ঢাকা বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫

‘বাম বিকল্প’ কি আকাঙ্ক্ষা না বাস্তবতা?

‘বাম বিকল্প’ কি আকাঙ্ক্ষা না বাস্তবতা?

.

শাহ্ নুরুজ্জামান

প্রকাশ: ০২ এপ্রিল ২০২৪ | ০৫:২০ | আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০২৪ | ১৫:৪২

গত ২৩ ফেব্রুয়ারি দৈনিক সমকাল পত্রিকায় মোশতাক আহমেদের লেখা ‘বাম-রোমান্টিকতা’ নিয়ে দ্বিদলীয় বৃত্ত ভাঙা যাবে? শিরোনামের লেখাটি আমার দৃষ্টি কেড়েছে। বিষয়টি রাজনীতিতে খুবই সময়োপযোগী এবং প্রাসঙ্গিক। তিনি আমার অগ্রজ এবং রাজনীতিতে সতীর্থ হওয়ার কারণে তাঁর লেখার ওপর মতামত ব্যক্ত করার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না। আহমেদ একজন বাস্তববাদী মানুষ এবং রাজনীতিতেও তাই। তিনি বলেছেন, এ দেশে বামপন্থিরা সময়ের ভাষা বুঝতে সব সময় ভুল করেছে। স্বাধীনতার আগে যেমন, স্বাধীনতার পরেও তারা ব্যর্থতারই পরিচয় দিয়েছে। ফলে লাভবান হয়েছে উঠতি পুঁজিবাদী শক্তি, যার প্রতিনিধিত্ব করছে দেশের বড় দুটি দল। তাঁর লেখার মধ্যাংশে উল্লেখ করেছেন, রাজনীতি যেহেতু জনগণের জন্য, তাই জনগণের মতো করেই রাজনৈতিক দলকে বুঝতে হবে। কোনো কিছুই সময়-নিরপেক্ষ নয়, তাই চলমান সময়কে বিবেচনা রেখেই রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের কর্মপরিকল্পনা স্থির করতে হবে। তাছাড়া গত তিন-চার দশকে বাংলাদেশের সমাজ কাঠামোতে যে পরিবর্তন হয়েছে, তাকে হৃদয়ঙ্গম করতে বামপন্থি দলগুলো ব্যর্থ হয়েছে। আজকে বাংলাদেশে যে একটা উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ হয়েছে, তাকে তারা ধারণ করতে পারছে না। এই বিকাশমান শ্রেণির মন, মনন এবং চাহিদাকে বুঝতে তারা ব্যর্থ হচ্ছে বলে মনে হয়।

লেখার শেষাংশে বলেছেন, বাম দলগুলো সব সময় বলে আসছে, তারা দেশে একটা বিপ্লবী গণতান্ত্রিক রূপান্তর ঘটাতে চায়। কিন্তু রূপান্তরের কোনো রাজনৈতিক রূপরেখা জনগণের সামনে হাজির করতে পারছে না। এই বাস্তবতায় বাম দলগুলোকে ‘বাম-রোমান্টিকতা’ থেকে বেরিয়ে এসে সময়োপযোগী ন্যূনতম কর্মসূচির ওপর ভিত্তি করে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতায় শুধু বাম ঐক্য নিয়ে খুব বেশি দূর এগোনো যাবে বলে মনে হয় না। গণতন্ত্রে বিশ্বাসী সব দলের সঙ্গে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। সম্ভাব্য ন্যূনতম ইস্যুতে সব গণতান্ত্রিক শক্তিকে একটি সাধারণ প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসতে হবে। সেটা না হলে শুধু বাম দিয়ে দ্বিদলীয় বৃত্ত ভাঙা যাবে না।
আহমদের উপরিউক্ত বক্তব্যের সঙ্গে আমি প্রায় একমত। তদুপরি জোর দিয়ে বলতে চাই, আপামর জনগণসহ রাজনৈতিক অঙ্গনে এ মুহূর্তে বা নিকট ভবিষ্যতে এ রকম একটা বাম বিকল্প শক্তির কথা ভাবছে না, কারণ বর্তমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজ কাঠামোর যে চিত্র, তা বাম-বিকল্পের অনুকূলে নয় এবং চাইলেই দ্রুত এই চিত্র পাল্টে যাবে বলে মনে হয় না। স্পষ্টতই বোঝা যায়, কর্তৃত্ববাদী এই সরকারের অংশীজন হচ্ছে সামরিক-বেসামরিক আমলা, র্যা ব-বিজিবি-পুলিশ, উঠতি পুঁজিপতি-শিল্পপতি ও করপোরেট ব্যবসায়ী, ট্রেডবডি, ঋণখেলাপি, অর্থ পাচারকারী লুটেরা গোষ্ঠী। তার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে সুবিধাভোগী সুশীল সমাজ ও পেশাজীবীদের একটা বড় অংশ। তা ছাড়া রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গু আইন, শাসন ও বিচার বিভাগ, সবই সরকারের নিয়ন্ত্রণে। এর থেকে উত্তরণ অর্থাৎ জনগণের মালিকানা তথা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কাজটি খুবই জটিল।

ঐতিহাসিকভাবেই বাংলাদেশে বাম ও কমিউনিস্টরা বিকল্প শক্তির সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারেনি। ষাটের দশকে এ দেশের জাতীয়তাবাদী আবেগ বুঝতে না পারাটা ছিল বামপন্থিদের একটি বড় ব্যর্থতা। স্বাধিকার চেতনা নিয়ে মানুষ যখন এগিয়ে যাচ্ছে, বামপন্থিরা তখন আন্তর্জাতিকতাবাদ অর্থাৎ চীন-মস্কো বিতর্কে নিজেদের শক্তি ব্যয় করে। তাই বামদের এখন উচিত হবে, অন্যান্য দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক শক্তি ও র্যা ডিক্যাল শক্তির সমন্বয়ে একটি প্ল্যাটফর্ম গঠন করা। এতে করে বামদের ভোটের রাজনীতিতে বিচ্ছিন্নতা কাটবে এবং প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক শক্তির একটি বলয় সৃষ্টি হবে। এ ক্ষেত্রে তরুণ সমাজকে রাজনীতিতে আকৃষ্ট করতে না পারলে বাম প্রগতিশীলদের কোনো আন্দোলনই সফল হবে না। একই সঙ্গে উঠতি মধ্যবিত্ত সমাজকে আন্দোলনে সম্পৃক্ত করার জন্য তাদের অধিকার-স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়কে কর্মসূচি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। 

শাহ্ নুরুজ্জামান: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কোষাধ্যক্ষ, গণফোরাম কেন্দ্রীয় কমিটি
[email protected]

আরও পড়ুন

×