ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

ফুটপাতে দোকান উচ্ছেদের ‘খেলা’য় বাড়ে চাঁদার হার

ফুটপাতে দোকান উচ্ছেদের ‘খেলা’য় বাড়ে চাঁদার হার

কোলাজ

 আব্দুল হামিদ

প্রকাশ: ০৪ মে ২০২৪ | ০০:৪৩ | আপডেট: ০৪ মে ২০২৪ | ০৬:৪৭

ফুটপাত থেকে দোকান উচ্ছেদে হঠাৎ অভিযান শুরু হলেই বুঝতে পারি– এলাকায় কোনো পুলিশ কর্মকর্তা বদলি হয়ে এসেছেন, অথবা কোনো রাজনৈতিক নেতা পদ-পদবি পেয়েছেন। তাই হকারদের সঙ্গে দেনদরবার করতে ফুটপাত উচ্ছেদের আয়োজন চলছে। 

কথাগুলো বলছিলেন রাজধানীর মিরপুর-১ শাহ আলী মার্কেটের সামনের ফুটপাতের দোকানি মো. সুমন। বেশ কয়েক বছর তিনি সেখানে ব্যবসা করছেন। সুমন জানান, দোকান বসানোর সময় এককালীন ৩০ হাজার টাকা দিয়েছেন। আগে নানা খাতে দিনে ৫০০ টাকা চাঁদা দিয়ে ব্যবসা করতেন। কয়েক দিন আগে তাঁর দোকান উঠিয়ে দেওয়া হয়। এর পর থেকে ১০০ টাকা বাড়িয়ে দৈনিক ৬০০ টাকা দিয়ে দোকান চালাচ্ছেন তিনি।

শুধু মিরপুর-১ নয়, পুরো রাজধানীতে ফুটপাতে দোকান উচ্ছেদ ও বসানোর এমন ‘খেলা’ চলছে। এতে চাঁদার হার বাড়ে। ঢাকায় যারা বিভিন্ন ফুটপাত দখল করেছেন বা ফুটপাত দখল করে বিক্রি করেছেন, গত সোমবার তাদের তালিকা দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। আদালত অপর এক আদেশে দখলকারীদের বিরুদ্ধে কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তাও জানাতে বলেছেন।

গত সংসদ নির্বাচনের আগে দুই সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরদের নিয়ে সভা করেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমান। সেখানে তিনি ফুটপাত দখলমুক্ত করতে কাউন্সিলরদের সহযোগিতা চান। সেই সভায় অংশ নেওয়া ডিএমপির এক কর্মকর্তা বলেন, কাউন্সিলররা কথা দিয়েছিলেন, নির্বাচনের পর নিজ নিজ এলাকার ফুটপাত দখলমুক্ত করতে পুলিশকে সহযোগিতা করবেন। কিন্তু এখন পুলিশ উঠিয়ে দিলেও তাদের শক্তিতেই আবার ফুটপাত দখল হচ্ছে। অনেক স্থানে অসাধু পুলিশ সদস্যদের ‘ম্যানেজ করে’ এটা করা হচ্ছে। যুগ যুগ ধরে ঢাকায় ফুটপাতে দোকান বসানো নিয়ে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য চলে আসছে। 

এই বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপ সক্রিয় থাকে। এ নিয়ে হত্যার ঘটনাও ঘটে। মতিঝিল এলাকায় ফুটপাত ও বাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ২০২২ সালে খুন হন আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু। রাজনৈতিক নেতারা পুলিশ প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করেন। আর সন্ত্রাসীরা তাদের লোক দিয়ে টাকা তোলে। পরে এসব টাকা চলে যায় থানা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতাদের পকেটে। 

হকার সংগঠনগুলোর হিসাব বলছে, রাজধানীর ফুটপাতে ২ থেকে আড়াই লাখ হকার রয়েছেন। দুই ঈদের সময় আরও ৫০ হাজার হকার বাড়ে। দিনে ফুটপাতে ৯ কোটি টাকা চাঁদা তোলা হয়। বছরে তোলা হচ্ছে প্রায় ৩ হাজার ৩৩০ কোটি টাকা। ফুটপাত থেকে যারা লাইনম্যান হিসেবে টাকা তোলেন, তাদের অধিকাংশই অনিবন্ধিত সাত হকার্স সংগঠনের লোক। তারা থানা পুলিশ ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। 

হকার ও নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মতিঝিল সোনালী ব্যাংক ও খাবারদাবার হোটেলের সামনের ফুটপাত জাতীয় শ্রমিক লীগের মতিঝিল থানা কমিটির এক নেতার নিয়ন্ত্রণে। এখানে চাঁদা তোলে লাইনম্যান মকবুল, সাইদ, ফারুক, জুয়াড়ি সালাম, রহিম ও অপু।  বায়তুল মোকাররম মসজিদের পূর্ব গেট থেকে ভিআইপি রোড পর্যন্ত পল্টন থানা পুলিশের সোর্স পরিচয় দিয়ে চাঁদা তোলে ইয়াবা কারবারি দুলাল ওরফে মাদারীপুরের দুলাল, তার ছেলে শুভ, ছোট ভাই শরীফ, যুবলীগ কর্মী জসিম, সেকেন্দার হায়াত, আরিফ চৌধুরী ও ইব্রাহিম। পশ্চিম পাশে চাঁদা তোলেন হকার্স সংগ্রাম পরিষদের নেতা চাটগাইয়া হারুন, খোকন মজুমদার, মিজান, মোস্তফা ও জাহাঙ্গীর। উত্তর গেটে চাঁদা তোলেন, সাজু, মন্টু, কালানুর, আব্দুল্লাহ খোকন, সবুজ ও ডুম্বা রহিম। দক্ষিণ গেটে খলিল, তাজু, নবী ও আনোয়ার এবং বায়তুল মোকাররম লিংক রোডে চাঁদা তোলেন কোটন ও ফারুক।

