মিনিমাল ইনভেসিভ কার্ডিয়াক সার্জারি
হার্টের সার্জারির পর ১৫ দিনেই স্বাভাবিক জীবন

ডা. সায়েদুর রহমান খান এমবিবিএস, এমএস (সিটিএস) ও ডা. জাহাঙ্গীর কবিরের নেতৃত্বাধীন টিমের অন্যতম সার্জন সিনিয়র কনসালট্যান্ট, কার্ডিয়াক সার্জারি ইউনাইটেড হসপিটাল
প্রকাশ: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ২৩:২০ | আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ২৩:২০
কার্ডিয়াক সার্জারি মানে বুকের মাঝামাঝি কাটা এবং এই প্রক্রিয়া বহু বছর ধরে একটি বিশ্বস্ত এবং সুপ্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি। তবে এতে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে বেশ কিছুদিন সময় লাগে। কাজেই চেষ্টা চলছিল এই পদ্ধতিতে সময় ও জটিলতা কীভাবে কমানো যায়। তারই ধারাবাহিকতায় অন্যান্য সার্জারিতে এন্ডোস্কপি ও ল্যাপারোস্কপির সফল ব্যবহার থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে কার্ডিয়াক সার্জারিতে মিনিয়াম ইনভেসিভ পদ্ধতি ব্যবহার করার ভাবনা আসে। হার্ট সার্জারির সর্বশেষ এ উদ্ভাবনী পদ্ধতিতে বুকের মাঝ বরাবর না কেটে হার্ট সার্জারি করা হয়। যেখানে সার্জারি সংক্রান্ত জটিলতাগুলো কমে যায় এবং রোগী দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠে।
মিনিমাল ইনভেসিভ কার্ডিয়াক সার্জারি (MICS) কার্ডিওভাসকুলার সার্জারির ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। এ পদ্ধতি প্রথাগত সার্জারি পদ্ধতির বিকল্প হিসেবে চালু হয়েছে। এ পদ্ধতিতে হার্ট-লাংস মেশিন ব্যবহার না করে, পাজরের এক পাশ ছোট করে কেটে, বিটিং হার্টে অপারেশন অথবা ছোট করে কেটে হার্ট-লাংস মেশিন ব্যবহার করে হার্টের অপারেশন করা হয়।
মিনিমাল ইনভেসিভ কার্ডিয়াক সার্জারির বিবর্তন
হার্ট-লাংস মেশিন আবিষ্কারের আগে ১৯১০ সালে আলেক্সিস কেরেল (Alexis Carrel) করোনির সার্জারি প্রথম বর্ণনা করেন। পরবর্তীকালে ১৯৫৩ সালে জন গিবসন (John Gibson) হার্ট-লাংস মেশিন আবিষ্কার করেন, যা কার্ডিয়াক সার্জারিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দেয় এবং হার্টের অপারেশন সহজ করে দেয়। ১৯৯০ সালের মাঝামাঝি কসগ্রভ ও কন (Cosgrove and Coin) প্রথম মিনিমাম মাইট্রাল ভালভ সার্জারি করেন। কারপেনটিয়ার (Carpentier) ১৯৯৬ সালে প্রথম ভিডিওর সাহায্যে মিনি থোরাকোটমি দ্বারা মাইট্রাল ভালভের সার্জারি করেন। ১৯৯৮ সালে বিশ্বে প্রথম রোবোটিক ভালভ মেরামত করেন কারপেনটিয়ার ও মোহর (Carpentier and Moher) দা ভেনচি রোবোটিক সিস্টেমের মাধ্যমে। ১৯৯৬ সালে কসগ্রভ ও সাবিক (Cosgrove and Sabik) প্রথম মিনিমাম ইনভেসিভ অ্যাওটিক ভালভ সার্জারি করেন। ফ্রেডেরিকো বেনেডি (Frederico Benetti) ১৯৯৪ সালে প্রথম মিডক্যাব (MIDCAB) করোনি সার্জারি করেন। আমেরিকায় প্রথম এ সার্জারি শুরু হলেও পরবর্তীকালে দ্রুতগতিতে পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্ত যেমন: ইউরোপ, জাপান, চীন ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় তা ছড়িয়ে পড়ে।
মিনিমাল ইনভেসিভ কার্ডিয়াক সার্জারির জন্য রোগীর শারীরিক অবস্থা যেমন থাকা উচিত
সব রোগীর জন্য MICS উপযুক্ত নাও হতে পারে। এক্ষেত্রে অবশ্যই সার্জন বিচার-বিবেচনা করবেন, তবে মিনিমাল ইনভেসিভ কার্ডিয়াক সার্জারি করার জন্য রোগীর শারীরিক অবস্থা যেমন থাকা আবশ্যক :
