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছেন।
এলাকার বেশির ভাগ দোকানে স্থানীয় কারখানার পণ্য বিক্রি হয় বলে জানান উপজেলার ভাটপাড়ার বাসিন্দা রুবেল আলী। তিনি বলেন, টাকা দিয়েও ভালো পণ্য পাওয়া যায় না। নজরে রাখলেও ছেলেমেয়েরা স্কুলে গিয়ে এসব পণ্য কিনে খাচ্ছে। মাঝেমধ্যে পেট ব্যথায় ভোগে। তাঁর মেয়ে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ায় এক সপ্তাহ রাজশাহীর হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে হয়েছে। বাড়ির খাবারের চেয়ে দোকানের এসব মুখরোচক পণ্যে তার আগ্রহ বেশি।
নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শকের তথ্য অনুযায়ী, উপজেলার সরদহ এলাকার ইসলামিয়া বেকারি ও বাসস্ট্যান্ড এলাকার বাঁধন বেকারি নামের দুটি কারখানার অনুমোদন রয়েছে। এর বাইরে অনুমোদনহীন অন্তত ২০টি বেকারি আছে। এসব কারখানার বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) অনুমোদন নেই।
গত মার্চ মাসে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর অনুমোদনহীন এসব কারখানায়
অভিযান চালায়। এ সময় পাঁচটি প্রতিষ্ঠানকে ৬০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। তার পরও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। উদ্বেগের বিষয় হলো, গ্রামাঞ্চলের এসব বেকারির পণ্যে নিষিদ্ধ অ্যামোনিয়াম সালফেট ব্যবহারের প্রমাণ মিলেছে। সম্প্রতি সরদহ ও নিমপাড়ার বেকারিতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চালায় উপজেলা প্রশাসন ও বিএসটিআই। এতে নেতৃত্ব দেন উপজেলা
সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আরিফ হোসেন।
অভিযানে ভাই ভাই বেকারি, ইয়াছিন বেকারি ও বাঁধন বেকারিকে ১৮ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। আর অ্যামোনিয়াম সালফেট ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়ায় মিলন বেকারিকে জরিমানা করা হয়েছে ২৫ হাজার টাকা। মালিকদের দাবি, পাউরুটি ফোলানো, কৃত্রিম রং ও বিভিন্ন আকৃতি দিতে ট্রান্সফ্যাট ও মিষ্টিজাতীয় রাসায়নিক সোডিয়াম সাইক্রোমেট এবং অ্যামোনিয়াম বাই কার্বোনেটের ব্যবহার হয়। এটি ‘ব্রেড এনহ্যান্সার’ নামে পরিচিত। কিন্তু অ্যামোনিয়াম বাই কার্বোনেটের তুলনায় অ্যামোনিয়াম সালফেটের দাম কম। এ কারণে খরচ বাঁচাতে খাবারে নিষিদ্ধ এ রাসায়নিকের ব্যবহার হচ্ছে। এতে খাবার মুচমুচে ও আকর্ষণীয় হয়।
সরেজমিন একাধিক বেকারি মালিক ও কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা যেসব রাসায়নিক ব্যবহার করেন, সেগুলোর নাম ও ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জানেন না। আধুনিক প্রযুক্তির কারখানার সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে শহরের বিভিন্ন কারখানায় খোঁজখবর নিয়ে এসব দ্রব্যের ব্যবহার দেখে তারা কিনে আনেন। কম দামের সামগ্রী বেশি ব্যবহার করেন তারা। অ্যামোনিয়াম বাই কার্বোনেটের দাম অ্যামোনিয়াম সালফেটের চেয়ে দ্বিগুণ বলে দাবি তাদের।