ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

বিশ্ব মা দিবস আজ

অভ্যুত্থানে সন্তানহারা মায়েদের পৃথিবী বদলে গেছে

অভ্যুত্থানে সন্তানহারা মায়েদের পৃথিবী বদলে গেছে

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান চলাকালে ১৮ জুলাই শহীদ হন রেসিডেনসিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী ফারহান ফাইয়াজ। সেদিন থেকে ছেলের ঘর একইভাবে সাজিয়ে রাখেন মা ফারহানা দিবা। সম্প্রতি তোলা সমকাল

 সাজিদা ইসলাম পারুল

প্রকাশ: ১১ মে ২০২৫ | ০১:৪২ | আপডেট: ১১ মে ২০২৫ | ১২:২৯

‘মনটা যখন খুব ভারী হয়ে ওঠে, কারও সাথে কথা কই না। সোজা চলে যাই আজিমপুরে আমার বাপের কবরে। মাথার কাছে বসে মনের সব কথা কই। চোখের পানি ফেলি। ঘণ্টা দেড়েক পরে মনটা হালকা হলে বাড়ি ফিরি।’ কথাগুলো বলছিলেন গত বছরের জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ধানমন্ডির সায়েন্স ল্যাব এলাকায় আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের সামনে গুলিতে শহীদ আল আমিন শুভর মা রেণু বেগম। গত শুক্রবার রাজধানীর রায়েরবাজারের বৈশাখী খেলার মাঠ সংলগ্ন শুভদের বাসায় তাঁর সঙ্গে কথা হয়। 

রেণু বেগমের সাত সন্তানের মধ্যে শুভ দ্বিতীয়। খেতে ভালোবাসত হাঁসের ডিম, মায়ের হাতের রান্না করা শুঁটকির তরকারি। তাই ছেলের মৃত্যুর পর এখন অবধি ঘরে শুঁটকির তরকারি রান্না করেননি রেণু। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, প্রতিটা সন্তানই একজন মায়ের কাছে ভালোবাসার অমূল্য সম্পদ। কোনো সন্তানই আলাদা নয়। তাই সন্তানের মৃত্যু মেনে নেওয়া কঠিন। প্রতিদিন বিকেলে ধানমন্ডির ৩ নম্বর রোডে ছেলের ছোট গ্যারেজে গিয়ে তার ব্যবহারের জিনিসপত্র দেখি। এর মধ্যেই আমি আমার শুভকে অনুভব করি।

শুধু রেণু বেগমই নন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সন্তানহারা মায়েদের চেনা পৃথিবীটাই বদলে গেছে। উপার্জনকারী সন্তান হারিয়ে কোনো কোনো পরিবার চরম বিপাকে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আজ উদযাপিত হবে বিশ্ব মা দিবস। প্রতিবছর মে মাসের দ্বিতীয় রোববার এই দিবস পালন করা হয়। যে মায়েরা সন্তান হারিয়েছেন, তাদের জন্য আজকের দিনটি কান্না এবং দীর্ঘশ্বাসই বাড়াবে। 

মায়ের হাতে তৈরি কাচ্চি বিরিয়ানি খেতে ভালোবাসত জুলাই বিপ্লবে শহীদ ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের শিক্ষার্থী ফারহানুল ইসলাম ভূঁইয়া (ফারহান ফায়াজ)। সন্তান হারানোর পর থেকে বাসায় আর কাচ্চি বিরিয়ানি রান্না করেন না ফারহানের মা ফারহানা দিবা কুমকুম। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে তিনি এখনও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। কারও সঙ্গে কথা বলেন না। ছেলের ঘরে দিনরাত বসে নামাজ পড়েন, কাঁদেন। ওই ঘরে কাউকে যেতেও দেন না। মাঝে মাঝে নিজেই ধুলাবালি পরিষ্কার করেন। ফারহানের বাবা শহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, ফারহানকে হারিয়ে পুরো পরিবারটাই ভেঙে পড়েছে। ওর মা এখনও বাক্‌রুদ্ধ। ফারহানের দেড় বছরের ছোট বোন সায়ীমা ইসলাম ফারিন, এবার এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। প্রথমে পরীক্ষা দিতে চায়নি। জোর করে দেওয়াচ্ছি। এমনকি পিৎজা, বার্গার ফারহানের পছন্দের খাবার ছিল বলে এই ১০ মাসে এসব খাবার ঘরে আনা হয়নি। আমরা আসলে কোনো রকম বেঁচে আছি।’

