সাগরে মৎস্যসম্পদ ধ্বংস হচ্ছে ট্রলিং নৌযানে

সমুদ্রগামী কাঠের ট্রলারের গঠনে কিছু পরিবর্তন আনা অবৈধ হলেও অধিক মাছ শিকার করতে পারায় এমন নৌযান তৈরিতে আগ্রহী হন অনেকেই। সম্প্রতি বরগুনার পাথরঘাটা থেকে তোলা -সমকাল
সুমন চৌধুরী, বরিশাল ও ইমাম হোসেন নাহিদ, পাথরঘাটা (বরগুনা)
প্রকাশ: ২৪ জুন ২০২৫ | ০০:৫৬ | আপডেট: ২৪ জুন ২০২৫ | ২১:৩১
বরগুনার পাথরঘাটায় সমুদ্রগামী কাঠের ট্রলারের কয়েকটিতে প্রায় তিন বছর আগে আকস্মিক পরিবর্তন আনা হয়। ইন্ডাস্ট্রিয়াল নৌযান (ট্রলিং জাহাজ) আদলে রূপান্তর করা হয় সেগুলো। অধিক মাছ শিকার করতে পারায় এই পদ্ধতির ব্যাপারে আগ্রহী হন অনেকেই। বাড়তে বাড়তে এই ট্রলিং জাহাজের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৮-এ। তবে এই নৌযানে মাছ আহরণ সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদের জন্য বড় হুমকি। এতে ব্যবহৃত কম গভীরতার জালে উঠে আসে মাছের রেণু ও ডিম। এতে মৎস্যসম্পদ ধ্বংস হচ্ছে। কিন্তু এ নৌযান বন্ধের ব্যাপারে দীর্ঘদিনেও প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
গত ১৭ জুন কোস্টগার্ডের সঙ্গে গণ্ডগোলের পর ট্রলারের মালিকরা অভিযোগ করেন, চাঁদা না দেওয়ায় তারা কোস্টগার্ডের রোষানলে পড়েছেন। ৩২ জনের নাম উল্লেখ করে ও অজ্ঞাত ৭০০-৮০০ জেলে ও মৎস্য ব্যবসায়ীকে আসামি করে মামলা দেওয়া হয়েছে।
শুধু পাথরঘাটায় নয়, পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার মহিপুর-আলীপুর এবং ভোলায় প্রায় ৩০০ অবৈধ এমন ট্রলারে মাছ আহরণ করা হয়। এর মধ্যে পটুয়াখালীর আলীপুর-মহিপুর মৎস্য মোকামে ৩৫টি এবং ভোলার ৯০টি ট্রলিং ট্রলারে রূপান্তরের তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।
অবৈধ ট্রলারে বড় ক্ষতি
গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার জন্য ট্রলিং নৌযান সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের নকশা অনুযায়ী নির্মাণ হয় এবং সামুদ্রিক মৎস্য অধিদপ্তরে এগুলোর নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। সাগরে জাল ফেলা ও তোলা সবকিছু যান্ত্রিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় এবং ব্যবহৃত হয় অধ্যাধুনিক ডিভাইস। এ নৌযান নিবন্ধনের প্রধান শর্ত হলো– মাছ আহরণের জন্য সাগরের ৪০ মিটারের বেশি গভীরে জাল ফেলতে হবে। এসব নিয়মের তোয়াক্কা না করে দক্ষিণের উপকূলে ইলিশ আহরণে ব্যবহৃত কাঠের তৈরি ট্রলারে স্থানীয় পদ্ধতিতে ট্রলিং নৌযানের যন্ত্র স্থাপন করা হচ্ছে। এতে প্রতিটি ট্রলারে ব্যয় হয় ৩০-৩৫ লাখ টাকা। এ ট্রলারে ছয়-সাত মিটার গভীর জলে যন্ত্র দিয়ে জাল টেনে মাছ আহরণ করা হচ্ছে।
পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের মার্কেটিং অফিসার বিপ্লব কুমার বলেন, অনুমোদিত ট্রলিং নৌযানের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ৪০ মিটার গভীরে জাল ফেলার শর্ত দেওয়া হয়। এতে জালের নিচের অংশ থেকে সাগরের তলদেশ আরও গভীরে থাকে। স্থানীয়ভাবে নির্মিত ট্রলিং নৌযানগুলোর জাল আট মিটারের বেশি গভীরে যায় না। সাগরের এই স্তরের পানিতে মাছের রেণু ও ডিম থাকে। তাদের ফেলা বাঁধা জালে মাছের সঙ্গে রেণু ও ডিমও উঠে আসে। এতে বড় ক্ষতি হচ্ছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য বিভাগের অধীনে উপকূলে মৎস্য গবেষণায় ফেলো হিসেবে কাজ করা বিপ্লব কুমার আরও বলেন, এসব জাল যন্ত্র দিয়ে টানায় সব ধরনের পরগাছা ও শামুক জালের সঙ্গে জড়িয়ে যায়। এতে ধ্বংস হচ্ছে মাছের খাবারের উৎস। মাছের বৈশিষ্ট্য হলো, খাদ্য সংকটে পড়লে স্থান পরিবর্তন করে অন্যত্র চলে যায়। খাদ্য সংকটের কারণে পাথরঘাটা উপকূলে টুনা মাছ আগের চেয়ে কমে গেছে।