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অ্যামোনিয়াম সালফেট প্রধানত নাইট্রোজেন রাসায়নিক সার ও অজৈব সার হিসেবে কৃষিকাজে ব্যবহার হয়। কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক হিসেবেও কৃষক ব্যবহার করেন। এ ছাড়া অ্যামোনিয়াম সালফেট পরীক্ষাগারে বিকারকরূপে ব্যবহার হয়। কিন্তু সরাসরি খাদ্যদ্রব্যে ব্যবহার নিষিদ্ধ। অভিযানে ২৫ হাজার টাকা জরিমানার শিকার মিলন বেকারির মালিক মিলন আলীর ভাষ্য, পাউরুটি ফোলাতে, দীর্ঘসময় খামি সতেজ রাখতে ও পণ্য আকর্ষণীয় করতে বিভিন্ন দ্রব্য ব্যবহার হয়। কোনটা অ্যামোনিয়াম সালফেট বা ক্ষতিকর, তা না জেনে তারা ব্যবহার করেছেন।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, উপজেলা সদরের দোকানগুলোয় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের গাড়ি বিস্কুট, পাউরুটি, কেকসহ নানা পণ্য সরবরাহ করে। কিন্তু গ্রামের দোকানগুলোয় কম দামে পণ্য সরবরাহ করছে হাতে তৈরি স্থানীয় বেকারির পণ্য। বেশি লাভের আশায় দোকানিরাও এসব পণ্য বিক্রিতে বেশি আগ্রহী। কম দামের আকর্ষণীয় এসব পণ্য শিশু-কিশোরদের মধ্যে জনপ্রিয়।
অ্যামোনিয়াম সালফেটের ক্ষতিকর দিক নিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আশিকুর রহমান বলেন, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত রুটি, পাউরুটি ও বেকারির পণ্যে ক্ষতিকর অ্যামোনিয়াম সালফেট ব্যবহারের কথা জেনেছেন। এটি শিশুদের জন্য ক্ষতিকর। খাবারে এ বিষাক্ত রাসায়নিকের ব্যবহারে থাইরয়েড গ্রন্থির রোগ, ডায়রিয়া, বমিভাব, পেটের পীড়া, এমনকি ক্যান্সারও হতে পারে।
বিএসটিআইর কর্মকর্তারা জানান,
অ্যামোনিয়াম বাই কার্বোনেট পরিমিতভাবে এবং যত্নসহকারে বেকারির পণ্যে ব্যবহার করা হয়। কারণ আগুনে খাবার তৈরির সময় অধিক তাপমাত্রায় এগুলো উড়ে যায়। খাবারে এর উপস্থিতি থাকে না। কিন্তু অ্যামোনিয়াম সালফেট অধিক তাপমাত্রায়ও থেকে যায়, যা পরে খাবারের সঙ্গে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে।
উপজেলার পাড়া-মহল্লার বেকারিগুলো অনুমোদন না নিয়েই বিএসটিআইর মানচিহ্ন ব্যবহার করে পণ্য বিক্রি করছে বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির রাজশাহী বিভাগীয় অফিসের পরিদর্শনকারী কর্মকর্তা জুনায়েদ আহমেদ। তিনি বলেন, পণ্যের গায়ে উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও মেয়াদোত্তীর্ণের সঠিক তারিখ থাকে না। গ্রামের কারখানায় অ্যামোনিয়াম সালফেট ব্যবহারের প্রমাণও মিলেছে। এটি ব্যবহার নিষিদ্ধ এবং স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
এ বিষয়ে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আরিফ হোসেন বলেন, বেকারিগুলো শ্রমিক, কর্মী ও কারখানা পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে উদাসীন। উৎপাদিত পণ্য যত্রতত্র সংরক্ষণ, নিম্নমানের উপাদান-উপকরণ ব্যবহার করা, ফুড গ্রেডেড নয় এমন কালার ও ফ্লেভার ব্যবহার বেকারিগুলোর নিত্যনৈমিত্তিক অপরাধ। অ্যামোনিয়াম সালফেটের বিষয়েও আমরা শক্ত অবস্থানে আছি। পর্যায়ক্রমে সব কারখানায় অভিযান চালানো হবে।
- বিষয় :
- বিএসটিআই