দৈনিক বাংলা থেকে ফকিরাপুল পর্যন্ত দোকানে চাঁদা তোলেন পুলিশের সোর্স সাকিব ও খোকন মজুমদার। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সামনের ফুটপাতে চাঁদা তোলেন হকার্স ইউনিয়নের আহ্বায়ক আবুল হাসেম কবির, তার সহযোগী হযরত আলী, শাহাবুদ্দিন, হানিফ, আজিজুল, ওসমান ও ভুট্টো। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের ২ নম্বর গেটে ও ভাসানী স্টেডিয়ামের পাশে আলী, গফুর, জুয়েল ও হকার্স লিগের নেতা কামাল সিদ্দিকী চাঁদা তোলেন। কমিউনিস্ট পার্টির অফিসের সামনে হকার্স সমন্বয় পরিষদের সভাপতি আবুল হোসাইন, হানিফ, কামাল এবং পল্টন মোড়ে বিল্লাল ও টিটু চাঁদা তোলেন।

মতিঝিল শাপলা চত্বর থেকে আরামবাগ হয়ে আইডিয়াল পর্যন্ত চাঁদা তোলেন পুলিশের সোর্স বহু মামলার আসামি সাইফুল মোল্লা, তার দুই ছেলে শিবলু ও হোসাইন, মোহর আলী, শাহ জাহান, ১০ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি সাইদ রেজা বাচ্চু, যুবলীগ নেতা সাগর ও সনি চাঁদা তোলেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের উত্তর পাশে ইয়াবা হারুন ওরফে শহিদ এবং জয়কালী মন্দির এলাকায় মহসিন ও তার স্ত্রী রিতা বেগম চাঁদা তোলেন। ফার্মগেট এলাকায় চাঁদা তোলেন শাহ আলম, তাজু, সেলিম চুন্নু ও আলামিন। নিউমার্কেট এলাকায় ইব্রাহিম ইবু, সাত্তার মোল্লা, নুর ইসলাম, জলিল, সিরাজ ও ছৈইয়া চাঁদা তোলেন।

যাত্রাবাড়ী মোড়ে চাঁদা তোলেন সোনামিয়া ও তোরাব আলী চক্রের সদস্যরা। এদিকে গুলিস্তান হানিফ ফ্লাইওভারের নিচে জুতার ফুটে চাঁদাবাজি করেন লম্বা বাবুল, ছালেহ, রজ্জব, ভোলা ও ওসমান। আর ওয়ারী সিলভারডেল প্রিপারেটরি অ্যান্ড গার্লস হাই স্কুলের সামনে ফুটপাতে হকার বসিয়ে চাঁদাবাজি করেন ওই স্কুলের নিরাপত্তাকর্মী উত্তম। তার এ কাজে সহযোগিতা করেন স্কুলের গভর্নিং বডির এক সদস্য। মিরপুর-১ নম্বর শাহ আলী মাজার এলাকায় পুলিশের হয়ে টাকা তোলেন কবির, জুয়েল, হান্নান, আল আমিন ও মামুন। আর পল্লবী এলাকায় চাঁদা তোলেন ছিন্নমূল হকার্স সমিতির সভাপতি কামাল সিদ্দিকী ও তাঁর সহযোগী জামাল, মাওরা বিহারি ও মিন্টু।

বাংলাদেশ হকার্স ফেডারেশনের সভাপতি এম এ কাশেম সমকালকে বলেন, চাঁদা ছাড়া ফুটপাতে ব্যবসা করা যায় না। স্থানীয় কাউন্সিলর, পুলিশ ও সন্ত্রাসীরা এই টাকার ভাগ পায়। চাঁদা না দিলে হকারদের ওপর হামলা করে।

শাহ আলী থানার ওসি মওদুদ হাওলাদার বলেন, মিরপুর-১ এলাকায় রাস্তার ওপর থেকে সব হকার্স উচ্ছেদ করা হয়েছে। গত ২৪ ও ২৫ এপ্রিল অভিযান চালিয়ে ৩৫ জনকে আটকও করা হয়।

উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম বলেন, ফুটপাত থেকে নিয়মিত হকার উচ্ছেদ করা হয়। কিন্তু তারা এসে আবার বসে। আমরা কাজ করছি, যাতে সবসময় ফুটপাত মুক্ত থাকে।

উচ্ছেদের পর কাউন্সিলররা টাকা খেয়ে হকার বসান– এমন অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, কোনো কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্স) ড. খ. মহিদ উদ্দিন বলেন, ফুটপাত থেকে হকার উচ্ছেদে অভিযান চলছে। কোনো পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আরও পড়ুন

×