পটুয়াখালীর কুয়াকাটার খাজুরা এলাকার জেলে ছিদ্দিক ফকির বলেন, ‘যেসব জেলে বৈধ প্রক্রিয়ায় সমুদ্রে মাছ শিকার করেন, তারা মাছ না পাওয়ায় লোকসানে পড়ছেন। এ জন্য দায়ী ট্রলিং ট্রলার। এসব ট্রলার বন্ধ না হলে সাগর মাছশূন্য হয়ে পড়বে।’ আবু হানিফ খান নামে এক জেলে বলেন, ‘ট্রলিং বোট দিয়ে নির্বিচারে মাছ ধরায় এখন সাগরে মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। যান্ত্রিক এ পদ্ধতির মাধ্যমে সব প্রজাতির এবং সব আকৃতির মাছ ধরা হচ্ছে। বড় মাছগুলো রেখে মরে যাওয়া ছোট মাছ সাগরে ফেলে দেওয়া হয়।’
বঙ্গোপসাগরের তীরের পাথরঘাটা দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র। এখানে সমুদ্রগামী ট্রলার ২১০টি। তিন বছর আগে মাসুম কোম্পানি প্রথমে তাদের দুটি কাঠের ট্রলারে ট্রলিং যন্ত্র স্থাপন করে। এতে মাছ আহরণ হয় কয়েক গুণ। পরে একের পর এক এ ধরনের ট্রলার বেড়েছে। গত ১৭ জুন মাসুম কোম্পানির দুটি নৌযান জব্দ করে কোস্টগার্ড। এ নিয়ে উত্তেজনার এক পর্যায়ে কোস্টগার্ড স্টেশন ঘেরাও ও হামলা চালানো হয়।
পরদিন ইউএনও অফিসে সমঝোতা সভায় মাসুমসহ অনেক ব্যবসায়ী অভিযোগ করেন, ৫৮ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষ হয়েছে ১৫ জুন। নিষেধাজ্ঞার সময়ে সাগরে যাওয়ার সুযোগ দিতে কোস্টগার্ড ট্রলারপ্রতি দুই লাখ টাকা নিয়েছে। ফের টাকা চাইলে না দেওয়ায় ট্রলার আটক করেছে। তবে তখন কোস্টগার্ড দাবি করে, তাদের নাম ব্যবহার করে সোর্সরা এ কাজ করতে পারে।
বন্ধের প্রক্রিয়া আটকে আছে আইনের প্যাঁচে
ট্রলিং ট্রলার বিষয়ে ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের পরিচালক মো. এমদাদুল্লাহ সমকালকে বলেন, ‘এ নৌযান সাগরে মৎস্য ও প্রাণিজসম্পদের জন্য এখন বড় হুমকি। এগুলো পানির নিচের সব ধ্বংস করে দিচ্ছে। এসব বন্ধের প্রক্রিয়া আইনের প্যাঁচে আটকে দিয়েছে মৎস্য ব্যবসায়ীরা। বেহেন্দি জাল ব্যবহারের লাইসেন্স নিয়ে সেটি অবৈধ ট্রলিং জাহাজে তোলা হয়েছে। এর পরে এ নৌযানটির বৈধতা চেয়ে রিট করেছে। এই রিটের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত কিছু করা যাচ্ছে না।’
তিনি আরও বলেন, এ নৌযান বন্ধের একমাত্র উপায় হলো জব্দ ও পরে ধ্বংস করা। কিন্তু আকৃতিতে বড় হওয়ায় সেগুলো জব্দের পর রাখার মতো জায়গা নেই। অভিযানে জরিমানা করা যায় সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা। কয়েক গুণ লাভ হওয়ায় মৎস্য ব্যবসায়ীরা এ জরিমানা খুশিমনে মেনে নেন। তিনি জানান, সারাদেশে প্রায় ৩০০ অবৈধ ট্রলিং জাহাজ আছে। এর শুরুটা হয়েছে পাথরঘাটায়। পরে ভোলা, কুয়াকাটা, চট্টগ্রামের বাঁশখালী ও হাতিয়ার চেয়ারম্যানহাট মৎস্য মোকাম পর্যন্ত ছড়িয়েছে।
- বিষয় :
- মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