‘আমার ঘর আমার আশ্রয়’
উপকূলে জলবায়ুসহিষ্ণু বাড়িতে শান্তির ঠাঁই

ছবি: সমকাল
জাহিদুর রহমান, মোংলা (বাগেরহাট) থেকে ফিরে
প্রকাশ: ২০ জুন ২০২৪ | ১৩:০৩
ঘূর্ণিঝড় রিমাল যখন বাংলাদেশের উপকূলে ধেয়ে আসছে, তখন বাগেরহাটের মোংলার সোনাইলতলা ইউনিয়নের জয়খা গ্রামের শ্বতী বারোই ছিলেন আতঙ্কে। দুই মাসের নবজাতক নিয়ে কোথায় আশ্রয় নেবেন? পাঁচ কিলোমিটার দূরে সরকারি একটি আশ্রয়কেন্দ্র থাকলেও তা জরাজীর্ণ। নারী-শিশুর জন্য নেই আলাদা ব্যবস্থা। পরে গ্রামের এক প্রতিবেশীর সহায়তায় শ্বতী বারোই আশ্রয় নেন বাড়ির পাশের জলবায়ুসহিষ্ণু বাড়িতে। ঘূর্ণিঝড় যখন বাইরে তাণ্ডব চালাচ্ছে তখন তিনি সন্তান নিয়ে নিরাপদেই ছিলেন। দোতলা বাড়ির দুই কক্ষ নারী-পুরুষের জন্য আলাদা। নিচতলায় ছিল গবাদি পশু ও সম্পদ রাখার জায়গা। আছে সৌরবিদ্যুৎ ও নিরাপদ পানির ব্যবস্থা। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন শৌচাগারের পাশাপাশি রান্নার চুলা।
শ্বতী বারোই ছাড়াও জলবায়ুসহিষ্ণু এ বাড়িতে আশ্রয় নেন গ্রামের অনেকে। জয়খা গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল হক বলেন, জলবায়ুসহিষ্ণু এ বাড়ি সাধারণ ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রের মতো নয়। দোতলা বাড়িটি সারাবছর প্রস্তুত থাকে।
শুধু মোংলার জয়খা গ্রাম নয়; পটুয়াখালী, ভোলা, বরগুনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরায় এ রকম ৩৬টি জলবায়ুসহিষ্ণু বাড়িতে ঘূর্ণিঝড় রিমালের সময় ১৮৩ পরিবারের এক হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছিলেন। জলবায়ুসহিষ্ণু বাড়িযুক্ত সাইক্লোন শেল্টারের মডেল তৈরি করেছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক। কয়েক দশকের অভিজ্ঞতা, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মতামত বিবেচনায় নিয়ে ২০১৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ব্র্যাকের নিজস্ব অর্থায়নে সাশ্রয়ী খরচে ৩৫টি বাড়ি তৈরি করা হয়। পরে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং ইউনেপের (ইউনাইটেড নেশন্স এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম) এনডিসি (ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশন) অ্যাকশন প্রজেক্টের বাস্তবায়নে অ্যাডাপ্টেশন এনটিআই (ন্যাশনাল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউশন) হিসেবে মোংলা এবং মহেশখালীতে স্বল্প খরচে জলবায়ুসহিষ্ণু বাড়ি নির্মাণেও সহযোগিতা করছে ব্র্যাক। এসব বাড়ি আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা না হলেও এবারের ঘূর্ণিঝড়ে স্থানীয় মানুষ সেগুলো ব্যবহার করেছেন।
মোংলার জলবায়ুসহিষ্ণু বাড়ি ঘুরে দেখা যায়, ৭০৮ বর্গফুটের এ ধরনের বাড়ির নির্মাণ খরচ ধরা হয়েছে ১৩ থেকে ১৪ লাখ টাকা। গত ১০০ বছরের জলোচ্ছ্বাসের তথ্য বিবেচনায় নিয়ে এসব বাড়ির নকশা করা হয়েছে। স্বাভাবিক সময়ে যেমন বাড়িতে একটি পরিবার বাস করতে পারবে; দুর্যোগের সময় তেমনি প্রতিবেশীরা আশ্রয় নিতে পারবে। আশ্রয়কেন্দ্রটি ব্যক্তিমালিকানাধীন হলেও শর্ত আছে– দুর্যোগের সময় প্রতিবেশীকে বাড়িতে আশ্রয় দিতে হবে।
মোংলার জয়খা গ্রামের বাড়ির মালিক প্রভা মৃধা জানান, তাঁর জমিতেই বাড়িটি ব্র্যাক বানিয়েছে। তিনি সারাবছর বাড়িটি দেখভাল করেন। গ্রামের সব মানুষ বাড়িটিকে নিজের মনে করে। তিনি বলেন, বাড়ির ভেতরে পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থা যেমন বন্ধু চুলা, সৌরবিদ্যুৎ, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা আছে। বাড়ির নিচতলা খালি। সেখানে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, শৌচাগার ও গবাদি পশু রাখা যায়। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সুবিধার জন্য বিশেষ ব্যবস্থাও আছে এখানে। দ্বিতীয় তলায় দুটি ঘর, যাতে দুর্যোগের সময় নারী-পুরুষ আলাদা স্বাচ্ছন্দ্যে আশ্রয় নিতে পারে। ঘরগুলোতে আছে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস।
মোংলায় ১১৯ সরকারি আশ্রয়কেন্দ্র আছে। সেগুলো নদী এলাকা থেকে দুই-তিন কিলোমিটার দূরে। মোংলার দক্ষিণ কাইনমারীর রত্না এমিলিয়া শেখ বলেন, ‘গ্রামে কোনো আশ্রয়কেন্দ্র নেই। দুর্যোগের সময় আমরা গির্জা আর মিশনারি স্কুলে আশ্রয় নিই। সেই আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে দেড় ঘণ্টা সময় লাগে। ব্র্যাকের জলবায়ুসহিষ্ণু বাড়ি প্রতি গ্রামেই থাকা উচিত।’
ব্র্যাকের ক্লাইমেট চেঞ্জ প্রোগ্রাম, আরবান ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম এবং ডিজাস্টার রিস্ক ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রামের ডিরেক্টর ড. মো. লিয়াকত আলী বলেন, ‘আমরা প্রত্যক্ষভাবে দেখেছি, এ বছর ঘূর্ণিঝড়ে মোংলার জয়খা গ্রামের বাড়িটি বাতাসেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, পানিও তেমন ওঠেনি। আশপাশের প্রতিবেশীরা নিরাপদে আশ্রয় নিয়েছে। এ ধরনের অবকাঠামো বা জলবায়ুসহিষ্ণু বাড়ি আরও বেশি বেশি তৈরি করা দরকার। তাহলে আগামী দিনের দুর্যোগে মানুষের কষ্ট লাঘব হবে।’
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী সমকালকে বলেন, ব্র্যাকের জলবায়ুসহিষ্ণু বাড়ি একটি ভালো মডেল। এমন মডেল সারাদেশের প্রতিটি গ্রামে ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা আছে। আমরা আপাতত ৯০০টি জলবায়ু-সহনশীল ঘর মেরামত করব। ৫০০ পরিবারের জন্য রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং সিস্টেম স্থাপন করা হবে। বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ৩০টি সোলার ন্যানো-গ্রিড এবং ২০টি ক্ষুদ্র দুর্যোগ আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে।
- বিষয় :
- ঘূর্ণিঝড় রিমাল
- বাগেরহাট
- জলবায়ু ঝুঁকি