পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধকরণ
কঠোর অভিযানের প্রস্তুতি, তবু চলছে কারখানা

পুরান ঢাকার পলিথিন কারখানা। ছবি: সমকাল
জাহিদুর রহমান
প্রকাশ: ৩১ অক্টোবর ২০২৪ | ০৫:৫৪ | আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০২৪ | ১৩:০৬
পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর পলিথিন বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। মাটি ও মানুষের এ শত্রুর বিরুদ্ধে আগামীকাল শুক্রবার থেকে চলবে অভিযান। সারাদেশে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের নেতৃত্বে বাস্তবায়নাধীন কর্মসূচির লক্ষ্যবস্তু করা হবে বাজার ও কারখানা।
এ জাতীয় ব্যাগ কারও কাছে পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্টদের শাস্তির আওতায় আনা হবে। তবে এমন খবরেও দেদার তৈরি হচ্ছে পলিথিন। অন্যদিকে কর্মহীন হওয়ার আশঙ্কা করছেন এসব কারখানার মালিক ও শ্রমিকরা। সমালোচনা রয়েছে বিকল্প ব্যবস্থাসহ নানা বিষয়ে প্রস্তুতির ঘাটতি নিয়েও।
২০০২ সালে সরকার আইন করে সাধারণ পলিথিনের উৎপাদন, বিপণন ও বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধ করে। সেই থেকে দুই দশক পেরিয়ে গেলেও আইনটির বাস্তবায়ন হয়নি। অতি ব্যবহারের কারণে এটি পরিবেশের জন্য দানবে পরিণত হয়েছে। হুমকির মুখে প্রাণ-প্রকৃতি। পলিথিনের স্তূপ নালায় আটকে থাকায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে পানি নিষ্কাশনে, নিয়মিত ভুগতে হচ্ছে জলাবদ্ধতায়। এমন প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর পরিবেশ ও বন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান আইনটি বাস্তবায়নে কঠোর হওয়ার ঘোষণা দেন। এর অংশ হিসেবে গত ১ অক্টোবর সুপারশপে এ জাতীয় ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। ১ নভেম্বর থেকে অন্যান্য বাজারেও পলিথিন নিষিদ্ধের আইন কার্যকর করা হচ্ছে। অভিযান দেখভাল করার জন্য ইতোমধ্যে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটিও গঠন করেছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়।
উৎপাদন থেমে নেই
বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় তিন হাজার কারখানায় প্লাস্টিক ও পলিথিন তৈরি হয়। এসব প্রতিষ্ঠানে দিনে ১ কোটি ৪০ লাখ ব্যাগ উৎপাদন হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কারখানা রয়েছে রাজধানীর পুরান ঢাকায়। ইসলামবাগের বাগানবাড়ি রোডে প্রথম বিল্ডিংয়ের দ্বিতীয় দরজার দ্বিতীয় তলায় গিয়ে দেখা যায়, একটি কারখানায় পলিথিন উৎপাদন করছেন জসিম। ভবনের তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় আরও দুটি কারখানা চালান ওমর ফারুক। সূর্যমতির গলিতেও রয়েছে একাধিক কারখানা। গলির প্রথম ভবনের নিচতলায় মিন্টুর কারখানা, দ্বিতীয় তলায় জসিম ও শাকিলের পলিথিনের গুদাম। পাশের ভবনের নিচতলায় বাচ্চুর পলিথিন কারখানা, দ্বিতীয় তলায় আতিকের। ইসলামবাগ ক্লাবঘাট রোডে শাহীন বিরিয়ানির উল্টো পাশের গলিতে রয়েছে অন্তত পাঁচটি প্রতিষ্ঠান। গলির ডানদিকের দ্বিতীয় ভবনের নিচতলায় জাহাঙ্গীরের, দোতলায় কামালের কারখানা ছাড়াও শেষ প্রান্তে আছে জয়নালের কারখানা।
আগে যেখানে চামড়ার কারখানা ছিল, সেটি হয়ে উঠেছে পলিথিন কারখানা। পোস্তা ৬৯ গলির বাগ-এ-জান্নাত জামে মসজিদের সামনে এক পলিথিনের কারখানায় ব্যবস্থাপকের সঙ্গে কথা বলার জন্য গেলে তাদের কার্যালয়ে ঢুকতে বাধা দেন ভেতরে থাকা লোকজন। বাইরে থেকে দেখা যায়, কারখানার ভেতরে মেশিনে পলিথিন উৎপাদন চলছিল।
পুরান ঢাকার ওয়াটার ওয়ার্কস রোডের ৩৩ নম্বর ভবনের সামনে দাঁড়াতেই একটি স্টিলের দরজা চোখে পড়ে। ভেতরে ঢুকতেই দেখা গেল পলিথিন তৈরির কাঁচামালের স্তূপ।