ভালো ও স্বাভাবিক বক্ষপিঞ্জর
স্বাভাবিক ও সুস্থ ফিমোরাল ধমনী ও শিরা
স্বাভাবিক হৃৎপিণ্ডের আকার এবং কার্যক্ষমতা
স্বাভাবিক ফুসফুসের কার্যক্ষমতা
রোগমুক্ত মহাধমনী
করোনারি ধমনীর স্বাভাবিক আকার ও অবস্থান যাদের জন্য মিনিমাল ইনভেসিভ কার্ডিয়াক সার্জারি প্রযোজ্য নয়
কিছু কিছু রোগীর জন্য মিনিমাল ইনভেসিভ কার্ডিয়াক সার্জারি প্রযোজ্য নয়, সেগুলোও আমাদের জানা থাকা প্রয়োজন :
অস্বাভাবিক স্থূলতা ও বুকের অস্বাভাবিক আকার ও আকৃতি
পুনঃ কার্ডিয়াক এবং থোরাসিক সার্জারি করা রোগী
মহাধমনী ও ফিমোরাল ধমনীর অসুস্থতা
একের অধিক কার্ডিয়াক সার্জারি করা রোগী
মিনিমাল ইনভেসিভ কার্ডিয়াক সার্জারির জন্য বিশেষ প্রয়োজন
মিনিমাল ইনভেসিভ কার্ডিয়াক সার্জারি করার জন্য কিছু প্রস্তুতি প্রয়োজন, যেগুলো এই প্রক্রিয়ার সঠিকতা নিশ্চিত করতে পারে:
নিবেদিত ও দক্ষ টিম (সার্জন, এনেসথেটিক্স, পারফিউশনিস্ট, নার্স)
ট্রান্সইসোফেজিয়াল ইকো (TEE)
স্পেশাল যন্ত্রপাতি
ভিডিও মনিটর ও ক্যামেরা
মিনিমাল ইনভেসিভ কার্ডিয়াক সার্জারির সুবিধা
ট্রমা এবং ব্যথা কম: ছোট কাটার ফলে বুকের পেশি এবং টিস্যুতে কম আঘাত লাগে, ফলে সুস্থ হওয়ার সময় রোগীদের ব্যথা ও অস্বস্তি কম লাগে।
দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরা: এমআইসিএস করা রোগীরা প্রায়ই ওপেন-হার্ট সার্জারির তুলনায় দ্রুত স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরে যেতে পারে। তাই তাদের হাসপাতালে থাকা এবং সার্জারি-পরবর্তী খরচও কমে যায়।
সংক্রমণের হার কমে যাওয়া : এ প্রক্রিয়ায় ছিদ্র ছোট করে কাটার কারণে এবং অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলোর কম এক্সপোজার হয় বলে পোস্ট-অপারেটিভ সংক্রমণের ঝুঁকিও কম থাকে।
উন্নত কসমেটিক সুবিধা: এমআইসিএস ছোট ও কম দেখা যায় এমন দাগ ফেলে, ফলে রোগীরা সার্জারি-পরবর্তী দাগ নিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।
রক্তপাতের হার কম হওয়া: এমআইসিএস-এর সূক্ষ্ম সার্জারি প্রক্রিয়া এবং উন্নত সরঞ্জামের ব্যবহার সার্জারির সময় রক্তপাত কম করতে সাহায্য করে, ফলে রোগীকে রক্ত দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা কমে যায়।
পোস্ট অপারেটিভ জটিলতা হ্রাস : এমআইসিএস-এর অধীনে থাকা রোগীদের শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা এবং ইনফেকশনের মতো জটিলতা হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে, রোগী দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
মিনিমাল ইনভেসিভ কার্ডিয়াক সার্জারির কিছু চ্যালেঞ্জ
যদিও এমআইসিএস অনেক সুবিধাজনক একটি সার্জারি, তবুও এর কিছু চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যেমন:
প্রযুক্তিগত জটিলতা: এমআইসিএস পদ্ধতিতে ছোট ছিদ্রের মাধ্যমে নির্ভুল ও সূক্ষ্মভাবে কার্ডিয়াক সার্জারি করতে হয়, তাই এ সার্জারির জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা প্রয়োজন হয়।
সীমিত পরিসরে ব্যবহার: এর মাধ্যমে সব কার্ডিয়াক সমস্যার সমাধান করা যায় না। কোনো জটিল সমস্যার ক্ষেত্রে এখনও কনভেনশনাল ওপেন হার্ট সার্জারি করারও প্রয়োজন হতে পারে।
বিশেষ সরঞ্জাম ও অবকাঠামো: এমআইসিএস-এর জন্য বিশেষ সরঞ্জাম এবং সেটআপ প্রয়োজন, যা সব হাসপাতালে সহজে নাও পাওয়া যেতে পারে।
