বন্দরে বাড়েনি স্ক্রিনিং, অপ্রস্তুত হাসপাতাল

মহাখালীর ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কভিড হাসপাতালে বেহাল অবস্থায় পড়ে আছে এক সময়ের রোগীদের ব্যবহারের শয্যা -সমকাল
তবিবুর রহমান
প্রকাশ: ২৬ ডিসেম্বর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০২২ | ১৩:১৪
চীন, ভারতসহ বেশ কয়েকটি দেশে করোনার নতুন উপধরনে সংক্রমণের হার ঊর্ধ্বমুখী। এ ধরন প্রতিরোধে বাংলাদেশের সব বিমান, স্থল ও সমুদ্রবন্দরে স্ট্ক্রিনিং বাড়াতে গত ২৪ ডিসেম্বর লিখিত চিঠি দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে এখনও বন্দরগুলোতে সেভাবে নজরদারি বাড়েনি। সব বন্দরে র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্টের মাধ্যমে পরীক্ষা করে আক্রান্ত ব্যক্তিকে আইসোলেশনে নেওয়ার নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। গত তিন দিনে মাত্র চারজনকে আইসোলেশনে এবং ৭৫ জনের কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। অথচ শুধু শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে দৈনিক ১০ হাজারের বেশি যাত্রী দেশে প্রবেশ করছেন। তাঁদের মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় মাত্র ১ হাজার ৩০৬ জনকে স্ট্ক্রিনিং করা সম্ভব হয়েছে। এ নির্দেশনা দেওয়ার আগে সারাদেশে দৈনিক গড়ে সাড়ে ছয় হাজার জনকে স্ট্ক্রিনিং করা হতো, এখনও এমনই করা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে শাহজালাল বিমানবন্দরের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ শাহরিয়ার সাজ্জাদ সমকালকে বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে চিঠি পাওয়ার পর বিমানবন্দরে স্ট্ক্রিনিং জোরদার করা হয়েছে। বিশেষ করে চীন, ভারত, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ব্রাজিল, জার্মানি থেকে আসা যাত্রীদের বেশি তদারকির মধ্যে রাখা হচ্ছে। আজ (সোমবার) চার চীনা নাগরিকের র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট পজিটিভ পেয়েছি, তাঁদের ডিএনসিসি কভিড হাসপাতালের আইসোলেশনে পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া তাঁদের নমুনা পাঠানো হয়েছে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে (আইইডিসিআর)।
তিনি আরও বলেন, ২০ জন চীনা নাগরিকের মধ্যে প্রথমে কয়েকজনের কান অতিরিক্ত লালচে দেখে সন্দেহ হয়। পরে র্যাপিড অ্যান্টিজেন কিটে তাঁদের নমুনা পরীক্ষা করা হলে চারজনের টেস্ট পজিটিভ আসে। তবে এখনও কাউকে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়নি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল বাশার খুরশীদ বলেন, করোনা ইউনিটগুলো প্রস্তুত করতে হাসপাতালের পরিচালকের সঙ্গে বৈঠক করে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে রোগীর সেবা দেওয়ার জন্য এখনও প্রস্তুত করা হয়নি কভিড, নন-কভিড হাসপাতালগুলো। করোনা নির্ধারিত ওয়ার্ডে অন্যদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। মুমূর্ষু রোগীদের সেবা দেওয়ার জন্য আইসিইউ শয্যাগুলো আলাদা করা