ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

বিজয়ের মাস

আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিতে দুর্নিবার বাংলাদেশ

আন্তর্জাতিক  স্বীকৃতিতে দুর্নিবার বাংলাদেশ

প্রতীকী ছবি

তুহিন তৌহিদ

প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:৩৭ | আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১০:০০

কোনো অন্তর্মুখী সৃষ্টিশীল ব্যক্তি যদি বলেন, তাঁর কোনো স্বীকৃতির প্রয়োজন নেই, তবে সেটা চলে। স্বীকৃতি ছাড়াও ব্যক্তি তাঁর প্রাত্যহিক কল্যাণমূলক কাজ চালিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু স্বীকৃতি ছাড়া রাষ্ট্রের চলে না। রাষ্ট্রের প্রয়োজন জনগণের স্বীকৃতি, বিশ্বের স্বীকৃতি। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি রাষ্ট্রকে পূর্ণতা এনে দেয়। 

আমরা বাংলাদেশকে স্বাধীন ঘোষণা করেছিলাম ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ। জনতার স্বীকৃতি ছিল, একাত্মতা ছিল। কিন্তু ৯ মাস পর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া শুরু হলে আসে পূর্ণতা।  ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় লাভ করে বাংলার মানুষ। এর ১০ দিন আগ থেকেই আসতে শুরু করেছিল বৈশ্বিক স্বীকৃতি। ৬ ডিসেম্বর ভারত ও ভুটানের কাছ থেকে স্বাধীন রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেয়েছিল বাংলাদেশ। এর পর আসতে থাকে একের পর এক স্বীকৃতি। যুদ্ধ চলাকালে যেসব দেশ বাংলদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে ছিল, পর্যায়ক্রমে তারাও স্বীকৃতি দিয়েছে এবং উন্নয়ন সহযোগী হতে চেয়েছে।

৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হওয়ার পর বিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠন ছাড়াও তৎকালীন সরকারের সামনে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। নানা বাধাবিপত্তির পর স্বাধীন হওয়ার মাত্র চার বছরের মধ্যে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র হয়। সেই সঙ্গে শতাধিক দেশের স্বীকৃতি আদায় করে নেয়। মুক্তিযুদ্ধে এ দেশের মানুষের অবিনাশী আত্মত্যাগই এ অর্জনের পেছনে কাজ করেছে রসদ হিসেবে।

ইংরেজি শব্দ ‘রিকগনিশন’-এর আভিধানিক অর্থ এ ‘স্বীকৃতি’। কোনো দেশ যখন আরেকটি নতুন দেশকে ‘স্বাধীন’ ও ‘সার্বভৌম’ বলে মেনে নেয়, তখন তারা সেটিকে ‘রিকগনাইজ’ করে, অর্থাৎ ‘স্বীকৃতি দেয়’। এর মাধ্যমে ওই দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য ও কূটনৈতিক সম্পর্ক সৃষ্টির সম্মতিও প্রকাশ পায়। এ কারণে কূটনৈতিক বিচারে ‘রাষ্ট্রের স্বীকৃতি’র অর্থ অনেকটাই ব্যাপক।

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে যখন একের পর এক এলাকা মুক্ত করে চলেছেন বীর যোদ্ধারা, তখন ৬ ডিসেম্বর সকালে লোকসভায় ভাষণে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেন। স্বীকৃতি দিয়ে তারবার্তা পাঠায় ভুটান। কলকাতায় বাংলাদেশ মিশনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। তখন মিশনের প্রধান ছিলেন হোসেন আলী। তিনিই পতাকা উত্তোলন করেন। 

বিজয়ের পরের মাসে, অর্থাৎ ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে বিশ্বের অনেক দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। ওই বছরের ১২ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির কথা জানায় পোল্যান্ড ও বুলগেরিয়া। ১৩ জানুয়ারি প্রতিবেশী মিয়ানমারের স্বীকৃতি পায় বাংলাদেশ। আরেক প্রতিবেশী নেপাল স্বীকৃতি দিয়েছে ১৬ জানুয়ারি। বার্বাডোস ২০ জানুয়ারি ও যুগোস্লাভিয়া ২২ জানুয়ারি স্বীকৃতি দেয়। পরাশক্তিগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের স্বীকৃতি পায় ২৪ জানুয়ারি। ২৬ জানুয়ারি একই দিনে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড স্বীকৃতি দিয়েছে।