চকবাজারের পূর্ব ইসলামবাগের মাওড়ার টেকে (৪৭/ডি) গেলে অসংখ্য ছোট ছোট গলি চোখে পড়ে। যে কোনো গলি দিয়ে ঢুকলেই দেখা যায়, বিভিন্ন বাসার নিচ তলায় পলিথিনের কারখানা। কেউ রাখঢাকও করছে না। তবে কোনো কারখানার সামনে সাইনবোর্ড নেই। ক্রেতা সেজে একটি কারখানায় ঢোকার পর এর মালিক সবুজ মিয়া বলেন, ‘পলিথিন বিক্রি হয় বস্তা হিসেবে। এক বস্তায় ২৫ কেজি, দাম বত্রিশশো টাকা, মান আরেকটু ভালো হলে ছত্রিশ শ।’
একটি-দুটি নয়, এ রকম অনেক কারখানা গড়ে উঠেছে পুরান ঢাকার বিভিন্ন স্থানে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেবীদাস ঘাট, চকবাজার ইসলামী উচ্চ বিদ্যালয়ের আশপাশ, চকবাজার বড় কাটরা, আরমানীটোলা, ইসলামবাগ, কামরাঙ্গীরচরসহ বিভিন্ন স্পটে দিনরাত চলে পলিথিন তৈরির কাজ। এসব এলাকায় পলিথিন তৈরির সরঞ্জাম বিক্রির জন্যও রয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ প্লাস্টিক প্যাকেজিং, রোল ম্যানুফ্যাকচারার্স ওনার্স অ্যান্ড ট্রেড অ্যাসোসিয়েশনের আওতায় দেড় শতাধিক দোকান থাকলেও চকবাজারের পেয়ারা মার্কেট, লুতফর নাহার ম্যানশন, আবুল হোসেন মার্কেট, মৌলভীবাজার মাংসপট্টি মসজিদ গলি, সালাম মার্কেট, মাওলানা মার্কেট, শামসুদ্দিন প্লাজা ও এসরার ম্যানশনে তিন শতাধিক পাইকারি দোকানে প্রকাশ্যে বেচাকেনা চলছে নিষিদ্ধ পলিথিনের। কামরাঙ্গীরচর থানাসংলগ্ন হুজুরপাড়া এলাকায় আছে প্রায় ১০টি কারখানা। এ ছাড়া কামরাঙ্গীরচর এলাকার ১৩টি মহল্লার মধ্যে রয়েছে আরও ১০ থেকে ১২টি কারখানা। লালবাগ, ইসলামবাগ, জয়নাগ রোড, কামালবাগ ও এর আশপাশে রয়েছে অর্ধশত কারখানা। চকবাজার, সোয়ারীঘাট ও দেবীদাস ঘাটে রয়েছে ১৫ থেকে ২০টি কারখানা। মৌলভীবাজার, বেগমবাজার ও মুকিমবাজারে রয়েছে ২০-২৫টি কারখানা। চকবাজার, খাজে দেওয়ান আবাসিক এলাকার প্রথম ও দ্বিতীয় লেনে রয়েছে প্রায় ১০টি কারখানা। কোতোয়ালি সূত্রাপুর এলাকায় রয়েছে প্রায় অর্ধশত। ডেমরা, যাত্রাবাড়ী থেকে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা পর্যন্ত বুড়িগঙ্গা নদীর পাড় ঘেঁষে রয়েছে শতাধিক পলিথিন কারখানা।
ঢাকার পলিথিন ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে আছে একাধিক প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। বাজারজাতকরণে রয়েছে ‘পরিবহন সিন্ডিকেট’। এই সিন্ডিকেট ‘জরুরি রপ্তানি কাজে নিয়োজিত’ ট্রাকে করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিষাক্ত পলিথিন পৌঁছে দেয়। বর্তমানে রপ্তানিযোগ্য কিছু পণ্য, প্যাকেজিং, নার্সারির চারা, রেণু পোনা পরিবহন ও মাশরুম চাষের জন্য পলিথিন উৎপাদনের ছাড়পত্র নিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা পলিথিন ব্যাগ তৈরি করছেন।
পুরান ঢাকার পলিথিন কারখানার মালিক-শ্রমিকদের মধ্যে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন জানান, মাঝে মধ্যে প্রশাসন অভিযান চালায়। তখন তাদের ম্যানেজ করেন হাজী আমির নামে এক ব্যক্তি। কারখানাভেদে তাঁকে নিয়মিত টাকা দিতে হয়। ছোট মেশিনের জন্য সাড়ে ৪ হাজার আর বড় মেশিনের জন্য দিতে হয় ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা। আবার যেসব কারখানায় শ্রমিক বেশি, তাদের জন্য আরেক রেট।
পলিথিন কারখানার সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদের কী হবে
উৎপাদনকারীরা বলছেন, পলিথিন উৎপাদন বন্ধ করা হলে এ ব্যবসায় জড়িত লাখ লাখ মানুষ বেকার হয়ে পড়বে। নিম্ন আয়ের অসংখ্য মানুষকে মানবেতর জীবনযাপন করতে হবে। পুরান ঢাকার ভাই ভাই পলিথিন কারখানার পরিচালক অনিক বলেন, ‘আমার কারখানায় ২৫ জন শ্রমিক-কর্মচারী আছেন। আকস্মিক কারখানা বন্ধ হলে তাদের সংসার চলবে কীভাবে। এ ছাড়া কারখানায় মোটা অঙ্কের বিনিয়োগ রয়েছে। পলিথিন নিষিদ্ধ হলে এসব মেশিনারিজের কী হবে– তাও সরকারের ভাবা উচিত।’