হয়নি। একাধিক হাসপাতাল ঘুরে প্রস্তুতির ব্যাপক ঘাটতি দেখা গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাসপাতালগুলো করোনা সংক্রমণ ছড়ানোর অন্যতম মাধ্যম। এ জন্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে বিশেষ নজর দিতে হবে। তবে করোনা পরিস্থিতি স্বস্তিদায়ক অবস্থায় থাকায় জনগণের মধ্যে সচেতনতার অভাব তীব্র। অধিকাংশই স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। মাস্ক পরা, সাবান দিয়ে ঘন ঘন হাত ধোয়া, জনসমাগম এড়িয়ে চলা, সামাজিক দূরত্ব রক্ষার বিষয়গুলো উপেক্ষিত। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হবে। ভারত ও চীনের সঙ্গে অবাধ যোগাযোগ থাকায় বাংলাদেশ উচ্চ সংক্রমণ ঝুঁকিতে রয়েছে। তাছাড়া ভ্যারিয়েন্টটিতে আক্রান্ত ব্যক্তি তার সংস্পর্শে আসা ১৮ জনকে সংক্রমিত করতে পারে। ফলে এটি অতিসংক্রামক। শনাক্ত করাও কঠিন। তাই সন্দেহভাজন রোগীদের চিকিৎসায় সব হাসপাতালকে এখনই যথাযথ প্রস্তুতি নিতে হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, করোনার আগের সংক্রমণের সময় রাজধানীতে পাঁচটি কভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালসহ বিভাগ, জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে আলাদা ইউনিট ছিল। পরে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসায় সেগুলোতে সাধারণ রোগীর সেবা চালু হয়। ফলে করোনা চিকিৎসায় ব্যবহূত আইসিইউ, এইচডিইউ শয্যা, ভেন্টিলেটর, অক্সিজেন কনসেনট্রেটর ও সেন্ট্রাল অক্সিজেন, হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলাসহ অন্যান্য সরঞ্জাম বাক্সবন্দি করা হয়েছে। শুধু মহাখালীর ডিএনসিসি কভিড হাসপাতাল রোগীদের সেবার জন্য কিছুটা প্রস্তুত হয়েছে। বাকিগুলোর অবস্থা করুণ।
করোনা সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখীর সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন স্থানে চিকিৎসা দেওয়া হয়। সেগুলো হলো- কেবিন ব্লক, বেতার ভবন ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব ফিল্ড হাসপাতাল। তবে সরেজমিন দেখা গেছে, বর্তমানে এ হাসপাতালে কোনো করোনা ইউনিট আর নেই। বেতার ভবনে বসবাস করছেন আনসার সদস্যরা। কেবিন ব্লকে অন্য রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এমনকি গত আগস্ট মাসে বঙ্গমাতা ফিল্ড হাসপাতালটি ভেঙে সেখানে তৈরি করা হয় অডিটোরিয়াম। চিকিৎসা উপকরণগুলো গ্যারেজে রাখা।
ফিল্ড হাসপাতালের পরিচালক এহসানুল কবির সুমন বলেন, করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসায় গত আগস্ট থেকে হাসপাতালটি ভেঙে অডিটোরিয়াম তৈরি করা হয়েছে। যদি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়, তাহলে আবার হাসপাতাল তৈরি করা হবে। আইসিইউ, এইচডিইউ শয্যা, ভেন্টিলেটর, অক্সিজেন কনসেনট্রেটর ও সেন্ট্রাল অক্সিজেন, হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলাসহ অন্যান্য সরঞ্জাম কোথায় রাখা হয়েছে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ প্রশ্ন আপনি কেন করছেন। আপনাকে কেন উত্তর দেব?