১৯৭২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ছিল বাংলাদেশে জন্য বিশেষ দিন। এদিন বাংলাদেশকে একাধারে স্বীকৃতি দেয় যুক্তরাজ্য, পশ্চিম জার্মানি, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, সুইডেন, নরওয়ে, আইসল্যান্ড ও ইসরায়েল। বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী ও ঘনিষ্ঠ মিত্র জাপান স্বীকৃতি দেয় ৮ ফেব্রুয়ারি। ১১ ফেব্রুয়ারি নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, আয়ারল্যান্ড ও লুক্সেমবার্গ স্বীকৃতি দেয়। ১৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ফ্রান্স ও পরদিন কানাডার স্বীকৃতি পায়।

পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ছিল না তৎকালীন মার্কিন সরকার। তারা রাজনৈতিক ও সামরিক– উভয় দিকে পাকিস্তানকে সহায়তা করে। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন তখনকার পরিস্থিতিকে ‘পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়’ বলে বর্ণনা করে হস্তক্ষেপে অস্বীকৃতি জানান। পরে তিনি পাকিস্তানের সহায়তায় নৌবহরও পাঠিয়েছিলেন। সেই যুক্তরাষ্ট্র স্বীকৃতি দিয়েছে ১৯৭২ সালের ৪ এপ্রিল। 

যাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে বাংলাদেশ জিতেছিল, সেই পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় ১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। বাংলাদেশ সৌদি আরব ও চীনের স্বীকৃতি পেয়েছিল বেশ পরে। ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট সৌদি আরব আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়। ১৫ দিন পর ৩১ আগস্ট চীনের স্বীকৃতি মেলে। 

এ স্বীকৃতি কেবল রাষ্ট্র থেকেই আসেনি, এসেছে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের তরফ থেকেও। মুক্তিযুদ্ধ চালাকালে বাংলাদেশ এ ধরনের অনেক স্বীকৃতি পেয়েছিল, যা আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের দুর্দমনীয় আকাঙ্ক্ষার আগুন জ্বালিয়ে রাখতে জ্বালানি হয়েছে। এগুলো ‘সংহতি’-এর নামে এলেও মূলত ছিল ‘স্বীকৃতি’ই। তখন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করলেও দেশটির বহু মানুষ স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য সোচ্চার ছিলেন। ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট নিউইয়র্কে হয় ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’। এতে তখনকার পপ সংগীতের বিখ্যাত শিল্পী বব ডিলান, জর্জ হ্যারিসন ও এরিক ক্ল্যাপটন অংশ নেন। এর অন্যতম আয়োজক ছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ারে ওই কনসার্টে দর্শক ছিলেন ৪০ হাজারের বেশি মানুষ। এ কনসার্ট বাংলাদেশের দিকে পুরো বিশ্বের নজর আকৃষ্ট করে।  

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যুক্তরাজ্যের সাংবাদিক সাইমন ড্রিং আসেন বাংলাদেশে। জীবন বাজি রেখে তিনি পাকিস্তানের সামরিক নৃশংসতার চিত্র ক্যামেরায় ধারণ করেন এবং বিশ্বের সামনে তুলে ধরেন। একাত্তরে বাংলাদেশের হয়ে রণাঙ্গনে লড়াই করেছেন অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক ডব্লিউ এস ওয়াডারল্যান্ড। পরে তাঁকে ‘বীরপ্রতীক’ খেতাব দেওয়া হয়। 

এসব সংহতি ও স্বীকৃতি বাংলাদেশকে এনে দেয় স্বাধীনতার লাল সূর্য। ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর মানিকগঞ্জ, খুলনার ডুমুরিয়াসহ অনেক এলাকা পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত হয়। বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণ করতে থাকে। রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রে অনুষ্ঠান সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। তবে তখনও রাজধানী ঢাকায় আত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিকতা বাকি ছিল, যা সম্পন্ন হয়েছিল ১৬ ডিসেম্বরে। 

আরও পড়ুন

×