ঢাকা বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫

রোগী দেখেন স্যাকমো

রোগী দেখেন স্যাকমো

পীরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা দিচ্ছেন স্যাকমো সারা হেমব্রম ও রিপন রায়। ছবি: সমকাল

মোকাদ্দেস হায়াত মিলন, পীরগঞ্জ (ঠাকুরগাঁও) 

প্রকাশ: ৩০ মে ২০২৫ | ২৩:৩০ | আপডেট: ৩১ মে ২০২৫ | ১০:২১

বহির্বিভাগে লম্বা লাইন। শিশু-বৃদ্ধ সব বয়সের রোগী এসেছেন চিকিৎসা নিতে। কোনো চিকিৎসক নেই। দুইজন উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার (স্যাকমো) সারা হেমব্রম ও রিপন রায় রোগী দেখছেন। কক্ষের ভেতরও রোগীর ভিড়। জরুরি বিভাগও সামলাচ্ছেন একজন সহকারী সার্জন।

এ চিত্র দেখা গেছে পীরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। হাসপাতালটিতে জনবল সংকট ছাড়াও রয়েছে নানা সমস্যা। রয়েছে চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাব। পরিবেশ অস্বাস্থ্যকর। স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আব্দুল জব্বার বেশির ভাগ সময় কোয়ার্টারে থাকেন না। থাকেন ৩০ কিলোমিটার দূরে জেলা সদরে। খেয়াল খুশিমতো অফিস করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।

তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ডা. আব্দুল জব্বার। স্যাকমো দিয়ে সেবা দেওয়ার বিষয়ে তাঁর ভাষ্য, ৫০ শয্যার হাসপাতাল ৩ জন চিকিৎসক দিয়ে সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। বহির্বিভাগে রোগীর চাপ, ভর্তি রোগীর সংখ্যাও বেশি; পরিস্থিতি সামাল দিতে স্যাকমো দিয়ে রোগী দেখতে বাধ্য হচ্ছেন।

ব্যাপক জনবল সংকট: ২০১০ সালে হাসপাতালটি ৩১ থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়। স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, জুনিয়র কনসালট্যান্টসহ চিকিৎসক পদ রয়েছে ৩২টি। বিপরীতে কর্মরত আছেন ৩ জন। হাসপাতালে চিকিৎসকসহ মোট পদের সংখ্যা ২১২। এর মধ্যে ৬২টি পদ শূন্য। জুনিয়র কনসালট্যান্ট সার্জারি, মেডিসিন, গাইনি, শিশু, অর্থোপেডিক্স, কার্ডিওলজি, চক্ষু, ইএনটি, আরএমওসহ ২৯টি পদ শূন্য দীর্ঘদিন ধরে। মাতৃত্বকালীন ছুটিতে আছেন একজন চিকিৎসক। বহির্বিভাগ ও জরুরি বিভাগে রোগী দেখেন সহকারী সার্জন ডা. আব্দুর রহমান সোহান ও দুই জন স্যাকমো। 

স্থানীয় বাসিন্দা বুলবুল আহাম্মেদ বলেন, ‘২৩ এপ্রিল স্ত্রীকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। জরুরি বা বহির্বিভাগ কোথাও চিকিৎসক ছিল না। স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে ফোন করলে চিকিৎসক পাঠাচ্ছেন বলে জানান। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পরও চিকিৎসক না আসায় অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসি।’ 

হাসপাতালের স্যাকমো সারা হেমব্রম ও রিপন রায় বলেন, কর্তৃপক্ষের নির্দেশেই রোগী সেবা দিচ্ছেন। বিপুল সংখ্যক রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে বলেও জানান তারা।

বেহাল চিকিৎসা সরঞ্জাম: এক্স–রে মেশিন খারাপ থাকায় ২০১৩ সালের ২৪ নভেম্বর টেকনোলজিস্ট আব্দশ শুকুরকে রাজশাহী মেডিকেলে বদলি করা হয়। একই সঙ্গে সেখানকার টেকনোলজিস্ট আব্দুর রাজ্জাককে পীরগঞ্জে এনে ফের ডেপুটেশনে রাজশাহীতে পাঠানো হয়। ২০২৩ সালের ১৬ এপ্রিল এক্স-রে মেশিন সরবরাহ করে কর্তৃপক্ষ। টেকনোলজিস্ট না থাকায় সেটি চালু করা যায়নি। আব্দুর রাজ্জাকের ডেপুটেশন বাতিল করে পীরগঞ্জে ফিরিয়ে আনতে কয়েকবার কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে। অজ্ঞাত কারণে তাঁর ডেপুটেশন বাতিল হয়নি। ওই পদে কাউকে পদায়নও করা হয়নি। 

ইসিজি এবং আলট্রাসোনোগ্রাম মেশিন অকেজো। গাইনি চিকিৎসক ও অবেদনবিদ না থাকায় ছয় বছর ধরে সিজার বন্ধ। 

তিন বছরের অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছেন ভাকুড়া গ্রামের বাবুল ইসলাম। চিকিৎসক  বেশ কিছু পরীক্ষা দিয়েছেন। পরীক্ষাগুলো বাইরের ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে করতে বলা হয়েছে। হতদরিদ্র বাবুল এখন খরচ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন। 

সক্রিয় দালালচক্র

রোগীকে বিভিন্ন ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ভাগিয়ে নিতে এক ডজনেরও বেশি দালালচক্র সক্রিয় হাসপাতাল চত্বরে। তারা কাজ করছেন হাসপাতাল ঘিরে গড়ে ওঠা চার–পাঁচটি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের হয়ে। কম খরচে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দেওয়ার কথা বলে নিয়মিত রোগী ভাগিয়ে নেন তাঁরা। এ কাজে পিছিয়ে নেই হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও। ছোট ইনজুরি ও অচেতন কোনো রোগী ইমার্জেন্সিতে এলেও তারা ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর ও রংপুর হাসপাতালে স্থানান্তর করেন। 

অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ

হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, বহির্বিভাগে রোগীর ভিড়। ওয়ার্ডগুলোর শয্যা অপরিচ্ছন্ন। একজন রোগী জানালেন বৃহস্পতিবার ভর্তি হয়েছেন। রাতেই বাড়ি ফিরবেন। কারণ, সেবা দেওয়ার মতো লোকবল নেই। টাকা না দিলে ওয়ার্ডবয়রা রোগীর শরীরে হাত দিতে চান না। ৫০-১০০ টাকা দিলেই সেবা মেলে। ওয়ার্ডের অবস্থা আরও খারাপ। হাসপাতালের বেডে বিড়াল শুয়ে আছে– এমন ভিডিও সম্প্রতি ভাইরাল হয়েছে বলে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই রোগী। 

আরও পড়ুন

×