পারদর্শিতার অভাব: সার্জন এবং মেডিকেল টিমের এমআইসিএস প্রক্রিয়াতে দক্ষ হওয়ার জন্য অনেক সময়ের প্রয়োজন হয়। সার্জনরা পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত না হলে রোগীর জন্য সার্জারিটি ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
ইউনাইটেড হসপিটাল তার প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই সব ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে দেশের সেরা কার্ডিয়াক সেন্টারে পরিণত হয়েছে এবং দ্রুত কার্ডিয়াক চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করে আসছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, জরুরি বিভাগে প্রবেশ থেকে ক্যাথ ল্যাবে স্টেন্ট পরানো পর্যন্ত এই দক্ষ কার্ডিওলজি টিমের সময় লাগে মাত্র ৯০ মিনিট। উল্লেখ্য, ইউনাইটেড হসপিটাল আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবার একটি উজ্জ্বল উদাহরণ, যা সম্প্রতি জয়েন্ট কমিশন ইন্টারন্যাশনাল (জেসিআই) স্বীকৃতি পেয়েছে। এই হাসপাতালে প্রতিটি সার্জারির আগে কঠোরভাবে আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া ‘টাইম-আউট’ মেনে চলা হয়। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সঠিক রোগী, রোগীর সঠিক অপারেশনের স্থান এবং প্রক্রিয়াসহ অপারেশন-সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় আরেকবার নিশ্চিত করা হয়, যা সার্জারির যে কোনো ভুলের মাত্রাকে প্রায় শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসে।
ইউনাইটেড হসপিটাল তাদের প্রি-অপারেটিভ এবং পোস্ট-অপারেটিভ বিভাগেও সেবার মানের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য সমানভাবে নিবেদিত। কার্ডিয়াক সার্জারির ক্ষেত্রে অ্যানেস্থেশিয়ার ভূমিকাকে ছোট করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। সার্জারির আগে ও চলাকালীন সাধারণত অ্যানেস্থেশিয়া প্ল্যান অপরিবর্তিত থাকে, যা বাংলাদেশের জন্য গর্ব করার মতো কৃতিত্ব। লক্ষণীয় বিষয় হলো, ইউনাইটেড কার্ডিয়াক সেন্টারে অ্যানেস্থেশিয়া-সম্পর্কিত মৃত্যুর হারও শূন্য।
এই দুটি বিভাগ নিশ্চিত করে যে সমস্ত রোগী সুনির্দিষ্ট রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা পাচ্ছেন এবং সার্জারির আগে ও পরে সঠিক চিকিৎসা মান প্রদান করে রোগী দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠছে। সেবার মানের এই প্রতিশ্রুতি বিশেষ করে হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীদের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ হৃদরোগের ক্ষেত্রে সময়মতো চিকিৎসা নিশ্চিত করা একটি জীবন বাঁচিয়ে দিতে পারে।
সর্বোপরি এমআইসিএস স্বাস্থ্যসেবায় কার্ডিয়াক সার্জারির ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। এটি রোগীদের জন্য কম ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার পাশাপাশি রোগীকে দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আনতে সাহায্য করে। যদিও অনেকগুলো সুবিধার পাশাপাশি এই প্রক্রিয়াটিতে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে, তবে চলমান যুগের নিত্যনতুন উদ্ভাবনগুলো এমআইসিএস-এর সক্ষমতা এবং সহজলভ্যতা আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।