সাকিব পলি ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডের পরিচালক সাজিদ আজাদ বলেন, এ খাতে হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ। উৎপাদন, পরিবহন ও বিপণনের সঙ্গে কয়েক লাখ শ্রমিক-কর্মচারীর জীবিকা জড়িত। কোনো ধরনের বিকল্প ব্যবস্থা না করে পলিথিন কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হলে শ্রমিক-কর্মচারীদের পাশাপাশি মালিকরাও পথে বসবে।
বিকল্প ব্যবস্থা কী
পলিথিনের ব্যাগের বিকল্প ব্যবস্থার জন্য নানা উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশন ছাড়াও ২০টি প্রতিষ্ঠান বিকল্প ব্যাগের জোগান বাড়াতে কাজ করছে বলে দাবি করা হচ্ছে। মন্ত্রণালয়-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিকল্প ব্যাগের কোনো ঘাটতি হবে না। ইতোমধ্যে বিভিন্ন কাঁচাবাজারে প্রচার অভিযান চালিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা হয়েছে, বিতরণ করা হয়েছে বিকল্প হিসেবে পরিবেশবান্ধব ব্যাগ। অন্যদিকে বিকল্প হিসেবে ভিন্নধর্মী ও সৃজনশীল উদ্যোগ যেমন পাটের কাপড়ের ব্যাগ, মোমের আবরণ দেওয়া কাগজ, মোটা ব্রাউন পেপার, টিনের ঝুড়ির কথা বলেছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পরিবেশ অনুবিভাগ) ফাহমিদা খানম।
বিকল্প ব্যবস্থার পাশাপাশি কঠোর আইনের প্রয়োগের কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সহসভাপতি অধ্যাপক শহীদুল ইসলাম। তিনি বলেন, স্থায়ী পরিবর্তন আনতে চাইলে শুরুতে চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে। তবে আইনের প্রয়োগ থাকলে মানুষ বাজারে নিজেই বিকল্প নিয়ে যাবে। এ ছাড়া প্লাস্টিকের সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেও ক্ষতি কমানো সম্ভব।
কবে আসবে পাটের সোনালি ব্যাগ
২০১৫ সালে পাটের পলিথিন ব্যাগ উদ্ভাবনের কথা জানিয়ে আলোড়ন তোলেন বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা ড. মোবারক আহমেদ খান। তাঁকে স্বর্ণপদকও দেয় সরকার। পাট থেকে ‘সেলুলোজ’ সংগ্রহ করে তা দিয়ে সবুজ ব্যাগ তথা পরিবেশবান্ধব ব্যাগ তৈরি করা হয়। এটি দেখতে সাধারণ পলিথিনের মতোই, তবে পচনশীল। এটি বাজারজাত করতে ২০১৮ সালে পাইলট প্রকল্প নেওয়া হলেও এখনও তা বাজারে আসেনি।
সবুজ ব্যাগ বাজারে আসতে কতদিন লাগবে জানতে চাইলে ড. মোবারক বলেন, ‘এটি সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয়। সরকার চাইলে দ্রুত বাণিজ্যিক উৎপাদনের ব্যবস্থা করতে পারে। পলিথিনের বিকল্প বাজারে না দিতে পারলে আইন কার্যকর করা কঠিন। তবে আমরা প্রস্তুত আছি। এখন প্রতি মিনিটে ৬০টি ব্যাগ তৈরি করা যায়। প্রতিটি ব্যাগের দাম পড়ছে পাঁচ টাকার মতো। বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করলে দাম অনেক কমে আসবে।’
শাস্তির বিধান কী
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (সংশোধন-২০০২) অনুযায়ী, পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার কথা ভেবে সরকার পলিথিন ব্যাগ বিক্রি ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। এই আইনে পলিথিন উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের সর্বনিম্ন শাস্তি ১০ হাজার টাকা জরিমানাসহ ৬ মাস সশ্রম কারাদণ্ড এবং পলিথিন ব্যবহারকারীকে তাৎক্ষণিকভাবে ৫০০ টাকা জরিমানা করার বিধান রয়েছে।
বাজার মনিটরিং ও বিকল্প– দুটিকেই গুরুত্ব দিয়ে উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়া হাসান বলেন, আগেও পলিথিন বন্ধের উদ্যোগ অনেকখানি সফল হয়েছিল, শুধু বাজার মনিটরিংয়ের কারণে। পলিথিনের বিকল্প নিয়েও কাজ চলছে। তবে বাংলাদেশে সব সময়ই পলিথিনের সুস্পষ্ট বিকল্প ছিল। এখন পাট, কাপড় ও কাগজকে বিকল্প হিসেবে রাখা হয়েছে।
- বিষয় :
- পলিথিন
- নিষেধাজ্ঞা
- পরিবেশ
- অভিযান
- পাট