গতকাল রাজধানীর ডিএনসিসি কভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল ঘুরে সেখানে জরুরি বিভাগের সামনে টানানো বড় সাইনবোর্ডে ২৫ ডিসেম্বর সকাল থেকে ২৬ ডিসেম্বর সকাল ৮টা পর্যন্ত রোগী ভর্তির পরিসংখ্যান দেখা যায়। তালিকায় রোববার সকাল থেকে সোমবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ১৮ জন পুরুষ ও চারজন নারী রোগী ট্রায়াল ক্লিনিকের মাধ্যমে সেবা নিয়েছেন। এ সময় ভর্তি করা হয়েছে তিনজনকে, যাদের সবাই আইসিইউতে চিকিৎসাধীন। এ ছাড়া সোমবার দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত একজনকে আইসিইউতে ভর্তি করা হয়েছে। এর বাইরে এইচডিইউতে ভর্তি রয়েছেন ১৬ জন। সব মিলে ১ হাজার ৩৫ শয্যার হাসপাতালে ভর্তি ১৯ জন। হাসপাতালের কয়েকজন চিকিৎসক ও নার্স জানান, কভিড আক্রান্তদের সেবায় তাঁদের পূর্ণ প্রস্তুতি রয়েছে। ভর্তিযোগ্য কোনো রোগীকেই ফেরত দেওয়া হচ্ছে না।
উত্তরার কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. শিহাব উদ্দিন বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তাঁদের নির্দেশ দিলে এক সপ্তাহের মধ্যে সব ব্যবস্থা করা হবে। মানসিক প্রস্তুতিও আছে। তবে রোগী ভর্তি না থাকলেও নমুনা পরীক্ষা চলছে।
মুগদা জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ডা. নিয়াতুজ্জামান বলেন, আমার হাসপাতালটি কভিড ডেডিকেটেড। মাঝে সংক্রমণ কমে যাওয়ায় সাধারণ রোগীর সেবাদান শুরু হয়। আগের ইউনিটের ১০টি বিছানা আজ (সোমবার) সকালে নতুন করে প্রস্তুত করেছি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দৈনিক করোনা-সংক্রান্ত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ৫০টি কভিড সাধারণ ও ১০টি আইসিইউ শয্যার কথা উল্লেখ থাকলেও সোমবার সরেজমিন গিয়ে সংশ্নিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে সেখানে কোনো কভিড ইউনিট বা আইসিইউ শয্যা পাওয়া যায়নি। সকাল সাড়ে ১০টায় হাসপাতালটির বহির্বিভাগ, জরুরি বিভাগ ও আন্তঃবিভাগে রোগী, স্বজন, চিকিৎসক, নার্স, আয়া, ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা যায়। তাঁদের ৯০ শতাংশেরই মুখে মাস্ক ছিল না। সন্দেহভাজন রোগীদের করোনা শনাক্তে ট্রায়াল রুমে বসা দুই চিকিৎসক ও এক নার্সের মুখেও মাস্ক ছিল না। জরুরি বিভাগের বাঁ পাশের হাত ধোয়ার তিনটি বেসিনের সবক'টি অকেজো দেখা যায়।
এ বিষয়ে হাসপাতাল পরিচালক ডা. খলিলুর রহমান বলেন, নতুন করে প্রস্তুতির বিষয়ে কোনো নির্দেশনা আসেনি। রোগী বাড়লে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাছাড়া করোনা নিয়ে কারও মধ্যে তেমন উদ্বেগ নেই। জানতে চাইলে সরকারের রোগতত্ত্ব রোগ নিয়ন্ত্রণ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মোশতাক হোসেন বলেন, সরকারের নির্দেশনা না মানলে সামনে মহাবিপদ অপেক্ষা করছে। এখন থেকে হাসপাতালগুলো প্রস্তুত করাতে হবে। হাসপাতালসংশ্নিষ্ট ও রোগীদের স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ভাইরাস বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, হাসপাতালগুলোর সব ধরনের প্রস্তুতি থাকতে হবে, যেন রোগী আসার সঙ্গে সঙ্গে ভর্তি করা যায়। পর্যাপ্ত অক্সিজেনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। রোগীরা কখনোই যেন অক্সিজেন সংকটে না পড়ে। প্রতিষ্ঠানগুলোর কভিডের পাশাপাশি রোগীর অন্যান্য ক্লিনিক্যাল অবস্থা মোকাবিলার সক্ষমতা থাকতে হবে। আইসিইউর পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখতে হবে। যেন প্রয়োজন পড়লেই রোগীরা বিশেষায়িত সেবা পেতে পারেন।
- বিষয় :
- করোনা শনাক্ত