২০২৪ সালের ১৯ জুলাই সায়েন্স ল্যাব এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে নিহত হন সাংবাদিক তাহির জামান প্রিয়। তাঁর একমাত্র সন্তান পদ্ম প্রিয় পারমিতা এখন মায়ের সঙ্গে মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের ভাড়া বাসায় থাকে। সেখানেই রংপুর থেকে প্রতি সপ্তাহে অথবা মাসে দু-তিনবার প্রিয়র মা শামসি আরা জামান ঢাকায় আসেন। নাতনির জন্য প্রিয় সব খাবার রান্না করে ফ্রিজে রেখে যান। শুক্রবার সকালে কথা হয় প্রিয়র মায়ের সঙ্গে। তিনি বলেন, মৃত্যুর আগে দেড় মাস মা-ছেলে রংপুরে ছিলেন। এটাই ছিল মা-ছেলের শেষ সময় কাটানো। ঘরের বারান্দায় রাখার জন্য মাকে একটি অর্কিডের চারা কিনে দিয়েছিলেন প্রিয়। মা সেই অর্কিডের যত্ন করেন নিয়মিত। প্রিয় সব সময় তাঁর মাকে সমাজের উচ্চ স্থানে দেখার স্বপ্ন দেখতেন। মাকে বলতেনও সে কথা। আজ মা একজন উদ্যোক্তা, সমাজসেবক। জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদকও। শামসি আরা জামান বলেন, ‘ছেলের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। কিন্তু ছেলে নেই। একমাত্র সন্তানের মৃত্যু মেনে নিতে না পারলেও ছেলের স্বপ্ন পূরণে এখন মানুষের জন্য কাজ করছেন।’

গত ১৯ জুলাই ঢাকার উত্তরার ভাড়া বাসার চারতলার বারান্দায় গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারায় খায়রুন নাহারের মেয়ে নাইমা সুলতানা। মাইলস্টোন স্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়ত নাইমা। খায়রুন নাহার বলেন, ‘নাইমাকে হারিয়ে আমরা কেউ ভালো নেই। ঠিকমতো ঘুমাতে পারি না। মনে হয়, এই বুঝি মা বলে ডাকবে।’ ৫ আগস্ট শহীদ ছয় বছরের জাবির ইব্রাহিমের মা রোকেয়া বেগম ফোনে বলেন, ‘তিন ভাইবোনের মধ্যে ছোট ছিল জাবির। মা মা বলে ঘুরে বেড়াত। কত বায়না ছিল তার। তাকে ছাড়া অসহায় হয়ে পড়েছি। সবকিছু কেমন নিঃস্ব লাগে তা আমি জানি আর আমার আল্লাহ জানেন।’ শহীদ শাফিক উদ্দিন আহমেদ আহনাফের মা জারতাজ পারভিন বলেন, ‘মায়ের আগে সন্তানের চলে যাওয়া কতটা কষ্টের, এ যন্ত্রণা বোঝানোর মতো নয়। সব থেকেও যেন কিছুই নেই।’

যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোর ও ওহাইওর মাঝামাঝি জংশন এলাকার বাসিন্দা অ্যানা জার্ভিসের মা অ্যান মেরি রিভস জার্ভিস সারাজীবন ব্যয় করেন অনাথ ও দুস্থদের সেবায়। মেরি ১৯০৫ সালে মারা যান। লোকচক্ষুর অগোচরে কাজ করা মেরিকে সম্মান দিতে চাইলেন মেয়ে অ্যানা জার্ভিস। একটি বিশেষ দিনকে মা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অ্যানা প্রচার শুরু করেন। সাত বছরের চেষ্টায় মা দিবস যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়। তবে বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন তারিখে দিনটি উদযাপন করা হয়। ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় রোববার নরওয়েতে, মার্চের চতুর্থ রোববার আয়ারল্যান্ড, নাইজেরিয়া ও যুক্তরাজ্যে মা দিবস উদযাপিত হয়। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় মা দিবস পালন হয় মে মাসের দ্বিতীয় রোববার।

আরও পড়ুন

×